|
|
|
|
সই হোক দার্জিলিঙে, চান মমতা |
পাহাড় চুক্তির খসড়ায় সহমত রাজ্য ও মোর্চা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
মাত্র দু’দিন আগে বিমল গুরুঙ্গ হুমকি দিয়েছিলেন, ‘বঙ্গভঙ্গ’ হবেই। কিন্তু দু’দিনের মধ্যে সুর বদলে কলকাতায় এসে রাজ্যের সঙ্গে পাহাড় চুক্তির খসড়ায় (মেমোরান্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট, সংক্ষেপে ‘মোয়া’) সই করে গেলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার প্রতিনিধিরা।
শুক্রবার মহাকরণে দু’পক্ষের প্রতিনিধিরা ‘মোয়া’-এ সই করার পরে রাজ্যের মুখ্যসচিব সমর ঘোষ জানান, এ দিনই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিবের কাছে সই সম্বলিত চুক্তির খসড়াটি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে অনুরোধ করা হয়েছে, আগামী ১২ অথবা ১৩ জুলাই কেন্দ্র-রাজ্য-মোর্চার মধ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হলে ভাল হয়। আসলে এ দিন ‘মোয়া’ সই হয়ে যাওয়ার পরে এটা কার্যত আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন, ত্রিপাক্ষিক চুক্তির সেই অনুষ্ঠান হোক দার্জিলিঙে।
|
|
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ রোশন গিরি এবং অন্য মোর্চা নেতাদের। নিজস্ব চিত্র |
দার্জিলিং সমস্যার জট খুলতে গত মাসের ৬-৭ তারিখ মহাকরণে দু’পক্ষের বৈঠক হয়েছিল। দু’দিনের সেই বৈঠকে মীমাংসা সূত্র বেরিয়ে আসায় সভার কার্যবিবরণীতে দু’পক্ষ সই করেছিলেন। এ দিন আরও এক ধাপ এগিয়ে, খসড়া চুক্তিতে সই করল রাজ্য ও মোর্চা। তবে তার আগে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টার বৈঠক হল দু’পক্ষের মধ্যে। রাজ্যের পক্ষে স্বরাষ্ট্রসচিব এবং মোর্চার পক্ষে রোশন গিরি চুক্তির খসড়াতে সই করেন। প্রশাসনের মতে, আগামী সপ্তাহে যে ‘ত্রিপাক্ষিক চুক্তি’ হতে চলেছে, তা অনেকটাই আনুষ্ঠানিক। কারণ, চুক্তির ব্যাপারে রাজ্য ও মোর্চা ঐকমত্যে পৌঁছনোয় কেন্দ্রের কোনও আপত্তি থাকার কথা নয়। কার্যত সেই ইঙ্গিত দিয়ে মুখ্যসচিব বলেন, “দার্জিলিঙের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার একটি আর্থিক ‘প্যাকেজ’ দেবে। সেটা তৈরি করে আজই দিল্লিতে পাঠানো হয়েছে।”
নির্বাচনের আগে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষণা ছিল, ক্ষমতায় এলে তিনি দ্রুত পাহাড় সমস্যার সমাধান করবেন। সেই সঙ্গে পাহাড়কে ‘সুইৎজারল্যান্ড’-এর মতো করে গড়ে তুলবেন। তাঁর সরকারের দেড় মাসের মাথায় পাহাড় সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে ত্রিপাক্ষিক চুক্তির পথে এগিয়ে গিয়েছেন মমতা। এখন কেন্দ্র ও রাজ্যের অর্থে পাহাড়ের পরিকাঠামো উন্নয়ন ও সৌন্দর্যায়নের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতেও সমান আগ্রহী মুখ্যমন্ত্রী। যদিও দ্বিপাক্ষিক চুক্তি নিয়ে এ দিন কোনও প্রতিক্রিয়া জানাননি তিনি। শুধু বলেছেন, “যা ছিল, তাই আছে।”
দু’দিন আগে ডুয়ার্সে গিয়ে ‘বঙ্গভঙ্গ’ হবেই বলে হুমকি দিয়েছেন মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ। বিশেষত, তরাই-ডুয়ার্সকে অন্তর্বর্তী স্বশাসনের আওতায় আনার দাবিতে গুরুঙ্গের হুমকির জেরে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ-সহ ৫টি সংগঠন তীব্র আপত্তি জানায়। এর ফলে চুক্তির প্রক্রিয়াটি ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা যায়। সরকারি সূত্রের খবর, এর পর কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে ‘কঠোর’ বার্তা পাঠিয়ে মোর্চা নেতৃত্বকে সংযত থাকতে বলা হয়। যার জেরে পর দিন থেকে মুখে কুলুপ আঁটেন গুরুঙ্গ। সরকারি তরফে মোর্চাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়, পাহাড়ে শান্তি ফেরানোর প্রক্রিয়ায় যেন কোনও ভাবে বিঘ্ন না ঘটে। এর পরে রাজ্য সরকারের বার্তা পেয়ে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি ও এল বি পেরিয়ার কলকাতায় মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিব জ্ঞানদত্ত গৌতমের সঙ্গে বৈঠক করতে আসেন।
