পানীয় জল থেকে সেচ, এমনকী বন্যা নিয়ন্ত্রণেও মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শহরের ভরসা কংসাবতীর অ্যানিকেত বাঁধ। অথচ প্রতি বছরই বর্ষায় ভেঙে পড়ে বাঁধটি। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে সংস্কার করা হয়। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ফের এক ছবি। কেন বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে? তা জানতে এ বার তদন্তের নির্দেশ দিলেন রাজ্যের নতুন সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া। তাঁর সাফ কথা, “তদন্তে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হবে, তাঁকে রেয়াত করা হবে না। তিনি যত বড় আধিকারিকই হোন না কেন। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শহরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে কাঁসাই নদী। মোহনপুরের কাছে বাস ব্রিজের ঠিক নীচেই রয়েছে অ্যানিকেত। ১৪১ বছর আগে তা তৈরি করেছিল ইংরেজরা। বর্ষায় জলের তীব্র স্রোত অ্যানিকেতে ধাক্কা খেয়ে কমে যায়। ফলে কংসাবতীর মূল বাঁধ ভাঙার আশঙ্কা থাকে না। আটকানো যায় বন্যার বিভীষিকা। গ্রীষ্মেও দুই শহরের মানুষের পানীয় জলের উৎস কংসাবতী। অ্যানিকেত থাকায় নদী শুকিয়ে যায় না। নদী তীরের পাম্প হাউস থেকেই দুই শহরের দুই পুরসভা পানীয় জল সরবরাহ করে। এমনকী বাঁধে ধরে রাখা জলের উপরই ডেবরা, কেশপুর, খড়্গপুর গ্রামীণ, মেদিনীপুর সদর ও পিংলা ব্লকের একাংশের সেচ নির্ভরশীল। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরেই অ্যানিকেত ঠিকমতো কাজে আসছে না। গ্রীষ্মে চাষিরা সেচের জল পাচ্ছেন না, দুই শহরে পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিচ্ছে, বর্ষায় বন্যা নিয়ন্ত্রণও হচ্ছে না। |
সেচ দফতর জানিয়েছে, ২০০৭ সালের বন্যায় প্রথম অ্যানিকেত ভেঙে পড়ে। তবে জলের স্রোতে তা ভেঙেছে, এ কথা বলা যায় না। ভাঙার প্রধান কারণ, প্রশাসনিক উদাসীনতা ও কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ। কংসাবতীর বুকে বহু বালি খাদান রয়েছে। বালি তুলতে তুলতে অবৈধ খাদান মালিকেরা একেবারে পৌঁছে যায় বাঁধের কাছে। ২০০৬ সালে সেচ দফতর ইটের তৈরি বাঁধের উপরে সিমেন্টের আস্তরণ দেয়। তার উপর দিয়েই বালি বোঝাই লরি যাতায়াত শুরু করে। একদিকে বালি তোলায় বাঁধের নীচের অংশ আলগা হয়ে যাচ্ছিল, সেই সঙ্গে বালি বোঝাই লরির চাপে বাঁধটি বসে যাচ্ছিল। ক্রমে বাঁধটি নড়বড়ে হয়ে যায়। তারপর ২০০৭ সালের বন্যায় ভেঙে পড়ে।
এখন প্রশ্ন দু’টি। যথেচ্ছ বালি তোলার ক্ষেত্রে কেন বিধিনিষেধ আরোপ করা হল না? কেনই বা লরি যাতায়াতের জন্য বাঁধের উপরে সিমেন্টের আস্তরণ ফেলা হল? সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ইংরেজ আমলে অ্যানিকেত বাঁধটি তৈরি হয়েছিল ইট দিয়ে। নদীগর্ভে বড় বড় কুয়ো খোঁড়া হয়েছিল। কুয়োর চার দিকে ইটের গাঁথনি। তার উপরেই আবার ইট গেঁথে বাঁধ তৈরি হয়। স্বভাবতই বাঁধের উপরের অংশে চাপ পড়লে (লরি যাতায়াতের ফলে যা পড়ছিল) ও নীচ থেকে বালি তুলে নিলে, বাঁধ ভেঙে পড়া অনিবার্য হয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন উদাসীনতা নিয়ে খোদ সেচমন্ত্রীই এ বার প্রশ্ন তুলেছেন। মানসবাবুর কথায়, “আমি জেলা প্রশাসনের কাছে রিপোর্ট চেয়েছি। ওই এলাকা থেকে বালি তুলে সরকার কত রাজস্ব পায়, তা জানতে চেয়েছি। সেই রাজস্ব গুরুত্বপূর্ণ ছিল নাকি বাঁধ, তা দেখা হবে। এর সঙ্গে কোন খাদান-মাফিয়া যুক্ত তা-ও খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আর বালি তোলা বন্ধে ওই এলাকার জন্য একজন অফিসার নিয়োগ করতে বলা হয়েছে। এরপরেও অবৈধ খাদান কী ভাবে চলে তা দেখব।”
বাঁধ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে আরও। ২০০৭ সালের বন্যায় অ্যানিকেত ভাঙার পরেই বাঁধের ২০০ মিটার নীচে ও ২০০ মিটার উপরের অংশ থেকে বালি তোলা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল প্রশাসন। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি বলেই প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে। ফলে, এখনও অবৈধ ভাবে যথেচ্ছ বালি তোলা চলছেই। এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক উদাসীনতার পাশাপাশি খাদান-মাফিয়াদের অশুভ শক্তির সঙ্গে প্রশাসনের একটি অংশের যোগ রয়েছে বলেও অভিযোগ। আর সে ক্ষেত্রে অভিযোগের তির মূলত সেচ দফতরের দিকেই।
|