|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
রাষ্ট্র ভাল, বাজার মন্দ |
বাজারদর বাড়িতেছে। পশ্চিমবঙ্গে, ভারতে, চিনেও। ঊর্ধ্বগামী বাজারদরকে কী উপায়ে বাগে আনা যায়, তাহা লইয়া রাজ্যে রাজ্যে, দেশে দেশে সরকারি কর্তারা উদ্বিগ্ন, অর্থনীতিবিশারদরা চিন্তিত। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের নিশ্চিত সদুপায় এখনও কেহ আবিষ্কার করিতে পারেন নাই, পারিলে মূল্যবৃদ্ধি আর সমস্যা থাকিত না ওয়েন জিয়াবাও হইতে মনমোহন সিংহ, সকলের মুখে হাসি ফুটিত। অথচ মূল্যবৃদ্ধির মোক্ষম দাওয়াই কিন্তু হাতের কাছেই রহিয়াছে। খাঁটি বঙ্গজ দাওয়াই, আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে প্রস্তুত। কয় দিন আগে ধর্মতলার জনসভায় সেই মহৌষধের গূঢ় সূত্রটি সগৌরবে ঘোষণা করিয়াছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী। দলীয় সমাবেশের মঞ্চে দাঁড়াইয়া তিনি জানাইয়াছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারদর নিয়ন্ত্রণের একটি উপায় আছে। নিছক একটি নহে, ‘একটিই’ উপায়। তাহা হইল, সেই দ্রব্যগুলিকে রেশন ব্যবস্থার আওতায় আনা। চাল ডাল আটা তেল ইত্যাদি যাহা কিছু সাধারণ মানুষের অপরিহার্য, তাহা রেশন দোকানে সস্তায় বিক্রয় করা হউক, গোল চুকিয়া গেল। কিন্তু সস্তায় পণ্য সরবরাহের জন্য যে বাড়তি খরচ, তাহার সংস্থান হইবে কী ভাবে? বুদ্ধদেববাবুর সহজ নিদান: সরকারকে ভর্তুকি দিতে হইবে। সেই কোন সত্যযুগ হইতে সি পি আই এম এই জনহিতকর সুপরামর্শ বিতরণ করিয়া আসিতেছে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার অবাধ্য, এমন সহজ সমাধান শোনে না, সুতরাং মানুষ মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়িতেছেন।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তাঁহার দলকে দোষী করিবার পূর্বে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল। সি পি আই এমকে পরাজিত করিয়া ক্ষমতায় আসিয়াছে তৃণমূল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলিমুদ্দিন-বিরোধিতা জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সুবিদিত। কিন্তু আলিমুদ্দিনের নীতি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি তাহার বিরোধী? বিচার করিয়া দেখা যাক। সূক্ষ্ম বিচার নহে, স্থূল বিচারই যথেষ্ট। ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে যান চালাইবার খরচ বাড়িয়াছে, সুতরাং যান-মালিকরা যাত্রিভাড়া বাড়াইবার দাবি জানাইয়াছিলেন। রাজ্য সরকার জানাইয়া দিয়াছে, ভাড়া বাড়ানো চলিবে না। কেন চলিবে না? কারণ, ভাড়া বাড়াইলে যাত্রীদের খরচ বাড়িবে। অর্থাৎ, ভাড়া সস্তা রাখাই সরকারের লক্ষ্য, তাহাতে পরিবহণ ব্যবসায় আয়ব্যয়ের হিসাব ঠিক থাকিল কি না, তাহা গণ্য নহে। লক্ষণীয়, ভূতপূর্ব মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, উভয়েই বাজারের তোয়াক্কা করেন না, চাল ডাল আটা তেল হউক বা বাস-মিনিবাস-ট্যাক্সির ভাড়া হউক, সব কিছুর মূল্যই জোর করিয়া কমাইয়া রাখিবার নীতিতে বিশ্বাস করেন। বুদ্ধদেববাবু তাঁহার বক্তৃতায় মার্ক্সবাদী বিক্রমে বাজারের মুণ্ডপাত করিয়াছেন, তাঁহার উত্তরসূরি স্বচ্ছন্দে সেই নিন্দায় সুর মিলাইতে পারেন, ‘দি অথর ইজ ডেড’ বলিয়া লইলে সি পি আই এম-দোষও কাটিয়া যাইবে।
ইহা দুর্ভাগ্যজনক, তবে বিস্ময়কর নহে। দলের নাম বা পতাকার রং যাহাই হউক, পশ্চিমবঙ্গে সকলেই বাজারবিমুখ এবং রাষ্ট্রবাদী। চাহিদা এবং জোগান অনুসারে বাজার পণ্য এবং পরিষেবার মূল্য নির্ধারণ করিবে অর্থনীতির এই প্রাথমিক যুক্তি এই রাজ্যের বামপন্থী মন মানিতে নারাজ। অতএব ভর্তুকি দিয়া চাল ডাল আটা তেল, ভর্তুকি দিয়া বাস মিনিবাস ট্যাক্সি। অজুহাত ভর্তুকি না দিলে দরিদ্রের কী হইবে? যথার্থ দরিদ্রের জন্য সরাসরি ভর্তুকির ব্যবস্থা করিবার যুক্তি আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু পাইকারি রেশন কিংবা পাইকারি হারে সস্তা ভাড়া চালু রাখিলে তাহার সুযোগ হস্তগত করেন প্রধানত মধ্যবিত্ত সমাজ। তাঁহারাই ধর্মতলার জনসভায় বক্তৃতা শোনেন, তাঁহারাই মিনিবাসে চড়েন, তাঁহারাই সরব, সবল, সঙ্ঘবদ্ধ। এবং অ-দূরদর্শী। ভর্তুকির দায় শেষ অবধি তাঁহাদেরই বহন করিতে হয়, কারণ তাহার সংস্থান করিতে হয় কর-ভাণ্ডার হইতেই, কিন্তু তাহা দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপার, আপাতত বাসভাড়া কম থাকিলে ভাল হয়, আপাতত রেশনে কল্পতরু মিলিলে আরও ভাল হয়। অতএব আজ-কাল-পরশুর রাজনীতি চলিতে থাকে। রাষ্ট্রবাদী এবং বাজারবিমুখ ‘আদর্শ’র আড়ালে মধ্যবিত্ত তোষণের রাজনীতি। শাসক বদলায়, রাজনীতি বদলায় না। |
|
|
|
|
|