|
|
|
|
যানজটেই দিন কাবার, বিরক্ত অমর্ত্য |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
এক দশক আগের কথা।
যানজটের চোটে সে দিন গ্র্যান্ড হোটেল থেকে রতন টাটার গাড়িই বেরোতে পারেনি। হোটেল চত্বরে মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করে টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রাস্তা পেরিয়ে নিজেই ট্যাক্সি খুঁজতে শুরু করেন। পরে এক চিত্রগ্রাহকের গাড়িতে চেপে তাজ বেঙ্গলের সভায় পৌঁছেছিলেন তিনি।
রতন টাটার মতো অতটা তিক্ত অভিজ্ঞতা না-হলেও কলকাতার যানজটে আমজনতার ভোগান্তির আঁচ
শুক্রবার কিছুটা টের পেয়ে গেলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন।
এ দিন সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত শহরে তিনটে কর্মসূচি ছিল অমর্ত্যবাবুর। তাজ বেঙ্গল থেকে বেরিয়ে সকাল ১১টায় রোটারি সদনে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠান, বিকেল চারটেয় সায়েন্স সিটিতে একটি অনুষ্ঠান এবং সন্ধে ছ’টায় টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বৈঠক। শহরের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে পৌঁছাতে গিয়ে যানজটে ও ট্র্যাফিক সিগন্যালের গেরোয় বার বার আটকে পড়তে হয় তাঁকে।
আর তাই রোটারি সদনের অনুষ্ঠানে অমর্ত্যবাবু বলেই ফেলেন, “আজ এই শহরে কয়েকটা অনুষ্ঠান রয়েছে আমার। এক-একটায় যাচ্ছি। কিছুক্ষণ সভাঘরে থাকছি। আর বেরিয়েই ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে থাকছি! এ ভাবেই দিনটা কাটবে!” |
|
মহানগরের পথে যানজটে আটক। দেবাশিস রায়ের তোলা ছবি। |
নোবেলজয়ীর এ হেন মন্তব্যের পরেই তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার কলকাতা ট্র্যাফিক পুলিশকে অনুরোধ করেন, বিকেলে সায়েন্স সিটি থেকে বেরিয়ে অমর্ত্যবাবুকে যেন আর যানজটে পড়তে না-হয়। কারণ, তখন তাঁর গন্তব্য হবে টাউন হল, যেখানে অপেক্ষায় থাকবেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এর প্রেক্ষিতে অমর্ত্যবাবুর জন্য রাস্তা জটমুক্ত করা হয়। যার জেরে আবার কিছুটা ভোগান্তি হয় সাধারণ মানুষের। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এ দিনই শহরের দু’প্রান্তে অবরোধ-বিক্ষোভ হয়েছে। পুলিশের খবর: দুপুরে এক যুবকের অপমৃত্যু ঘিরে ঘণ্টাখানেক রাজাবাজার মোড় আটকে রেখেছিলেন এলাকাবাসী। এতে শিয়ালদহ, মানিকতলা-সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যান চলাচল তালগোল পাকিয়ে যায়। অবরোধ ওঠার পরেও দীর্ঘক্ষণ গাড়ি চলে শামুকের গতিতে। উপরন্তু বিকেলে কসবায় দুই অটো ইউনিয়নের সংঘর্ষের জেরে এক ঘণ্টার অবরোধে স্তব্ধ হয়ে যায় ইএম বাইপাস। উল্লেখ্য, অমর্ত্যবাবু ওই সময়ে সায়েন্স সিটিতে ছিলেন। তবে পুলিশ তাঁকে নির্বিঘ্নে টাউন হলে পৌঁছে দিয়েছে।
কলকাতার পথে এ দিন কী অভিজ্ঞতা হল ওঁর?
