|
|
|
|
স্মরণ... |
একটু আসছি, রোরোকে দেখো বলে চলে গেল |
১২৭ জন মিস্তিরির নাম আছে। ১২৮ নম্বর মিস্তিরির নাম নেই। মল্লিকা সেনগুপ্তের ডায়েরিতে। সেই নামহীন
মিস্তিরি সুবোধ সরকার ৩৪ বছরের বিগত দাম্পত্য নিয়ে লিখলেন দোলের দিন, দু’জনে। সৌজন্য: সুবোধ সরকার |
গত বছর গোয়ায় একটা সকালে মল্লিকা সমুদ্রে গেছে চার চার বার। আমি ঘুমিয়ে। একা চলে গেল। আর এক বার স্বাতীদির সঙ্গে। ফিরে রোরোকে নিয়ে। তার পর সুনীলদাকে রাজি করিয়ে সবাই মিলে আরও এক বার। মাত্র এক মাস আগে কেমো শেষ হয়েছে মল্লিকার, এত সাহস, বিশ্বাস হয় না। আমি, সুনীলদা বিয়ার নিয়ে বসেছি, সামনে মধ্যদিনের গনগনে সমুদ্র, হঠাৎ ছ’ফিট এক ইঞ্চি রোরোর দিকে তাকিয়ে সুনীলদা বললেন, “রোরো, একটু খাবে নাকি?” রোরোর মুখে মেঘ ঠেলে দপ করে চাঁদ জ্বলে উঠল। আমি গম্ভীর। আর মল্লিকার সে কী উচ্ছ্বাস ছেলের হাতে বিয়ার দেখে। আঠারোর হাতেখড়ি দেখে একটা মায়ের কেমন লাগে, আমি জীবনে প্রথম দেখলাম।
মল্লিকার একটা ডায়েরি হাতে এল। কবিতার নয়। কলের মিস্তিরি, ছুতোর মিস্তিরি, রঙের মিস্তিরি, মাইক্রোওয়েভ সারানোর লোক, পাড়ার কম্পাউন্ডার, দর্জির নম্বর, দুধওয়ালার নম্বর, শিল-কোটাওয়ালার নম্বর, নাপিতের নম্বর, রাঁধুনির মেয়ের বাড়ি--- প্রত্যেকের নাম জানত। নম্বর লিখে রাখত। গত পঁচিশ বছর ১২৭ জন মিস্তিরির নাম আর নম্বর দেখার পর আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, আমার ঠোঁটে একটা নিয়তির হাসি আর চোখের কোনায় একবিন্দু শিশির, আসলে আমিও তো ছিলাম একটা মিস্তিরি। ১২৮ নম্বর মিস্তিরি, যার নাম ডায়েরিতে লেখা নেই।
জলপাইগুড়ি থেকে সে বার গেলাম মেটেলির হাটে। তিনটে ঝুড়ি মাথায় নিয়ে সে বার দার্জিলিং মেলে আমাকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। তাও তো মেটেলি। ২০০৬ সালে, র্যাডিয়েশনের পর, নিউ জার্সিতে গৌতম দত্তের রাজবাড়িতে বেসক্যাম্প পেতে, হিউজস্টনে বঙ্গ সম্মেলন সেরে সান হোসে গিয়ে কবিতা পড়ে, ওয়াশিংটনে এসে আবার কবিতা পড়া, আবার দীর্ঘ বিমান যাত্রা, আমি হাঁফিয়ে গেলাম, মল্লিকার পায়ের নীচে সর্ষে, সে বার অভিভাবকের মতো আমাদের সামলেছিলেন নীরেনদা। তাও নীরেনদার হাত ফসকে এক সকালে জর্জ টাউন ছাড়িয়ে, ছোট নদী পার হয়ে একটা আদিবাসী গ্রাম থেকে মেরিল্যান্ডের অঞ্জলিদিকে নিয়ে মল্লিকা পাখির বাসা সংগ্রহ করেছিল, সেটা আমাকে না ভেঙে সিরিটির বাড়ি নিয়ে আসতে হল, সে যে কী কঠিন কাজ! পাখির বাসা আমার ঘরে থেকে গেল, কিন্তু মল্লিকা থাকল না।
কবিতা নিয়ে সে তর্ক করত না। কবি অনেক রকম। যার যাকে ভাল লাগে। |
|
এক বার জব্বলপুরে সাহিত্য সভা সেরে দিব্যেন্দুদা-কল্যাণীদিদের নিয়ে আমরা মার্বেল রক্স দেখতে বেরিয়েছি। নৌকো থেকে নামার পর একটা লোক এসে দাঁড়াল, “আপনি আগে ভাল লিখতেন, এখন এত নারীবাদী হয়ে গেছেন, আর ভাল লাগে না। আপনি চিরন্তন হতে পারবেন না।” মল্লিকা হাসল। জিজ্ঞাসা করল, “আপনি কোথায় থাকেন?” “রানিকুঠি।” এ বার মল্লিকা জোরে হেসে উঠল, “আপনি এত দূর ঠেঙিয়ে জব্বলপুর এলেন এই কথা বলতে? শুনুন, চিরন্তন বলে কিছু নেই, বেঁচে থাকার জন্য লিখি, চিরন্তনবাবুর জন্য লিখি না। আমি আপনার পাশের পাড়াতেই থাকি। যে কোনও রবিবার সকালে আমাদের বাড়ি চলে আসবেন।” তিনি এসেছিলেন শনিবার, গত ২৮ মে। আমি তার চোখে জল দেখতে পেলাম। মাত্র দু’দিন আগে তিনি আমাকে ফোন করে বললেন, “মল্লিকা যখন ‘আপনি বলুন মার্কস, মেয়েরা কি বিপ্লবের সেবাদাসী হবে?’ লিখলেন, তাঁর কার্ল মার্কসকে চ্যালেঞ্জ করে বসাটা আমি নিতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু তিনি আমাদের কথামানবী।”
