মুখোমুখি ...
ইতি মা
ত্রিকা: মা হওয়ার পর আপনার রুটিনের তো দফা-রফা...
কঙ্কণা: আর বলবেন না! ঘুমের পুরো বারোটা বেজে গেছে। আমি ঘুমোতে খুব ভালবাসি। প্রচুর ঘুমোতে পারিও (হাসি)। ইস্স্স, কবে যে আবার টানা আট ঘণ্টা ঘুমোব! তবে হ্যাঁ, অনুভূতিটার কোনও তুলনা নেই। আগে অনেকে বলেছে বটে, কিন্তু মা না হলে সেই অনুভূতিটা কল্পনাতেও আসে না। জীবনটা পুরো বদলে যায়। হঠাৎই অনেক দায়িত্ব এসে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা অসাধারণ। এই যেমন, দাদুর (চিদানন্দ দাশগুপ্ত) মৃত্যুর পর দু’দিনের জন্য কলকাতায় গিয়েছিলাম। ছেলেকে রেখে গিয়েছিলাম তার বাবার জিম্মায়। এত শোকেও মনটা থেকে থেকেই ওর কাছে চলে যাচ্ছিল। বড্ড ছোট্ট তো। এই কয়েক মাস আগে ওকে ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে গিয়েছিলাম। বেচারা, ওইটুকু পুঁচকে, খুব কষ্ট হয়েছিল।

পত্রিকা: ছেলেকে কী নামে ডাকেন?
কঙ্কণা: ওর নাম হারুন। সলমন রুশদির ‘হারুন অ্যান্ড দ্য সি অফ স্টোরিজ’ উপন্যাস থেকে নেওয়া। আরব্য রজনীতেও হারুন নামের একটা চরিত্র আছে। সংস্কৃততে হারুন মানে আশা। অবশ্য ওকে নানা নামে সবাই ডাকে। নাম দেওয়ার আগে বন্ধুবান্ধবরা ওকে ‘বেবি শোরে’ বা ‘ছোটু’ বলে ডাকত (হাসি)।

পত্রিকা: ছেলেকে ঘুমপাড়ানি গান শোনান?
কঙ্কণা: শোনাই। কিন্তু বেশির ভাগই নিজের বানানো গান, নিজেরই সুর দেওয়া...

পত্রিকা: দারুণ তো! যেমন?
কঙ্কণা: আরে, ও সবের মাথামুণ্ডু নেই। আসলে, আমাদের ছোটবেলার সেই গানগুলো, ‘ঘুমপাড়ানিয়া মাসি, পিসি মোদের বাড়ি এসো...’ তার পরের লাইনগুলো আর কিছুই মনে নেই। তাই নিজে নিজেই বানাই।

পত্রিকা: কর্তার (রণবীর শোরে) সঙ্গে হারুনের জন্য রাত জাগা নিয়ে ঝামেলা লাগে?
কঙ্কণা: লাগে না আবার! তবে আমরা পুরো ব্যাপারটাতেই ট্রায়াল-অ্যান্ড-এরর মেথডে এগোচ্ছি।
‘ইতি মৃণালিনী’র শু্যটিংয়ে
পত্রিকা: সে আবার কী?
কঙ্কণা: (হাসতে হাসতে) মেথডটা শুরু হারুনের কান্নার সময় দিয়ে। মানে খাওয়া, ঘুম, ন্যাপি পাল্টানো আর ঢেকুর তোলানো এই চারটে কাজই তো এখন বুঝতে হয় কান্নার মাধ্যমে। খাওয়ার পর কান্না মানে হয় ঘুম পেয়েছে বা পেটে ব্যথা করছে। এই করেই আমাদের হারুনের সঙ্গে আলাপ গড়ে উঠছে। নিজেরাও বাবা-মা ‘হওয়া’ শিখছি। তবে ভাগ্যিস এ সব ব্যাপারে রণবীরের বোধবুদ্ধি আমার থেকে অনেক বেশি। ও যে ভাবে হারুনকে সামলায়, আমি ভাবতেই পারি না। এমনিতেই বাচ্চা-পাগল মানুষ। আসলে ওর অনেক ভাগ্নে-ভাগ্নি আছে। যাদের সঙ্গে ওর খুব পটে। আমার ওর মতো অত বাচ্চা-প্রীতি নেই।

