অভিশপ্ত যাত্রা
হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনি, লাইন থেকে ছিটকে গেল কালকা মেল
দুপুর ১২টা ২০ মিনিট। দিল্লিগামী হাওড়া-কালকা মেল সবে মাত্র মলওয়াঁ স্টেশন ছেড়ে বেরোচ্ছে। হঠাৎ প্রবল ঝাঁকুনি। আর তার পরই খেলনা গাড়ির মতো উল্টে গেল একের পর এক কামরা। ইঞ্জিন-সহ মোট ১৬টি। কোনওটা উল্টে পড়ল অন্য লাইনে। কোনও কামরা আবার উঠে গেল অন্যটির মাথায়।
এখনও পর্যন্ত এই বছরের সবচেয়ে ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনার সাক্ষী থাকল উত্তরপ্রদেশের ফতেপুরের কাছে ছোট স্টেশন মলওয়াঁ, যেখানে দাঁড়ায়ই না হাওড়া-দিল্লি কালকা মেল। তার কাছেই আজ দুপুরে লাইনচ্যুত হয়েছে কালকা মেল। রেল সূত্রের খবর, এখনও পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা কমপক্ষে ৩৫। আহত দু’শোরও বেশি যাত্রী। কয়েকটি কামরা অন্য কামরার মধ্যে বা নীচে এমন ভাবে ঢুকে গিয়েছে, যেখান থেকে উদ্ধার কাজ খুবই কঠিন। সেই সব কামরায় উদ্ধারকারীরা ঢুকলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রেল কর্তৃপক্ষ। কানপুর থেকে প্রায় ১২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বের এই স্টেশন পার হয়ে যখন আজ দুপুরে কালকা মেল ছুটে যাচ্ছিল, তখন তার গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ১০৮ কিলোমিটার। প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে, সেই সময় আচমকাই ইমারজেন্সি ব্রেক কষেন চালক। তার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে লাইনচ্যুত হয় গোটা ট্রেন।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কামরাগুলি। কোনও কোনও কামরা একটি অন্যটির উপরে এমন ভাবে উঠে গিয়েছে যে, নীচ দিয়ে হেঁটে যাওয়া যাচ্ছে। একটি কামরা আবার চেপে ঢুকে গিয়েছে অন্য একটি উল্টে যাওয়া কামরার নীচে।
রেল সূত্রে বলা হয়েছে, লাইনচ্যুত কামরাগুলির মধ্যে দশটি কামরার অবস্থা খুবই খারাপ। এর মধ্যে রয়েছে দু’টি অসংরক্ষিত কামরা, পাঁচটি সংরক্ষিত স্লিপার কামরা (এস-১ থেকে এস-৫), তিনটি বাতানুকূল কামরা। প্যান্ট্রি কারটিও যথেষ্টই ক্ষতিগ্রস্ত। ইঞ্জিনের পরের অসংরক্ষিত কামরাটিতেই হতাহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার ভয়াবহতা উঠে এসেছে কোনও ক্রমে প্রাণে বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের কারও কারও কথা থেকে। কলকাতা থেকে চণ্ডীগড় যাচ্ছিলেন দীপালি প্রধান। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পরিবারের সাত সদস্যও। দীপালিদেবীর কথাতেই ধরা পড়েছে দুর্ঘটনার ভয়াবহতা, “খুব জোরে যাচ্ছিল ট্রেনটি। হঠাৎ শুনি একটা বিকট শব্দ। আর প্রবল ঝাঁকুনি। সেই ধাক্কাতেই আপার বার্থ থেকে নীচে পড়ে যাই আমি। আমার দেওর, শাশুড়ি ও বাচ্চারাও গুরুতর আহত।” দীপালিদেবীর পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা। সেই অবস্থায় মালপত্র একা হাতে সামলাতে ব্যস্ত তিনি। মোগলসরাই থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন সুচিত্রা শর্মা। তিনি বলছিলেন, “ফতেপুর পর্যন্ত ভালই চলছিল গাড়ি।
যেন খেলনা গাড়ি। দুর্ঘটনার পর এমন ভাবেই তালগোল পাকিয়ে
গিয়েছে কালকা মেলের কামরাগুলি। রবিবার পিটিআইয়ের ছবি।