পুলিশ-সূত্রের খবর: অমর্ত্যবাবুর নিরাপত্তায় সকাল থেকে পুলিশের পাইলট কার বহাল ছিল। সকাল পৌনে এগারোটা নাগাদ তাজ বেঙ্গল হোটেল থেকে বেরিয়ে ডিএল খান রোড-এজেসি বসু রোড ক্রসিংয়ে অমর্ত্যবাবুর গাড়ি মিনিট পাঁচেক দাঁড়িয়ে ছিল। বার বার ‘হুটার’ বাজিয়েও তা জট ছাড়িয়ে বেরোতে পারেনি। মিনিট পাঁচেক বাদে ফের বাধা। এ বার বিড়লা তারামণ্ডলের সামনের সিগন্যালে। মিনিট তিনেক ওখানে থমকে থাকতে হয়। এর পরে জওহরলাল নেহরু রোড হয়ে রোটারি সদন। পৌনে বারোটা নাগাদ রোটারি সদনের অনুষ্ঠান সেরে হোটেলে ফেরার পথে জিরাট আইল্যান্ডে বেলভেডিয়ার রোড- এজেসি বসু রোড ক্রসিংয়ে আবার আটকে পড়েন অমর্ত্যবাবু। সেখানেও যায় মিনিট তিনেক।
একের পর এক সিগন্যালে আটকে অমর্ত্যবাবু যেঅধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন, নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অফিসারদের কথায় তা স্পষ্ট। বস্তুত শহরের নিত্য যানজটে নিত্যযাত্রীরাও নাজেহাল। তাঁদের ভোগান্তির ছবিটা কেমন?
পুলিশ ও আম-নাগরিকের অভিজ্ঞতা বলছে, সায়েন্স সিটি থেকে পার্ক সার্কাস মোড় পর্যন্ত উড়ালপুলের কাজের জেরে ইএম বাইপাস কার্যত খোঁড়া হয়ে পড়েছে। সায়েন্স সিটি থেকে পার্ক সার্কাসমুখী বাইপাস কানেক্টরে ঢুকলেই গাড়ির গতি কমিয়ে ফেলতে হয়। নির্মাণকাজের জন্য কানেক্টরের দু’দিকের রাস্তা এখন সরু, তাই ধীর গতিতে চলা গাড়িগুলো আটকে পড়ে হিউজেস রোডের মোড়ে (যার ডান দিকে গোবিন্দ খটিক রোড, বাঁয়ে তপসিয়া রোড দক্ষিণ)। এর পরের হোঁচট মহেন্দ্র রায় লেন-তিলজলা রোডের মোড়। তার পরের দু’টো মোড় হল চার নম্বর ব্রিজে ওঠার আগে ও পরে। তবে এই চারটি মোড়ের প্রথম দু’টোতেই যানজটের সমস্যা সবচেয়ে প্রবল বলে পুলিশ-সূত্রে জানা গিয়েছে। উড়ালপুলের কাজ ছাড়াও ঠেলাগাড়ি-রিকশা-অটোর মতো ধীরগতির যানের দাপট এর বড় কারণ। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, সকাল-সন্ধের ব্যস্ত সময়ে সায়েন্স সিটি থেকে পার্ক সার্কাস মোড় পৌঁছতে হামেশা পৌনে এক ঘণ্টা লেগে যায়।
কেন এই অবস্থা? কলকাতা ট্রাফিক পুলিশের কর্তারা জানিয়েছেন, বিগত তিন দশকে কলকাতায় গাড়ির সংখ্যা পাঁচ গুণ বাড়লেও রাস্তার পরিমাণ তেমন বাড়েনি। রাজ্যের প্রাক্তন চিফ ট্র্যাফিক প্ল্যানার বিভাস সাধুর কথায়, “২০০০ সালের পরে শহরে বেশ ক’টা উড়ালপুল হয়েছে বটে, কিন্তু ট্র্যাফিকের সমস্যা মেটেনি। গাড়ির তুলনায় রাস্তাও খুব বাড়েনি। এখানে যান চলাচলের উপযোগী রাস্তা মাত্র ৬%। উড়ালপুলের সংখ্যা বাড়ালে কিছুটা সুরাহা হতে পারে।” মুশকিল আরও বাড়ছে সিগন্যালের সমস্যায়। শহরের ব্যস্ত রাস্তাগুলোয় গাড়ির গড় গতি এমনিতেই শ্লথ বড়জোর ২৫-৩০ কিলোমিটার। উপরন্তু লাল আলোর ফাঁদে বেশিক্ষণ আটকে থেকে সেগুলো জট আরও জটিল করে তুলছে। কলকাতা পুলিশের আওতাধীন এলাকার বিভিন্ন ট্র্যাফিক সিগন্যালে একটানা সর্বাধিক তিন মিনিট একই সঙ্কেত দেওয়া থাকে। যার দরুণ গাড়ির চাপ বেশি না-থাকলেও ‘অযথা’ নিয়মের কোপে পড়ে প্রায়শই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় বলে নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ। |
বাহন বাহুল্য |
|
|
|
|
|