পত্রিকা: আজকাল যেখানে অতিব্যস্ত পেশাদার মহিলারা মা হয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাজে যোগ দিচ্ছেন, সেখানে আপনি বছর শেষের আগে কাজে যোগ দেবেন না...
কঙ্কণা: আসলে, এটা নির্ভর করে নিজের নিজের স্বাচ্ছন্দ্যবোধের ওপর। এই বছরের শেষে হারুনের বয়েস প্রায় সাত-আট মাস হবে। তার আগে কাজে যোগ দিতে স্বচ্ছন্দ নই।

পত্রিকা: ‘শেপ’-এ ফেরার জন্য শরীরচর্চা করছেন?
কঙ্কণা: সে রকম খুব একটা নয়। আমি নিজের শরীর নিয়ে কোনও দিনই হাইপার ছিলাম না। যোগা আগেও করতাম, এখনও করি। এখন হারুনকে ফেলে বাইরে বেরোনোও মুশকিল। বাড়িতে এক জন শিক্ষক আসেন। প্লাইওমেট্রিক্সের সঙ্গে আরও অনেক ধরনের কী কী সব যেন করান। আমি কোনও দিন সাঙ্ঘাতিক রকম মোটা বা রোগা ছিলাম না। পাগলের মতো ডায়েটও করতে হয়নি। সেই সামঞ্জস্যটা এখনও আছে। তাই অকারণ স্ট্রেস নিই না। ফিট থাকাটাই লক্ষ্য।

পত্রিকা: বিয়ের অল্প কিছু দিনের মধ্যেই মা হলেন। আপনার মা ‘ডিলেইড প্রেগন্যানসি’ নিয়ে আপনাকে বকেছিলেন?
কঙ্কণা: না না, বকেননি। বলেছিলেন, “যদি মাতৃত্ব পিছতে চাও, তা হলে ফ্রিজ ইয়োর এগ্স।” মা অসম্ভব প্রগতিশীল মহিলা।

পত্রিকা: কী বলছেন নাতিকে দেখে?
কঙ্কণা: খুব খুশি হয়েছেন। বাবাও। দিদিও এসেছিল। মানে বিশেষ কিছু নয়, সবাই যেমন খুশি হয় আর কী।

পত্রিকা: আপনার মা তো এক হাতে আপনাকে খাওয়াতেন, আরেক হাতে ‘পরমা’য় ক্যামেরাকে নির্দেশ দিতেন...
কঙ্কণা: হ্যাঁ, ঠিকই। ‘পরমা’র সময় আমার বয়েস ছিল চার। আমি মায়ের সঙ্গে শু্যটিংয়ে যেতাম, বাইরেও যেতাম। চলচ্চিত্র উৎসবে বিদেশেও যেতাম। মা কাজ-পাগল মানুষ। ‘৩৬, চৌরঙ্গী লেন’-এ তো আমি আরও ছোট। কিন্তু মা অসম্ভব দক্ষতায় সংসার, ছবি পরিচালনা, সমস্ত সামলাতেন। আমিও আশা করি সেটা পারব।

পত্রিকা: আপনার বড় হওয়া আর হারুনকে বড় করার মধ্যে কি কোনও পার্থক্য থাকবে?
কঙ্কণা: (একটু ভেবে) মনে হয়, না। আমি অত্যন্ত প্রগতিশীল এবং মুক্তমনা পরিবেশে বড় হয়েছি। সেই পরিবেশ ছিল এক উন্নত পিতৃত্ব-মাতৃত্বের সংজ্ঞার। বাৎসল্য, স্নেহ এবং আদরে ভরা। আমার যখন চার বছর বয়েস তখন মা-বাবা আমায় জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি কোন পদবি রাখতে চাই সেন নাকি শর্মা? আমার মনে হয়েছিল, কোনও একটা বাছলে ওঁদের কোনও এক জন কষ্ট পেতে পারেন। তাই আমিই ঠিক করি, দুটো পদবিই রাখব। সেটাই চলছে। আজকের কঙ্কণা তো দু’টোরই মিশেল।

