|
|
|
|
|
|
|
অবাক মুলুক! |
সে যেন এক সব চেয়েছির দেশ। মন খোলা যৌনতায় শরীরের সম্মান। আবার কুকুরের আহ্লাদ
দেখলে হিংসেয় জ্বলে যেতে হয়। রান্নাঘরে তিনপেয়ে রণপা, গন্ধ ছড়ানো ঘড়ির অ্যালার্ম!
শখ তো হয় বটেই, কালচার শকও কম হয় না। লিখছেন স্বাতী ভট্টাচার্য
|
বেশ একটু বয়সেই প্রথম বিলেত গিয়েছিলেন তারাপদ রায়। মনে নতুন দেশ দেখার উত্তেজনা। পর দিন সকালে গৃহকর্ত্রীর প্রশ্ন, ‘সকালে জলখাবারে কী খাবেন? দুধ-মুড়ি না পেঁয়াজ-মুড়ি?’ ভারী দুঃখ পেয়েছিলেন ভদ্রলোক। এত দিনে বিদেশে এসে শেষে এই প্রশ্ন!
আমেরিকা যেতে গেলে এই ভয়টাই হয়। একেই তো এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার, যার কেউ-না-কেউ আমেরিকায় থাকে না। তায় আবার বিশ্বায়নের চোটে ওয়ান্ডারলুস্টের দফারফা অস্ট্রেলিয়ার ব্যুমেরাং, স্কটল্যান্ডের ব্যাগপাইপ, আমেরিকার স্ট্যাচু অব লিবার্টি, যারই খুদে সংস্করণ কিনতে যান সবই ‘মেড ইন চায়না।’ শপিং মলে সবই পরিচিত ব্র্যান্ড, টুথপেস্ট থেকে জিন্স-জুতো অবধি। রাস্তার দু’ধারে ভারতীয় রেস্তোরাঁ, ইন্ডিয়ান স্টোরে সুপুরি থেকে ফুলঝাড়ু সব মিলবে। ‘অচেনার আনন্দের’ রস ঘন হয়ে ওঠার আগেই জ্বাল কেটে যেতে চায়। যে বিস্ময়ের খোঁজে এত দূরে আসা, যার ছোঁয়াতে দৈনন্দিনতার গ্লানি কেটে যায়, পৃথিবী তার রং-রূপ নিয়ে ঝলমল করে ওঠে আবার, সে কি পাওয়া যাবে? ছেলেবেলা থেকে টি ভি আর সিনেমায় একটা দেশ দেখে আসার পরেও কি বিস্ময়ের ধাক্কা হতবাক করে দিতে পারে? যাতে মনে হয়, কই এমন তো কখনও দেখিনি?
|
ছ’রঙা রামধনু |
হয় বই কী। স্যান ফ্রান্সিসকোর রাস্তায় রাস্তায় দেখি নিশান উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাতে রামধনুর রং, তবে সাতটি নয়, ছ’টি। সেই উজ্জ্বল রঙিন পতাকা একের পর এক ল্যাম্পপোস্ট, বাড়ির ছাদ, দোকানের জানলা, পেট্রল পাম্পের পিলার থেকে উড়ে চলেছে হাওয়ায়। শহরের যেটা ‘ডাউনটাউন’ মানে অফিস এলাকা, শৌখিন দোকান-বাজারে সজ্জিত ব্যস্ততম অংশ, তা ছয়-রঙের নিশানে ছয়লাপ। গোটা অঞ্চলটা জুড়ে যেন উৎসব। কাদের পতাকা? কেনই বা সাতের বদলে ছ’টা রং? জানা গেল, ইংরেজির ‘6’ উল্টে দিলে ‘g’ অক্ষরটির মতো দেখায়, যা ‘গে’ শব্দের আদ্যাক্ষর। এই রামধনু পতাকা সমকামী মানুষদের অধিকারের ঘোষণা। যাঁরা এই পতাকা উড়িয়ে দিয়েছেন নিজেদের বাড়ি, দোকান, দফতর, রাস্তার বাতিদানে, তাঁরা সবাই সমকামীদের সমর্থক। |
|
