|
|
|
|
‘নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ বিতর্কের মধ্যে লন্ডনে মার্ডক |
‘কলঙ্কের’ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেই ইতিহাসের শেষ |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
ধন্যবাদ এবং বিদায়!
এতটাই সোজাসাপ্টা। এতটাই সরাসরি ভঙ্গিতে শেষ সংস্করণে সাড়ে ৭৫ লক্ষ পাঠককে বিদায় জানাল ‘নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ (এনওডব্লিউ)।
প্রথম পাতা জুড়ে ১৬৮ বছরের অজস্র ‘এক্সক্লুসিভ ফ্রন্ট পেজ’-এর কোলাজে বিশ্বকে শেষ বারের মতো মনে করিয়ে দেওয়া মশলাদার খবর পরিবেশনে এনওডব্লিউ-র মুন্সিয়ানা। তার পরই সম্পাদকীয় পাতায় অকপট স্বীকারোক্তি, “আমরা পথভ্রষ্ট হয়েছিলাম। যা করেছি তার জন্য কোনও ব্যাখ্যাই যথেষ্ট নয়। একটা দুর্দান্ত ইতিহাসকে এ ভাবে কলঙ্কিত করার জন্য দুঃখিত।” স্মৃতিচারণ আর স্বীকারোক্তির মিশেলে এ ভাবেই ফুরিয়ে গেল ব্রিটিশ সংবাদপত্রের এর এক টুকরো ইতিহাস। আর সেই সমাপ্তিকে আরও নাটকীয় করে তুলতে এ দিনই লন্ডনে এসে পৌঁছলেন অশীতিপর ‘সম্রাট’ রুপার্ট কিথ মার্ডক, ‘নিউজ কর্পোরেশনে’র চেয়ারম্যান!
শনিবার রাত থেকেই আবেগতাড়িত এনওডব্লিউ-র নিউজ রুম। শেষ সংস্করণ তৈরি হয়ে যাওয়ার পর সহকর্মীদের বিদায় জানানোর সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। রবিবারের লন্ডনের সকালেও সেই আবেগের ছোঁয়া। বহু উৎসাহী পাঠককে সকাল সকালই ভিড় জমাতে দেখা যায় রাস্তার ধারের দোকানগুলিতে। ‘ইতিহাসের এক টুকরো’ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার আগেই সংগ্রহ করে নিতে। সেই উৎসাহ সামাল দিতে এক পাউন্ড মূল্যের এই শেষ সংস্করণ ছাপতে হল অতিরিক্ত পরিমাণে। যে সংস্করণে সম্পাদক কলিন মাইলার এনওডব্লিউ-র জন্য শেষ বারের মতো কলম ধরলেন এক রাশ প্রত্যাশা নিয়ে, “আশা করব, এই ঘটনার পরও পাঠকরা আমাদের এত বছরের ইতিহাসের নিরিখেই বিচার করবে।” |
|
নিউজ ইন্টারন্যাশনালের সদর দফতরের পথে মার্ডক। রয়টার্স |
শেষ হল এনওডব্লিউ-র পথ চলা। কিন্তু এখনই ফুরোচ্ছে না মার্ডক-সাম্রাজ্যকে ঘিরে বিতর্ক। বরং আরও ছড়াচ্ছে তার শাখা প্রশাখা। ক্লাইভ গুডম্যান, অ্যান্ডি কুলসন গ্রেফতার হয়েছিলেন আগেই। ক্ষোভ জমছিল আর এক প্রাক্তন সম্পাদক রেবেকা ব্রুকসের বিরুদ্ধেও। ২০০০ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ব্রুকসের সম্পাদনাতেই চলেছে এনওডব্লিউ। এবং পরিসংখ্যান বলছে ওই তিন বছরেই সব থেকে ‘হাই প্রোফাইল’ ব্যক্তিত্বদের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছে। এ বার এই বিতর্কে উঠে আসছে আরও এক রাঘব বোয়ালের নামও। তিনি লেস হিন্টন। বর্তমানে নিউ ইয়কের্র মার্ডক-সাম্রাজ্যেরই অংশ ডাও জোন্সের কর্ণধার। ব্রুকস এবং কুলসন দু’জনের অধীনেই কর্মরত ছিলেন তিনি। তার থেকেও বড় কথা, জনশ্রুতি, মার্ডকের এতটাই ঘনিষ্ঠ ছিলেন হিন্টন যে তার স্যান্ডুইচ পর্যন্ত কিনে নিয়ে যেতেন। স্বাভাবিক ভাবেই, আড়ি পাতা সংক্রান্ত গোটা বিষয়টা সম্পর্কেই তিনি অবগত ছিলেন বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাঁদের বক্তব্য, হিন্টন এই বিতর্কে জড়িয়ে পড়লে আরও জটিল সমস্যায় পড়তে পারে ‘নিউজ কর্পোরেশন’।