পত্রিকা: আপনার মা তাঁর নিজের মতো করে জীবন চালিত করেছিলেন। আপনার সে ব্যাপারে কোনও ক্ষোভ নেই? কোনও না পাওয়ার যন্ত্রণা?
কঙ্কণা: ওই যে বললাম, আমি অত্যন্ত মুক্তমনা ও অপ্রথাগত পরিবেশে বড় হয়েছি। আমার সাত বছর বয়েস থেকেই মা ‘সিঙ্গল মম’। আর আমার বাবা যখন দ্বিতীয় বার বিয়ে করেন, তখন আমার বয়েস তোরো কী চোদ্দো। দু’জনেই অত্যন্ত দৃঢ় মনের মানুষ। আমি ভাগ্যবান যে, আমার চার জন অনুভূতিশীল বাবা-মা। এটা তো বিরল। আসল কথা হল, যদি ঠিকঠিক ভালবাসা বা বোঝাপড়া থাকে তা হলে অসুবিধে হয় না। মা কোনও দিনই বইপড়া-জ্ঞানে বিশ্বাস করতেন না। আমি খুবই খারাপ ছাত্রী ছিলাম। অঙ্কে প্রত্যেক বার ফেল করতে করতে বেঁচে যেতাম। ক্লাস নাইনে তো প্রায় ফেল-ই করে বসেছিলাম। পড়াশোনার জন্য প্রথম পুরস্কার পেলাম সেই স্নাতক স্তরে, সেন্ট স্টিফেন্সে। মা কিন্তু ঘাবড়াতেন না। চাপ তো দিতেনই না। বরং আমাকে নিয়ে সিনেমা দেখতেন, বেড়াতে যেতেন।

পত্রিকা: কিন্তু বেশি দিন মা-বাবাকে একসঙ্গে না পাওয়ার ক্ষোভ...
কঙ্কণা: একেবারেই না। ক্ষোভের তো ব্যাপারই নেই। মনে আছে, মা, বাবা, দাদু শেক্সপিয়র পড়ে শোনাতেন। খুব ছোট থেকেই মা, বাবা সেই সব কবিতা পড়ে শোনাতেন যা বড় হয়ে স্কুলে বা কলেজে পড়ব...

পত্রিকা: আপনার জীবন কিন্তু আপনার মায়ের তুলনায় অনেক স্থিতিশীল...
কঙ্কণা: (হাসতে হাসতে) দাঁড়ান, আমার তো সবে অর্ধেক জীবন হল। এটাও নিজস্ব ব্যাপার। যে যেমন ভাবে জীবনকে দেখে বা উপভোগ করতে চায়

পত্রিকা: আপনারা দু’জনেই শিল্পী। আবার মা-মেয়েও বটে। মায়ের কোন সত্তার সঙ্গে নিজের বেশি মিল পান?
কঙ্কণা: দু’টোই আসলে। উত্তরাধিকারসূত্রে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি মার কাছ থেকে। তার মধ্যে সব থেকে শক্তিশালী হল ওঁর শিল্পীসত্তা। আমি অবশ্যই আমার মতো করে বড় হয়েছি। তর্কও হয় আমাদের। কিন্তু সেটা ছবি বা মতামতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশি। কারণ মা এক জন সাঙ্ঘাতিক নিরপেক্ষ মানুষ। আর শিল্পী হিসেবে বলতে পারি, মা দেশের শ্রেষ্ঠ পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম বলে, তাঁর ছবিতে কাজ করাও সম্মানের। যেমন ‘১৫, পার্ক অ্যাভিনিউ’ করব বলে মীরা নায়ারের ‘নেমসেক’ ছেড়ে দিয়েছিলাম। আমার শ্রেষ্ঠ অভিনয়টা মা-ই বের করে আনতে পারেন।

পত্রিকা: মায়ের কোন ব্যাপারটা সব থেকে ভাল লাগে?
কঙ্কণা: অনেক কিছুই। মায়ের ব্যক্তিত্বের মধ্যে একটা সম্মোহনকারী ব্যাপার আছে। রুচি অসম্ভব ভাল। বিশেষ করে বই, সিনেমা এবং সঙ্গীতের। উনি এতটাই নিরপেক্ষ যে, আমি যে কোনও কিছুই ওঁকে খুলে বলতে পারি। উনি মতামত দেন। কিন্তু কখনও কোনও কিছুতেই অহেতুক নাক গলান না বা চাপিয়ে দেন না। স্বাভাবিক ভাবেই যে কোনও সঙ্কটের মুহূর্তে আমি ওঁর কাছে ছুটে যাই। উনি আমার সব চেয়ে প্রিয় বন্ধু। মা খুব রসিক। দারুণ গল্প বলেন। কত গল্প যে ওঁর ঝুলিতে (হাসতে হাসতে)! আর দারুণ নাচতে ভালবাসেন। যে কোনও পার্টিতে সব থেকে আগে ওঠেন নাচার জন্য। দারুণ রান্নাও করেন। দিদাও খুব ভাল রাঁধতেন। মায়ের প্রন ককটেল তো দারুণ জনপ্রিয়।

