|
|
|
|
|
|
প্রতি পক্ষ |
শিকড়ের সন্ধানে
|
ছবি আঁকেন শুধু নয়, ইরফান ওবামাকে আঁকেন এমন ভাবে যে তার মধ্যে কোথাও যেন ধরা পড়ে
ওসামার আবছায়া আদল।
এক মুখে জুড়ে যায় অন্য মুখচ্ছবি। শিল্পীর মুখোমুখি শোভন তরফদার |
করাচি মানেই বুঝি দাউদ ইব্রাহিম শুধু? কিংবা, ক্রিকেট? উঁহু, ওই তো কলকাতার বুকে দিব্যি দাঁড়িয়ে আছেন করাচির আর এক প্রতিনিধি।
ইরফান হাসান। শিল্পী ইরফান হাসান। কমনওয়েলথ কানেকশন ইন্টারন্যাশনাল আর্টস রেসিডেন্সি ২০১০-এর প্রাপক ইরফান হাসান।
নিবাস করাচি, কিন্তু কলকাতায় কেন? ইরফান বলবেন, শিকড়ের খোঁজ? দূর দেশ থেকে এসে এ কোন শিকড়ের কথা উঠে আসে হে শিল্পী?
ইরফান বলবেন, গণেশ পাইন।
বলবেন, অবন ঠাকুর। বলবেন,
বেঙ্গল স্কুল।
তাই, কমনওয়েলথ-এর মধ্যে যে কোনও দেশে গিয়ে ছবি আঁকার সুযোগ থাকলেও ইরফান বেছে নিলেন কলকাতা। কারণ, তত দিনে তাঁর রক্তে গণেশ পাইন। এই বাঙালি শিল্পীর কাজ দেখেই তিনি আভাস পেয়েছেন, কী ভাবে শিল্পীর নিজস্ব শৈলীতে ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলে যেতে পারে আধুনিকতার বয়ান।
অতএব, কলকাতায় এসে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজই হয়ে উঠল তাঁর ঠিকানা। মিনিয়েচার পেন্টিং বা অনুচিত্রের ঘরানায় শিক্ষিত তিনি, পাঠ নিয়েছেন লাহৌরের বিখ্যাত ন্যাশনাল কলেজ অফ আর্টস-এ, অথচ প্রাচীনত্বের ঘেরাটোপ তাঁকে বন্দি করতে পারেনি কখনও। তিরিশে পা দেওয়ার আগেই ঘুরে ফেলেছেন বিশ্বের বহু দেশ। প্রিয় লেখক ওরহান পামুক (আর প্রিয় বই যে পামুকেরই ‘মাই নেম ইজ রেড’ হবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ তাতেও কাহিনির কেন্দ্রে আছেন এক অনুচিত্র শিল্পী)। কোক স্টুডিও দেখেন নিয়মিত। একই সঙ্গে শোনেন নুসরৎ ফতেহ আলি খান আর পাকিস্তানের নামজাদা ব্যান্ড স্ট্রিংস্।
তাই, ইরফানের সঙ্গে প্রথম আলাপেই কবুল করতে হল, চট্ করে পাকিস্তান বললেই মনের মধ্যে যে সব ধারণা আসে, তাঁকে দেখার পরে সেগুলো সরিয়ে রাখা ছাড়া উপায় নেই।
ইরফান হাসলেন, “ডোন্ট ওরি, আমেরিকায় আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ও বাবা, পাকিস্তানেও শিল্পী আছে নাকি? তোমরা
ছবিও আঁকো?”
