|
|
|
|
|
|
|
সিনেমা সমালোচনা ২... |
|
সাবাস সোহিনী |
মায়ের ভালবাসার চাপে ছেলের হাঁসফাঁস করার এই কাহিনি চিরন্তন। লিখছেন গৌতম চক্রবর্তী |
এই মুহূর্তে সব চেয়ে ট্র্যাজিক বাংলা ছবির নাম ‘ইচ্ছে’।
এই ট্র্যাজেডি কোনও গল্পের বা নায়কের নয়। ট্র্যাজেডি একটা সময়ের। আমাদের চার পাশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে সন্তানের ওপর মা-বাবার ‘ইচ্ছে’র বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার সেই জরদ্গব এবং কুৎসিত কাহিনি। এই ছবির শুরুর দিকে রিকশায় চেপে ছোট্ট বালক স্কুলে চলেছে। কিন্তু খিদের মুখে কলার খোসা ছাড়িয়ে কলাটা মুখে দেওয়ারও সময় পায় না সে। কলাটা চিবোতে থাকে, আর তার মা সোহিনী হালদার তাকে অঙ্ক বোঝাতে থাকেন। স্কুলের দরজা পেরিয়েও সেই শিশুর নিস্তার নেই। মা মুখ বাড়িয়ে দেন, “ভাল ভাবে রিভাইজ কোরো, কেমন?” প্রথম ছবিতেই এ রকম একটি বিষয় ধরার জন্য শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়কে ষাট শতাংশ নম্বর দেওয়া উচিত। দশে ৬!
এবং মায়ের চরিত্রে সোহিনী যা অভিনয় করে গেলেন! ‘পারমিতার একদিন’-এর পর, ফের ছবিতে দেখা গেল তাঁকে। গোলগাল ভারী শরীর, আহত দৃষ্টি, মানসিক অসুস্থতার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে-থাকা এক চরিত্র। সাবাস সোহিনী! তাঁকে ছাড়া এই ছবি ভাবা যায় না! সন্তানের ওপর নিজের ব্যর্থ উচ্চাশা আর স্বপ্নের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার যে মানসিক অসুস্থতা...তার বীজ অনেক মায়ের বুকেই কিন্তু আজ বাসা বেঁধে আছে!
এবং কয়েকটি দৃশ্যে সোহিনীর সঙ্গে চমৎকার পাল্লা দিলেন ছেলের চরিত্রে সমদর্শী দত্ত। শেষ দৃশ্যটি মনে রাখার মতো! সমদর্শী মায়ের গলা জড়িয়ে ফিসফিস করে বলতে থাকে, “তুমি আমার কিছু করতে পারবে না, মা। অনার্স পরীক্ষাটা আমি দিইনি।” সোহিনী চমকাতে থাকেন। ছেলে কিন্তু বলতে থাকে, “আমি আজ বিয়ে করেছি। মুম্বইয়ে একটা চাকরি নিয়ে চলে যাচ্ছি।” দেখতে দেখতে চমকে উঠতে হয়! ছেলে তো এ বার মাকে গলা টিপে খুন করে দিতে পারে!