বিস্ময়টা কেবল যৌনতার অধিকার নিয়ে এমন জোরদার তদ্বিরের জন্য নয়। কে না জানে, সমকামীদের বিরোধিতাও আমেরিকায় কিছু কম নেই। কিন্তু সেই বিরোধিতাটা ধমকে চুপ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা নয়। দু’পক্ষের জন্যই খোলা জমি রয়েছে, লড়াই করে জেতো, নইলে ম্যানেজ করে নাও। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে নারীদিবসের আয়োজন হয়েছে। এক তরুণী ছাত্রী, তার রং বাদামি, চুল কোঁকড়ানো, বেশ বিপন্ন ভাবে বলছিল, ‘কী মুশকিল দেখুন, আমি লেসবিয়ান জানার পর থেকে আমার মা আমাকে হুমকি দিচ্ছে, দেখো তোমার জন্য তোমার ছোট বোনের মাথাতেও না ও সব ঢোকে। এ দিকে বোনও যে লেসবিয়ান আর আমার চেয়ে ঢের বেশি মেয়ে-সঙ্গী জুটিয়েছে, মাকে বোঝাবে কে?’ অধ্যাপক-অভ্যাগত সবাই মাথা নাড়লেন, তাই তো! এক দিন দিব্যি ‘এল এইচ বি টি ডান্স নাইট’ হয়ে গেল ইউনিভার্সিটিতেই। লেসবিয়ান, হোমোসেক্সুয়াল, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সসেক্সুয়াল যা-ই হও না কেন, তোমার পছন্দের সঙ্গীটিকে নিয়ে এসো, নাচ করে যাও। এমনকী ইউনিভার্সিটির নিজস্ব কাগজ ‘দ্য টেক,’ যা ছাত্ররাই বার করে, সেখানে কোন সঙ্গীর কেমন আদর ভাল লাগতে পারে, আর তার জন্য কী ভাবে তৈরি হবে, তার টিপস দেওয়া রয়েছে। গোটা ব্যাপারটার মধ্যে একটা স্বাচ্ছন্দ্য, সাবলীলতা রয়েছে, যা ভাল-মন্দ, ঠিক-ভুলের খুচরো বেড়াগুলো ঠেলে সমাজ-রাজনীতির খোলা জমিতে দাঁড় করিয়ে দেয়। এ বার তুমি বুঝে নাও। গোটা কতক ধাক্কা খাওয়ার পর সব সহজ হয়ে যায়। এই যেমন খোশগল্প করতে করতে সহকর্মী প্যাট্রিককে প্রশ্ন করলাম, ‘গরমের ছুটিতে কোথায় যাচ্ছ?’ প্যাট্রিক দিব্যি হাতের সোনার সরু আংটিখানা দেখিয়ে বলল, ‘আমার হাজব্যান্ড থাকে ডেলাওয়্যারে, তার সঙ্গে ছুটি কাটাতে যাব।’ কত স্বাভাবিক মনে হল ব্যাপারটা।
কী হয়, কী হয় না, সেই খোপে-ভরা চিন্তাগুলো নেড়েঘেঁটে যাওয়াটাই তো ‘কালচার শক’। এক সেপ্টেম্বরের দুপুরে দেখি কেমব্রিজের রাস্তায় চলেছেন ক্যারিবিয়ান মানুষেরা। সেদিন ছিল তাঁদের কার্নিভাল। নাচ-গান শেষে দলে দলে ফিরছে, ছোট ছেলেমেয়ে থেকে যুবক-যুবতী, পরনের ঝকঝকে বাহারি পোশাক সাঁতার-কাটার পোশাকের মতোই, তবে তাতে অনেক পালক, চুমকি, জরি, পায়ে জালের স্টকিং, কিংবা হাঁটু অবধি চকচকে জুতো, মাথার সাজও জম্পেশ। ক্যারিবিয়ান মেয়েরা মোটেই ফ্যাশান মডেলদের মতো প্যাঁকাটি-পানা নয়, রীতিমতো গুরুনিতম্বিনী, ঘনোদরা, বিপুলজঘনা। ছ’সাত জন সখী যখন কার্নিভালের পোশাকে সদর্পে পা ফেলে হেঁটে যায় রাস্তা দিয়ে, চারিদিক যেন কাঁপতে থাকে, আর সেই মহাসমারোহ বুঝিয়ে দেয়, যৌনতা কেবল অন্যকে আকর্ষণ করার ব্যাপার নয়। এ হল জীবনের একটা সেলিব্রেশন, নিজেকে নিয়ে নিজের উৎসব। গোপন করার আছেই বা কী? ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে মায়েরা চলেছেন, ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বড় দাদা-দিদিরা, সকলেই খোলামেলা, স্বচ্ছন্দ, সুন্দর। টিভিতে যা দেখা যায়, যেখানে কার্নিভাল মানেই উত্তেজক নাচ, তাতে বড় ভুল বোঝা হয়। যেমন লাস ভেগাস বললেই অবাধ অশ্লীলতা ভাবলে ভুল হয়। সত্যিই সেখানে বিশালাকার হোর্ডিং থেকে খোলা রাস্তায় জ্যাজগানের মাচান, সর্বত্র মেয়েদের দেহের বৈভব দেখে চোখ সরতে চায় না। হঠাৎ খেয়াল হতে পারে, অনেকক্ষণ নিশ্বাস নেওয়া হয়নি। কিন্তু এর কোনওটা দেখে কেউ বিরক্তিতে বিবাগী হয়ে চলে যাবে, তার সম্ভাবনা নেই। এই সৌন্দর্যের একটা মর্যাদা রয়েছে, আর তা ওরা দেয়ও। হলিউড বুলেভার্ডে একটা পোশাকের বুটিকের সামনে খুব ভিড়, লাইন করে সবাই অটোগ্রাফ নিচ্ছে, ঘনঘন ফ্ল্যাশ লাইট। কী ব্যাপার? ‘অ্যাডাল্ট স্টার’ এক তরুণী আজ এসেছেন সেখানে। তার ভক্তের দলে কোনও জাত-জেন্ডার-জন্মসাল বাদ নেই। ‘বেশি বেশি’ বলে একে ছোট করে দেখাও চলে না। যৌনতার প্রকাশে যখন গিঁট বাঁধা থাকে না, তখন অন্য কোনও গাঁটে চিন্তাকে আটকে
রাখা শক্ত।
দেখেশুনে মনে হয়, ‘এমন আবার হয় নাকি’ বলে পদে পদে এত বার হোঁচট না খেলে আমরাও কি নিজেদের মত স্পষ্ট বলে দেওয়ার জন্য পতাকা ঝোলাতে পারতাম? ঘুষখোরদের ধিক্কার দিয়ে সাদা-কালো পতাকা, বাসে-ট্রেনে মেয়েদের উপর অসভ্যতার প্রতিবাদে হলুদ-নীল, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অকর্মণ্যতাকে ব্যঙ্গ করে ধূসর? আহা, শহরের গলিতে গলিতে তা হলে দেখা যেত মতামতের রং। ‘অই গ্রিন আর রেড স্ট্রাইপ ফ্ল্যাগটা কীসের বল তো প্যালা?’ ‘টেনিদা, ওটা নির্ঘাৎ পায়ে-হাঁটা পাবলিক লাগিয়েছে, ট্রাফিক লাইট তিন সেকেন্ডে সবুজ থেকে লাল হয়ে যাওয়ার প্রোটেস্ট।’ ‘চোপ, ওটা পাঁঠাপ্রেমীদের পতাকা, পটলডাঙার বাজারে মাংস সাড়ে তিনশো টাকা কেজি হয়ে যাওয়ায় ভেজিটেরিয়ান হয়ে যেতে হচ্ছে বলে, বুঝলি?’ পার্টির পতাকাগুলো তখন নানা রঙের রাশি রাশি পতাকার মধ্যে কেবল একটা-দুটো রং হয়ে থাকত। শহর হত নাগরিকের। ডি লা গ্র্যান্ডি!