ছবি আঁকেন শুধু নয়, ইরফান ওবামাকে আঁকেন এমন ভাবে যে তার মধ্যে কোথাও যেন ধরা পড়ে ওসামার আবছায়া আদল। এক মুখে জুড়ে যায় অন্য মুখচ্ছবি। তিনি আঁকেন ‘ইভ অ্যান্ড আই’। তিনিই আবার নিবিষ্ট হয়ে গ্রহণ করেন বেঙ্গল স্কুলের পাঠ।
‘‘ভাবলে অবাক লাগে, আমি যে কলেজের ছাত্র, সেই ন্যাশনাল কলেজ অফ আর্টস থেকেই, আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে কলকাতায়, এই আর্ট কলেজেই এসেছিলেন আবদুর রহমান চুঘতাই। এসে বেঙ্গল স্কুলের শৈলী শিখেছিলেন।” একটু আনমনা ইরফান, “আজ আমি এসেছি। গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজেই আছি, গেস্ট হাউসেই, নিঝুম রাতে এই বিরাট বাড়িটার দিকে তাকালে কেমন
শিহরণ জাগে।” |
|
ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য |
প্রশ্ন ছিল, গোটা দুনিয়া জুড়েই তো অনেকে ভাবেন যে পাকিস্তান মানেই শুধু সন্ত্রাস, যে কোনও মুহূর্তে গণতন্ত্র হটিয়ে ফৌজিশাহীর আতঙ্ক! তেমন একটা দেশে বসে ছবি আঁকতে কেমন লাগে? “আপনি যেগুলো বললেন, সেগুলো একেবারে অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু সেগুলোই যে একমাত্র পরিচয়, তা কিন্তু নয়। আমি বলব, এটা আমাদের বিদেশনীতির একটা বড় মাপের ব্যর্থতা যে পাকিস্তান মানেই যে স্রেফ টেররিজম নয়, সেটা তাঁরা সারা পৃথিবীর লোকের কাছে বোঝাতে পারেননি। বাকি আর পাঁচটা দেশের মতো আমাদেরও একটা জীবনের ছন্দ আছে। বেঁচে থাকা আছে। সন্ত্রাসের থাবা মোটেই সবটা শেষ করতে পারেনি। কোনও দিন পারবেও না। আর একটা কথা জানেন, যত ঘরের কোণে থাকবেন, ততই নানা রকম ভয় আপনাকে গ্রাস করবে। যত ঘুরবেন, দেখবেন মনে হচ্ছে, আমি মোটেই একা নই, এই তো চার পাশে যারা, তারাও তো আমারই মতো। ভয়টা কেটে যাবে।”
বলা হল, একেবারে এই মুহূর্তে চার পাশে যাদের দেখছেন, কী মনে হচ্ছে, তাঁরাও আপনার মতো?
ইরফান প্রশ্নটা ঘুরিয়ে দিলেন সরাসরি প্রশ্নকর্তার দিকে। কেন, কিছু আলাদা
দেখছেন বুঝি?
না, তা নয়... “ছবি দিয়েও তো এক দেশ থেকে অন্য দেশের মধ্যে সেতু গড়ে তোলা যায়। আসলে, সেই ব্রিজগুলো হয়েই আছে, আমরা খেয়াল করি না, সব সময়। আমি যেখানে এখন ছবি আঁকা শিখছি, এক সময় সেখানেই অবনীন্দ্রনাথ, ই বি হ্যাভেল-এর মতো ব্যক্তিত্ব ঘুরে বেড়াতেন, ভাবলেই কেমন আশ্চর্য লাগে! কে বলে, এই দেশে, এই ছবিতে আমার শিকড় নেই!”
ফিরে যাবেন শিগগির, তার আগে প্রথমে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ, তার পরে রাজ্য চারুকলা পর্ষদের আয়োজনে গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় ১৭ থেকে ১৯ জুলাই প্রদর্শনী। সুতরাং, এখন তিনি বিষম ব্যস্ত, প্রদর্শনীর আয়োজকদের কাছে কৃতজ্ঞও বটে। বিদায় নিতে হল অনতি বিলম্বে।
ইরফান হাসানকে আর বলে আসা হল না, তাঁর কথা বহু দিন আগে একটি কবিতায় লিখেছেন বিষ্ণু দে। জল দাও শিকড়ে আমার... |
|
|
|
|
|