খুনটাই ঘটল। “এই সেই রেজিস্ট্রি সার্টিফিকেট।” অসহায় সোহিনীর কোলে ছুরির মতো গেঁথে পড়ে থাকে ছেলের বিয়ের সেই শংসাপত্র। সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘ইচ্ছের গাছ’ গল্পটা শেষ হয়েছিল এর আগের মুহূর্তে। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে ছেলে। মা ভাবছেন, ছেলে তাঁকে কী শাস্তি দেবে? কিন্তু শিবপ্রসাদ আর নন্দিতাদের চিত্রনাট্য সেই ‘সাহিত্যিক সংশয়’-এ ভোগেনি। বরং রীতিমতো ‘সিনেমাটিক এন্ডিং’, মাকে শাস্তি দিয়ে ছবিটা এগিয়ে গিয়েছে আরও এক ধাপ! অতএব ছয় নয়, দশে সাত! |
|
ইচ্ছে
সোহিনী, ব্রাত্য, সমদর্শী, বিদিতা |
মাকে শাস্তি দেওয়া? এই ছবি মা এবং ছেলে...দু’ জনের মনস্তত্ত্বই চমৎকার দেখিয়েছে। সোহিনী তাঁর উচ্চাশাহীন স্বামীকে (ব্রাত্য বসু) নিয়ে তৃপ্ত নন। সেখান থেকেই তিনি ঘোড়দৌড়ের বাজি ধরেন ছেলের ওপরে। ব্রাত্য এবং সোহিনীর একটি দৃশ্যই চমৎকার। সোহিনী বলতে থাকেন, তাঁর ছেলে অক্সফোর্ডে যাবে, সেখান থেকে হার্ভার্ড। ব্রাত্য এসে সোহিনীকে ধরেন, “অনেক হয়েছে। এগুলি ওর স্বপ্ন নয়। এগুলি তোমার স্বপ্ন।” এই দৃশ্যটুকুর বাইরে মা-ছেলের এই ছবিতে ব্রাত্যর কিছু করার ছিল না। দুই নায়িকার মধ্যে কলেজপ্রেমিকা বিদিতা বাগকেই ভাল লাগে।
চমৎকার সুর দিয়েছেন সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়। ‘ভূমি’র গায়ক নিজে গেয়েছেন ‘ও মন’। বাংলাদেশের গায়িকা আনুশে আর রূপমের ‘ঈশান কোণে হ্যালিউসিনেশন’ও চমৎকার।
কিন্তু আম-বাঙালি দর্শক? ছেলের সঙ্গে মায়ের ব্যবধান তৈরির এই গল্প তাঁরা মেনে নিতে পারবেন? যদি অসুবিধা হয়, সেটি একুশ শতকের ভণ্ডামি! মায়ের ভালবাসার চাপে ছেলের হাঁসফাঁস করার এই কাহিনি চিরন্তন! ‘চোখের বালি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথও মহেন্দ্রর ‘ওভার পজেসিভ’ মায়ের কথা লিখেছিলেন। বিভূতিভূষণ ‘অপরাজিত’ উপন্যাসে আরও সাঙ্ঘাতিক! সর্বজয়ার মৃত্যুর পরেই তিনি জানান, ‘মায়ের মৃত্যুর পর অপু এক বাধাবন্ধহীন মুক্তির আনন্দ লাভ করিল।’ ভুললে চলবে না, শিবপ্রসাদের এই ছবির অন্যতম নিবেদক এক বাঙালি নারী। ঋ তুপর্ণা সেনগুপ্ত! এটাই প্রমাণ, বাঙালির সাংস্কৃতিক নির্মাণ কী ভাবে নিঃশব্দে বদলে যাচ্ছে! পর্দার আড়ালে তাই ঋতুপর্ণারও সাধুবাদ প্রাপ্য।
ভুল কি কিছুই নেই? ছবির দ্বিতীয়ার্ধ চমৎকার। প্রথমার্ধে নায়কের স্কুল-প্রেমিকা রূপলেখা মিত্র কাঠের পুতুলের মতো। কোচিং ক্লাস এবং সেখান থেকে কেটে এসে বাইপাসের ভেড়ির ধারে প্রেমিক-প্রেমিকার দৃশ্যগুলিও এমন কিছু আহামরি নয়। কোচিং ক্লাসের দুই প্রেমিক-প্রেমিকা পরস্পরকে শুধুই চিঠি লেখে। সেলফোনে প্রেম এসেছে দ্বিতীয়ার্ধে। পরিচালকের যুক্তি হতেই পারে, “এদের স্কুলজীবন ছিল নব্বইয়ের শুরুতে। তখন মোবাইল এমন সর্বব্যাপী ছিল না।” কে না জানে, ‘জীবনের বাস্তবতা’ আর ‘সিনেমার বাস্তবতা’ আলাদা! পরিচালক এই ছবিতে নায়ককে ‘কম্পারেটিভ লিটারেচার’-এর ছাত্র করেছেন ঠিকই। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্যের এই অমোঘ সত্যটি ধরতে না পারার জন্য তাঁকে লেটার নম্বর...দশে আট দেওয়া গেল না। |
|
|
|
|
|