|
|
|
|
আমিই ক্যানসারে আক্রান্ত সেই মুখ, নির্দ্বিধায় বললেন ‘বাল্মীকি’ |
ঈশানী দত্ত রায় |
প্রশ্ন: কখনও স্বপ্ন দেখেছিলেন এই রকম জীবন কাটাবেন?
উত্তর এল, “আমি তো স্বপ্নই দেখতাম না! খালি ভাবতাম, কখন পালাব। কিন্তু যে দিন ছাড়া পেলাম, বলেছিলাম, নাটকের প্রয়োজনে আমি জেলেই থেকে যেতে পারি। কারণ আমার আত্মা তখন মুক্ত। শরীর কোথায় থাকবে, সেটা বড় কথা নয়।” হল জুড়ে প্রবল হাততালি।
প্রশ্ন: নতুন প্রজন্মের জন্য আপনি কিছু বলবেন?”
উত্তর: লোভ কোরো না। যা পেয়েছো তাই নিয়ে খুশি থাকো।
আবার হাততালির ঝড়। কখনও বা উত্তর শুনে প্রবল হাসি।
জনপ্রিয় অভিনেতা বা খেলোয়াড়? লাইফস্টাইল গুরু? না। শুক্রবার দুপুরে আমেরিকান সেন্টারের লিঙ্কন রুমে কলকাতার ১২টি স্কুলের একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা আধ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে যাঁর সঙ্গে হাসল (হাসলেন তাঁদের শিক্ষিকারাও), কথা শুনে হাততালিতে ফেটে পড়ল, তিনি জেল খাটা আসামি। তোলাবাজি থেকে খুন, কী অভিযোগ ছিল না তাঁর বিরুদ্ধে? কিন্তু সেটাই তো শেষ নয়। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাক্তন ছাত্র নাইজেল আকারার সেই অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার গল্পই তো একটি তথ্যচিত্রে দেখেছে এবং শুনেছে এই পড়ুয়ারা। |
|
অলকানন্দা রায় ও নাইজেল আকারা। নিজস্ব চিত্র |
রূপান্তর: অন্ধকার থেকে আলোয় মার্কিন কনস্যুলেটের এ দিনের এই অনুষ্ঠানে মধ্যমণি দু’জন। নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়, এবং তাঁর ‘বাল্মীকি’ নাইজেল ওরফে ভিকি। নাচ-গান-নাটক কী ভাবে বন্দিদের জীবন বদলে দিতে পারে, তা অনুষ্ঠানের মূল বিষয় হলেও আসল গল্পটা ভালবাসার। এডিজি (কারা) বংশীধর শর্মার উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে বন্দিদের ‘ড্যান্স থেরাপি’ করাতে গিয়েছিলেন অলকানন্দা। সংশোধনাগারের সুপার বলেছিলেন, ২০-৩০ বছর বয়সীরা যেন নাচ শিখতে যায়। যারা গিয়েছিল, তাদের দেখে অলকানন্দার মনে হয়েছিল, এদের ‘‘হাত নেই, বাঁ পা বলেও কিছু নেই!” তাতে কী? অলকানন্দা বলেন, নাচের ছন্দ তো বুকের ভিতরে ধাক্কা দেয়। সেই শব্দকে জাগিয়েই বিভিন্ন সংশোধনাগারে বন্দিদের নিয়ে নাচের দল গড়েছেন তিনি। করিয়েছেন বাল্মীকি প্রতিভা। ‘বাল্মীকি’ নাইজেল আকারা। এক সময়ে পার্ক স্ট্রিটের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ গুন্ডা নাচতে হবে শুনে প্রশ্ন করেছিল, “গুন্ডাদের পায়ে ঘুঙরু বাঁধবেন, স্যার?” বংশীধর শর্মা যাঁকে বলেছিলেন, ‘ফল-দুধের মেডিক্যাল ডায়েট দেব, দু’ এক দিন দেরি করে সেলে ঢোকার অনুমতি মিলবে। শর্ত একটাই, নাচের ক্লাসে থাকতে হবে।’ দায়ে পড়ে পা মেলানো শুরু হলেও তা পৌঁছে যায় নাচের ছন্দ ভাল লাগায়। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্র সদনে মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাইজেল। “মনে হয়েছিল, আমি কি এ সবের যোগ্য?” তত দিনে অলকানন্দা অন্য বন্দিদের মতো তাঁরও মা, ভালবাসায় বদলে গিয়েছে জীবনটাই। বাল্মীকি প্রতিভার কাহিনী শুনে মনে হয়েছে, “এ তো আমার নিজের গল্প।” আজ নিজের ব্যবসা চালানো নাইজেল তাই বলতেই পারেন, “গুটখা ইত্যাদির বিজ্ঞাপনে দেখায় না? ক্যানসারে আক্রান্ত মুখ! আমি সেই মুখ। আমাকে দেখে লোকে যেন শেখে। আর অপরাধের দিকে পা না বাড়ায়।”
অপরাধপ্রবণতা থেকে ভালবাসাউত্তরণের এই গল্পে তবু একটি প্রশ্ন থেকে যায়। নাইজেলের কাজকর্মে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা কি ক্ষমা করতে পারবেন তাঁকে? করা সম্ভব? নাইজেল নিজেই বলেন, “না, তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি তাঁদের অনেকের সঙ্গেই যখন দেখা হয়েছে, বলেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যদি এখন কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারি, বলবেন। এক জনের ভাইকে বলেছিলাম, আমাকে যদি মারতে হয়, মারো। সে বলেছিল, বন্দি হিসেবে তুমি যা করেছো, তাতে আমাদের মাথা উঁচু হয়েছে।” যা শুনে বিড়লা হাই স্কুলের ঋষভ, অনিরুদ্ধ, প্রতীকরা বলে, “নাইজেলের কথা অন্যদের বলব। ধারণাই ছিল না, এমন কিছু ঘটতে পারে।” |
|
|
|
|
|