এই মতামতের সঙ্গত কারণও রয়েছে অবশ্য। ২০০৭-এ কুলসনের অধীনস্থ এক রিপোর্টার ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়ার পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি কমিটি হিন্টনের কাছে জানতে চায়, এনওডব্লিউ-র আর কোনও রিপোর্টার এই ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে কি না। হিন্টন কমিটিকে আশ্বস্ত করে জানান, এ বিষয়ে বিস্তারিত তদন্ত করেছে এনওডব্লিউ কর্তৃপক্ষ এবং আড়ি পাতার ঘটনা ওই এক জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে জানা যাচ্ছে, ফোনে আড়ি পাতা এনওডব্লিউতে অত্যন্ত প্রচলিত ব্যাপার ছিল। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই, চার বছর আগে দেওয়া বিবৃতির জন্য ঘোরতর সমস্যায় পড়তে পারেন হিন্টন। ‘নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ সংক্রান্ত একটি বইয়ের লেখক পিটার বার্ডেনের মতে, “নিউজ কর্পোরেশনের সব থেকে বড় বিপদ হয়ে উঠতে পারেন হিন্টন। এখন তিনি ডাও জোন্স এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সঙ্গে যুক্ত। ফলে এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে যাওয়াটা অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে।” |
|
শেষ সংস্করণ। এএফপি |
তবে, এই জড়িয়ে পড়া এড়ানোর জন্য কিন্তু চেষ্টার অভাব ছিল না মার্ডক বা হিন্টন কারও তরফেই। দু’জনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হলেও তা কখনই জনসমক্ষে আসেনি। ঘনিষ্ঠ সূত্রের খবর, নিজের উপর থেকে নজর ঘোরানোর জন্য গত ছ’মাসে লন্ডন যাওয়াও কমিয়ে দিয়েছিলেন হিন্টন। তবে, তাতেও শেষ রক্ষা হল না সম্ভবত। খুব শিগগিরই জেরার মুখে পড়তে হতে পারে হিন্টনকেও।
এই অবস্থায় গোটা ঘটনায় নয়া মাত্রা জোগাচ্ছে রুপার্ট মার্ডকের লন্ডনে পদার্পণ। পরিচিত পানামা হ্যাট পরিহিত মার্ডকের হাতে ছিল এনওডব্লিউ-র শেষ সংস্করণ। যা পড়তে পড়তেই লাল রঙের রেঞ্জ রোভারে ‘নিউজ ইন্টারন্যাশনাল’-এর সদর দফতরে যান মার্ডক। তবে ফোনে আড়ি পাতার বিষয় নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি তিনি। মার্ডকের লন্ডনে আবির্ভাবের পরই বিরোধী দলনেতা এড মিলিব্যান্ড বলেন, “মার্ডকের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত যাতে তিনি ব্রিটিশ স্কাই ব্রডকাস্টিং (বিস্কাইবি)-র শেয়ার কিনতে না পারেন তা নিশ্চিত করতে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি।”
১৮৪৩-এ শুরু। তার পর থেকে পৃথিবার ইতিহাস বদলে দেওয়া একের পর এক ঘটনার সাক্ষী। পুরনো দিনের ছাপাখানা থেকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে উত্তরণ। এই সমস্ত কিছু নিয়েই ঐতিহাসিক যাত্রা ‘নিউজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর। আজকের পর যা নিজেই হয়ে গেল ইতিহাসের অংশ। পড়ে রইল শুধু মার্ডকদের কিছুটা নড়বড়ে হয়ে পড়া সাম্রাজ্য। যার দায়িত্বে বর্তমানে রুপার্ট-পুত্র জেমস। হঠাৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়া এই ভবিষ্যৎকে এখন তিনি কী ভাবে সামলান তা দেখতেই উন্মুখ দুনিয়া। |
|
|
|
|
|