কিন্তু মালওয়া স্টেশনে ঢোকার আগে হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। হুড়মুড়িয়ে অনেকে বার্থ থেকে পড়ে গেলেন। আমিও পড়ে যাই। সব লণ্ডভণ্ড অবস্থা। তার মধ্যে কোনও রকমে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এক সময় নেমে পড়ি কামরা থেকে। নেমে দেখি, আমাদের কামরার অনেকটা অংশ লাইনের বাইরে চলে গিয়েছে। একটু এগোতেই চোখে পড়ল, বেশ কয়েকটা কামরা উল্টে গিয়েছে। ভয়ে আর এগোতে পারলাম না!” অল্পের জন্যবেঁচে গিয়েছেন আর এক যাত্রী সুদীপ চন্দ্রও। দোমড়ানো কামরাগুলির ঠিক পরের কামরায় ছিলেন তিনি। মলওয়াঁ থেকে ফোনে তিনি বললেন, “আচমকা ট্রেনটা হেলতে শুরু করে। প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে এর পর থেমেও যায়। নেমে দেখি সামনে কী কাণ্ড ঘটে গিয়েছে।” স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনার পরপরই আশপাশের অঞ্চল থেকে গ্রামবাসীরা এসে উদ্ধার কাজে হাত লাগান। তাঁরাই মূলত আহতদের কামরা থেকে বার করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করেন। রাত পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, কানপুর, ইলাহাবাদ, লখনউ ও ফতেপুরের বিভিন্ন হাসপাতালে আহতদের ভর্তি করা হয়েছে।
দুর্ঘটনার কিছু পরে মলওয়াঁয় শ’খানেক উদ্ধার কর্মী পাঠায় রেল। জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলার কর্মীরাও ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। বিকেলের দিকে ইলাহাবাদ ও কানপুর থেকে দু’টি রিলিফ ট্রেন আসে মলওয়াঁয়। রেলের তরফে সাহায্য চাওয়া হয় সেনা বাহিনীর কাছেও। আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে ব্যবহার করা হয়ে সেনার কপ্টার-অ্যাম্বুল্যান্স। রাতে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, আলো জ্বেলে তখনও উদ্ধার কাজ চলছে জোরকদমে।
কিন্তু এত দ্রুত গতিতে থাকা ট্রেনে কেন ব্রেক কষতে গেলেন চালক? এই প্রশ্নের সদুত্তর মেলেনি। শুধু তাই নয়, ব্রেক কষার ফলে ট্রেন লাইনচ্যুত হল, নাকি ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার পরে বাঁচতে ব্রেক কষেছিলেন চালক, তা নিয়েও ধন্দ রয়েছে। এক পক্ষের বক্তব্য, ব্রেকের ফলে লাইনচ্যুত হয়নি ট্রেনটি।
দুর্ঘটনাগ্রস্ত কালকা মেলে ধানবাদের শ’দেড়েক যাত্রী ছিলেন। তাঁদের খবর
জানতে পরিজনদের ভিড় ধানবাদ স্টেশনে।-চন্দন পাল
বরং ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার পরই যাত্রীদের প্রাণ বাঁচাতে ইমার্জেন্সি ব্রেক কষেন চালক। কিন্তু তার ফল হয় পুরোপুরি উল্টো। এর বিপরীত বয়ানও কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে রেলের তরফ থেকেই। ইলাহাবাদের রেল কর্তাদের একাংশের দাবি, ইমার্জেন্সি ব্রেক কষার ফলে দুর্ঘটনা ঘটেনি। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান বিনয় মিত্তল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছন। তিনি বলেন, “সিগন্যাল ঠিকঠাক কাজ করছিল। লাইনের ফিসপ্লেটও অক্ষত রয়েছে। চালক মদ খেয়ে ছিলেন না বলেই জানি। এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।” দুর্ঘটনায় মৃতদের পরিবারকে এককালীন ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার।
দুই স্টেশন, এক চিত্র। উদ্বিগ্ন পরিজনেরা খোঁজ নিচ্ছেন কালকার
যাত্রীদের। রবিবার আসানসোল ও বর্ধমানে। নিজস্ব চিত্র
রেল প্রতিমন্ত্রী মুকুল রায় আজ বিকেলে এ কথা জানান। এ ছাড়া, গুরুতর আহতদের ১ লক্ষ ও অপেক্ষাকৃত কম আহতদের ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। আলাদা ভাবে ক্ষতিপূরণের কথা ঘোষণা করেছে মায়াবতীর সরকারও। মৃতদের পরিবারকে ১ লক্ষ, গুরুতর আহতদের ৫০ হাজার ও অপেক্ষাকৃত আহতদের ২৫ হাজার টাকা দেবে উত্তরপ্রদেশ সরকার।
রেল সূত্রের খবর, দুর্ঘটনাগ্রস্ত কালকা মেলে পশ্চিমবঙ্গের মোট ১,১১৫ জন যাত্রী ছিলেন। তবে হতাহতের মধ্যে রাজ্যের ক’জন রয়েছেন, রাত পর্যন্ত সেই সংখ্যাটা পরিষ্কার নয়। সন্ধের পর একে একে মৃতদের নাম জানাতে শুরু করে রেল।
First Page Desh Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.