আমার আক্ষেপ, মল্লিকাকে কেউ একটা বড় পুরস্কার দিতে পারলেন না। বিচারকেরা একটু কিপটেমি করে ফেললেন। জানতেন মেয়েটা বাঁচবে না, তাও তাঁরা পারলেন না। বছর পাঁচেক আগে এক জন বড় লেখক বলেছিলেন, আজ আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত, এক ঘণ্টা ধরে আমি জুরি বোর্ডকে বোঝালাম তাও দিল না। মল্লিকা বাড়ি ফিরে আমাকে বলেছিল, “আমি সিন্ধুর মেয়ে, আমার এখনও সময় হয়নি, হবে।”
এক হাতে কেমো চলছে, অন্য হাতে ‘মনের মানুষ’ হাসপাতালে বহু জন এই দৃশ্য দেখেছেন। ব্রেন মেটাসটেসিস ধরা পড়ার পরেও কাজল পরেছে। রোরো চোখের জল লুকিয়ে মাকে চুমু খেত আর বলত, “তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে মা।” তার উত্তরে হাসত, “দেখিস, আমার মাথায় আবার চুল আসবে, নতুন চুল, নতুন শাড়ি পরে আবার আমি কলেজ যাব, এক ঘর ছাত্রীর সামনে দাঁড়াব। উঠে দাঁড়িয়ে ছাত্রীরা গাইবে আগুনের পরশমণি...”
মল্লিকার শেষ বই ‘কবির বউঠান’। তিনশো পাতার উপন্যাস। জ্ঞানদানন্দিনী আর কাদম্বরীর সংসার ও সেক্স নিয়ে চাপা টেনশন। বিছানায় বই আর ওষুধ। দু’বছর ধরে লিখেছিল। প্রচুর বই জোগাড় করে দিয়েছিলেন ‘আনন্দ’র সুবীরদা।
পিছিয়ে পড়া মেয়ে অলকানন্দা গিরিদের নিয়ে মল্লিকা অনেক লিখেছে। বারংবার মেয়েদের জন্য কলম ধরেছে। লোকে বলত, এত নারীবাদী হোয়ো না, এত মেয়ে মেয়ে কোরো না। আমি বলি, মেয়েদের জন্য লিখেছে, বেশ করেছে। কিন্তু আর একটা কথা আছে। রামায়ণ থেকে নিউক্লিয়ার বম্ব পর্যন্ত যত অস্ত্র দেখেছে মানুষ, সেই অস্ত্রের বিরুদ্ধে মল্লিকা যত কবিতা লিখেছে, পুরুষ কবিরা তার অর্ধেকও লেখেনি। এও সত্যি। ঢাকুরিয়ার হাসপাতাল চত্বরে বহু রাত পর্যন্ত তরুণ কবিরা আমাকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত।
পাশে দাঁড়িয়ে থাকাটাও যে কত সুন্দর সেটা প্রতিদিন
একটু একটু করে বুঝতে পারতাম। আর বুঝতে পারতাম হাসপাতালের ভেতরে শুয়ে থাকা মানুষটা একটু একটু করে ফুরিয়ে আসছে। ওষুধ নেই, আর ওষুধ নেই, বিজ্ঞান হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। এক মিলিয়ন, দুই মিলিয়ন বছর হেঁটে আসার পর আমার মনে হল, সত্যি মনে হল, মানুষ আজও ছোট্ট এক মথ যার মাথায় এক বস্তা ভুবন।
আমার সঙ্গে ন’টা পঁয়ত্রিশের কৃষ্ণনগর লোকালে জানলার পাশে দেখা হয়েছিল ছিপছিপে একটা মল্লিকার সঙ্গে। বয়স ১৭। সোশিওলজি অনার্স। পাঁচ পাঁচ, হলুদ শাড়ি। কপালে বড় টিপ। হাতে ‘আউটসাইডার’। একটা দুষ্টু বন্ধু বলল, “নিউ ফার্স্ট ইয়ার, মেয়েটাকে র্যাগ করতে পারবি?” আমি করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু নিজেই র্যাগ্ড হয়ে ফিরে আসি। ৩৪ বছর ব্যাপী আজ আমাদের র্যাগিংটা শেষ হয়ে গেল। ২৫-টা বই লিখে, “এই একটু আসছি, রোরোকে দেখো,” বলে চলে গেল। |
|
|
|
|
|