পত্রিকা: আপনি রান্নার টিপ্স নেন না?
কঙ্কণা: নিই তো। এই তো সে দিন ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, পাঁচমেশালি তরকারিতে কী ফোড়ন দেয় (হাসি)।

পত্রিকা: আর মায়ের কোন ব্যাপারগুলোয় বিরক্ত লাগে?
কঙ্কণা: আমাকে দেখলেই খালি আমার চুল ঠিক করতে চান। যেটা খুব বিরক্তিকর। আর খালি বলেন, “আরেকটু ভাল জামাকাপড় পরো। আরেকটু সাজো।” আসলে সব ব্যাপারেই উনি খুব প্যাশনেট। আরেকটা ব্যাপার, মা খুব ইস্ত্রি করতে ভালবাসেন (হাসি)। মনে আছে, আমার বিয়ের আগে, এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময়, মা সবার জামাকাপড় ধোপার মতো টেনে, ঝেড়ে, ইস্ত্রি করে ফেললেন। আর খুব পরিষ্কার-পরিষ্কার বাতিক আছে। সেটা অবশ্য আমারও আছে।

পত্রিকা: কয়েক মাস আগে নিউ ইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘ইতি মৃণালিনী’র জন্য অপর্ণা সেন এবং আপনি ইতিমধ্যেই শ্রেষ্ঠ পরিচালক এবং শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর শিরোপা পেয়ে গিয়েছেন...
কঙ্কণা: হ্যাঁ, আমি তো ভীষণ উত্তেজিত। কিছু দিনের মধ্যেই ‘ইতি মৃণালিনী’ মুক্তি পাবে। আমি তো হাত গুটিয়ে বসে আছি। মায়ের ছবি। সত্তরের দশকের এক অভিনেত্রীর চরিত্র। আসলে অনেকগুলো স্তরে অভিনয় আছে। এক, সময়ের দরুন সেই অর্থে পিরিয়ড ড্রামা। দুই, তখনকার এক নায়িকার চরিত্রও বটে। সুতরাং, সেই সময়কার অভিনেত্রীদের কী সুবিধে-অসুবিধের মধ্যে কাজ করতে হত, সেটা অভিনয় করতে গিয়ে হাতে-নাতে বুঝতে পারাও একটা অভিজ্ঞতা।

পত্রিকা: আপনার ঝুলিতে দু’খানা জাতীয় পুরস্কার। কেরিয়ারে কতটা সাহায্য করেছে আপনাকে?
কঙ্কণা: প্রাথমিক ভাবে কিছুটা তো করেইছে। একটা পরিচিতি দিয়েছে। তবে পুরস্কার সাঙ্ঘাতিক ভাবে কিছু সাহায্য করে না, কারণ অভিনয়ের মান তো আর পুরস্কার পাওয়া, না পাওয়ার ওপর নির্ভর করে না। মানে, যদি না পাই তা হলে খারাপ অভিনয় করব, এমনটা তো নয়। এমনও নয় যে, পুরস্কার দাও, তবেই খেলব। তবে একটা ব্যাপার আছে। এক বার বড় পুরস্কার পেলে ছোট বাজেটের ছবি করার সময় নানা চিন্তা মাথায় ঘোরে। মানে, হয়তো ওই ছবির জনপ্রিয়তা বা ব্যবসা আমার অভিনয় বা ‘মুখ’-এর ওপর নির্ভরশীল। তখন সেই ঝুঁকি নেব কি না, সেটা ভাববার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু যখন দেখি সেই সব ছবি আদৃত হচ্ছে, তখন নিজের ওপর সেই বিশ্বাসটা ফিরে আসে।

পত্রিকা: আপনি দীপিকা পাডুকোন নন। শাবানা আজমিও নন। আপনার পিআরও বেশ বাজে। এত অলস কেন?
কঙ্কণা: আমি নিজেকে আদ্যন্ত বাণিজ্যিক অভিনেত্রী তো বলতে পারি না। সেই জন্যেই আমি নম্বর দৌড়ে নেই। নিজেকে রাখতেও চাই না। তবে আমি খুঁতখুঁতে। বেছে ছবি করি। আর পিআর? (হাসতে হাসতে) এখন ঠেলায় পড়ে এক জন পাবলিসিস্ট রেখেছি। সে-ও আমাকে বকে, “কেন আমায় রেখেছ? কিছুই তো বলো না করতে...”।
Previous Item Patrika Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.