স্বামীর মৃত্যুর খবর আগেই পেয়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা চন্দনাদেবী। কিন্তু বিয়ের মাত্র দশ মাসের মাথায় এমন দুঃসংবাদ মেনে নিতে পারেননি মন থেকে। শুক্রবার ভোরবেলা মুম্বইয়ের জাভেরি বাজারে বিস্ফোরণে হত প্রভাত নায়েকের (২৮) ছিন্নভিন্ন দেহ যখন এসে পৌঁছল পূর্ব মেদিনীপুরের পটাশপুর থানা এলাকার ব্রজলালপুর গ্রামে, তখন শোকে-দুঃখে জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। সান্ত্বনার ভাষা হারিয়ে ফেলেন গ্রামবাসীরাও। |
একচিলতে জমিতে চাষ ও দিনমজুরি করে বাবা চিত্ত নায়েক যে আয় করতেন, তাতে সংসার চলত না। তাই নবম শ্রেণির পরীক্ষা দিয়ে মাত্র ষোলো বছর বয়সেই রোজগারের আশায় মুম্বই পাড়ি দিয়েছিলেন প্রভাত। জাভেরি বাজারে হিরের দোকানে কাজ খুঁজে নিয়েছিলেন। কয়েক বছর পরে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন ছোট ভাই গুরুপদকেও। দুই ভাই আলাদা জায়গায় কাজ করলেও থাকতেন এক সঙ্গে। দু’জনের উপার্জনে ক্রমেই হাল ফিরছিল সংসারে। মাস দশেক আগে বিয়ে হয় প্রভাতের। স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই বাড়িতে ঘনঘন ফোন করতেন প্রভাত। অনাগত সন্তান ও স্ত্রী-র স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তার শেষ ছিল না তাঁর। কালীপুজোর সময় গ্রামের বাড়িতে আসার পরিকল্পনা করছিলেন। বুধবারও বিকেলে ফোন করেছিলেন বাড়িতে। কাঁদতে কাঁদতে চন্দনাদেবী বলেন, “বাবা হতে চলেছে জানতে পারার পর থেকেই বাড়ি আসতে চাইত। বুধবার বিকেলে ফোন করে আমাকে সাবধানে থাকতে বলছিল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই যে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তা দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।” মা কাজলদেবীর সঙ্গেও সেই বিকেলে কথা হয়েছিল প্রভাতের। সন্ধ্যায় লোকজনের মুখে বিস্ফোরণের খবর শুনেই অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠেছিল কাজলদেবীর। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছিলেন দুই ছেলেকে। বড় ছেলেকে না পেলেও ছোট ছেলে গুরুপদ তখন দাদা সুস্থ আছে বলেই আশ্বাস দিয়েছিলেন। গুরুপদ বলেন, “বুধবার কাজ ছিল না দাদার। ফলে প্রথমটায় বিস্ফোরণের খবর শুনে নিশ্চিন্তই ছিলাম। পরে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনি, দাদা সেই সময় জাভেরি বাজারে ছিল। দৌড়ে যাই। কিন্তু অনেক খুঁজেও দাদাকে পাইনি। মর্গে গিয়ে দেহ শনাক্ত করি।”
বুধবার সন্ধ্যা থেকেই উনুন বন্ধ নায়েক পরিবারে। হাজার চেষ্টা করেও অন্তঃসত্ত্বা চন্দনাদেবীর মুখে খাবার তুলে দিতে পারেনি কেউ। একে শরীর দুর্বল। তার উপরে জ্বর। শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূণর্র্ বিপর্যস্ত চন্দনাদেবী জ্ঞান হারাচ্ছিলেন ঘন-ঘন। বাড়ির দাওয়ায় বসে হা-হুতাশ করছিলেন প্রভাতের দিদিমা অশীতিপর রেবতী মির্দা। বাবা চিত্তবাবু বলেন, “নিজের ছেলের মৃত্যুসংবাদ শোনার চেয়ে দুঃখজনক কিছু নেই এই দুনিয়ায়। মুম্বইয়ে নিরাপত্তার এত অভাব। কী ভরসায় লোকে ছেলে-মেয়েদের পাঠাবে সেখানে।” ছোট ছেলে গুরুপদকে আর মুম্বইয়ে যেতে দেবেন না নায়েক দম্পতি। কাজলদেবী বলেন, “এখানেই খেটে খেতে বলব ছেলেমেয়েকে। টাকাপয়সার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। সেটা বোঝাতে হবে। যে-যতই ক্ষতিপূরণই দিক না কেন, ছেলে আর ফিরবে না ঘরে।” |