এ দিন বৈঠকের পরে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক সাংবাদিকদের বলেন, “অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনার পর চুক্তির খসড়া পাকা হয়েছে। এখন সরকারের সঙ্গে আমাদের কোনও মতভেদ নেই।” তিনি জানান, বৈঠকের পরে তাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তাঁকেও তাঁরা জানিয়েছেন, রাজ্য সরকারের সঙ্গে মোর্চা সমঝোতায় পৌঁছেছে। মুখ্যসচিব বলেন, “আগের বৈঠকে বড় বড় বিষয়গুলির নিষ্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কয়েকটি ছোট বিষয়ে মতপার্থক্য ছিল। সেটা মেটাতেই বৈঠক ডাকা হয়।” ঠিক হয়েছে, প্রস্তাবিত নতুন স্বশাসিত পরিষদের নাম হবে ‘গোর্খাল্যান্ড টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিষ্ট্রেশন’।
মোর্চার সঙ্গে আলোচনার শুরুতে পরিষদের নামের মধ্যে ‘অটোনমাস’ শব্দটি রাখা হয়েছিল। সেটি পরিবর্তন করে কেন ‘টেরিটোরিয়াল’ করা হল? জবাবে মুখ্যসচিব বলেন, “নামের ক্ষেত্রে দু’টি প্রস্তাবই ছিল মোর্চার। আমাদের কোনওটাতেই আপত্তি ছিল না। পরিষদের নামের মধ্যে ‘স্টেট’ (রাজ্য) শব্দটা থাকলে আমরা আপত্তি জানাতাম।” এ দিন মুখ্যমন্ত্রীকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, “নামে কী আসে-যায়!”
বৈঠকে ঠিক হয়েছে, পরিষদের এলাকার মধ্যে কলেজ ও স্কুল সার্ভিস কমিশনের আলাদা অফিস হবে। এ ছাড়া পেনশন-পিএফ-গ্রুপ ইনসিওরেন্সের জন্যও অফিস খোলা হবে। মুখ্যসচিব জানান, নতুন পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিষদকে ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে। তারা গ্রুপ বি, সি এবং ডি পদে নিয়োগ করতে পারবে। তবে তা রাজ্যপালের অনুমোদনক্রমে। তবে গ্রুপ-এ পদে নিয়োগের অধিকার থাকবে না নতুন পরিষদের। নতুন পরিষদের হাতে কোনও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকবে না। তাই তাদের কর আরোপ করার সুযোগও নেই বলে জানান মুখ্যসচিব। তবে চুক্তি অনুযায়ী, চা-বাগানের জমির বার্ষিক ‘রিনিউয়াল ফি’ নিতে পারবে পরিষদ।
পাহাড় সমস্যার সমাধানে অন্যতম অন্তরায় ছিল ডুয়ার্স ও তরাইয়ের অন্তর্ভুক্তির দাবি। মোর্চার সেই দাবি নিয়ে মীমাংসায় পৌঁছতে আগের বৈঠকেই ৯ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। রোশন গিরি জানান, বিষয়টি দেখতে ৯ সদস্যের একটি কমিটি হয়েছে। তার মধ্যে চার জন মোর্চার প্রতিনিধি থাকবেন, চার জন রাজ্য সরকারের ও এক জন কেন্দ্রের। কমিটিই বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। তিনি আরও জানান, সরকার পক্ষে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিঙের জেলাশাসক, দার্জিলিং পার্বত্য পরিষদের প্রশাসক অনিল বর্মা থাকবেন। কমিটির চেয়ারম্যান হবেন সরকারেরই প্রতিনিধি। ওই নামটা এখনও ঠিক হয়নি। মোর্চা নেতার কথাতেই স্পষ্ট, নতুন এলাকা অন্তর্ভুক্তির দাবি নিয়ে এখনও কোনও ঐকমত্য হয়নি।
মুখ্যসচিব জানান, বিধানসভার আগামী অধিবেশনেই নতুন স্বশাসিত পরিষদ তৈরির বিল আনা হবে। সেই বিলে ওই কমিটির কথা উল্লেখ করে বলা হবে, তরাই ও ডুয়ার্সের নতুন এলাকা সংযোজন নিয়ে কমিটির সুপারিশ গৃহীত হলে তা পরিষদের আওতাভুক্ত করা হবে। গঠনের ছ’মাসের মধ্যে তাদের সুপারিশ জানাবে কমিটি। পাহাড়ে নির্বাচনের মাধ্যমে তৈরি হবে নতুন পরিষদ। সেই নির্বাচন কী পদ্ধতিতে হবে, তা-ও থাকবে প্রস্তাবিত বিলে। মুখ্যসচিবের বক্তব্য, “আগামী সপ্তাহে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি সই হলে পরের বিধানসভা অধিবেশনেই (সম্ভবত অগস্ট মাসে) বিল আনা হবে। সেই বিল পাশ হলে তাতে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগবে। তার পর বর্তমান পর্ষদ এলাকার সীমানা পুনর্বিন্যাসের কাজে হাত দেওয়া হবে। সেই কাজ শেষ হলে নতুন পরিষদ গঠনের জন্য নির্বাচন হবে। চলতি আর্থিক বছরের মধ্যেই তা হবে বলে আশা করছি।” |
|
|
|
|
|