|
কার স্ট্যাচু? |
শহর যখন নেতাদের, তখন মোড়ে মোড়ে নেতাদের মূর্তি, নয় শহিদের স্মৃতিফলক। শহর যখন নাগরিকের, তখন পাদপীঠেও দাঁড়িয়ে নাগরিকরা। বস্টনের স্ট্যাচুগুলোর পরিচয় পড়লে রীতিমতো চমক লাগে ইনি নৌবাহিনীর ইতিহাস লিখেছিলেন, উনি ছিলেন নামজাদা প্রতিকৃতি শিল্পী, এই সৌধ ইথার আবিষ্কারের আনন্দে। নারী অধিকারের জন্য লেখালিখি করেছেন, এমন তিন মহিলা ব্রোঞ্জে ঢালাই হয়ে বসে কমনওয়েলথ অ্যাভিনিউ মলের মাঝখানে। দু’চারখানা ঘোড়ায় চড়া মূর্তি যে নেই তা নয়। তবে কলকাতায় তাঁদেরই চোখে পড়ে বারবার যাঁরা গুলিতে বা ফাঁসিতে প্রাণ দিয়েছেন, আর বস্টন-কেমব্রিজের পাদপীঠের মানুষগুলো বেশির ভাগই নিরুপদ্রব নাগরিক জীবনে দেশের জন্য কাজ করে গিয়েছেন। কেমব্রিজের সেন্ট্রাল স্কোয়্যারে একটি ছোট্ট পার্ক জিল ব্রাউন-রোনের নামে। তিনি ছিলেন পুলিশ অফিসার। পুলিশের নামে পার্ক, নার্সের নামে বাস স্ট্যান্ড, দমকলকর্মীর জন্য ফোয়ারা যাঁরা আমাদের জীবনে সবচেয়ে জরুরি, তাঁদের সম্মান করার কথা এখানে কেন ভাবা যায় না?
অবশ্য একে অন্যকে সম্মান করার অভ্যাসটাও আমাদের নেহাত কম। এই যে আমরা সব্জিওয়ালার সামনে দাঁড়িয়ে ‘কত করে?’ বলে কথা শুরু করি, এক জন আমেরিকানের কানে সেটা কেমন শোনায় কে জানে। ও দেশে মুদির দোকান, ফলের দোকান যেখানেই যান না কেন, ‘হাই, হাউ আর ইউ টুডে,’ না বলে কেউ কথাই শুরু করবে না। কাজ শেষ হলেও ‘হ্যাভ আ গুড ডে’ না বলে যাওয়া চলবে না। এই অভিবাদনের প্রথাটা অনেকটাই স্রেফ লোক-দেখানো, এমনতরো ‘কেমন আছেন?’-এর উত্তরে, ‘আর বলবেন না, অম্বল যা ভোগাচ্ছে, দাঁতটাও কাল থেকে কনকন করছে’ বলে শুরু করা যাবে না আদপেই। উত্তর শোনার লোকটা ততক্ষণে চলে গিয়েছে করিডরের অন্য প্রান্তে। তবু শিষ্টাচারটুকু ভুলতে দেয় না, সামনের মানুষটি সম্মানের যোগ্য।
পাবলিক যে ফেলনা নয়, সেই বোধ থেকেই বোধ হয় পপ কালচার জিনিসটাও ভারী সমাদর পায় ও দেশে। কেবল স্যুপ-ক্যানের লেবেল জুড়ে যে একটা আর্ট ওয়ার্ক হতে পারে, যেমন বানিয়েছেন অ্যান্ডি ওয়রহল, তা না দেখলে মালুম হয় না। বিশ্ববিখ্যাত নানা আর্ট মিউজিয়ামে ‘এই সময়ের শিল্প’ বলে রাখা আছে হাই-হিল জুতো, জামা, ব্যাগ। এগুলো শিল্প কেন? নয়-ই বা কেন? সবাই ব্যবহার করছে বলে তার মর্যাদা কি কমে যায় নাকি? ইউরোপের শহর দেখাতে চায় প্রাসাদ, কেল্লা, রাজকীয় বৈভব। ওয়াশিংটন-নিউ ইয়র্কের মিউজিয়মে তেমন তৈরি করে রাখা হয়েছে নানা সময়ে সাধারণ মানুষের শোবার ঘর, বসার ঘরের চেহারা। মনে দাগ কেটে যায় এক বৃদ্ধের ঘরের ইনস্টলেশন অবিন্যস্ত ঘর, বেসিনে এঁটো ডিশ-চামচ জমে রয়েছে, জানলার ওপারে শহর, বয়স্ক মানুষটি সরু বিছানায় স্বমৈথুনরত, সামনে খোলা একটি ম্যাগাজিন। একাকীত্বের করুণতা? বার্ধক্যের চলতি ইমেজকে চ্যালেঞ্জ?
|
সোনালি যৌনতা |
|
বাড়িউলি ফ্রান্সেসের বয়স তিরাশি। আমার কর্তামশাই সে দেশে বেড়াতে যেতে সৌজন্যবশত আলাপ করাতে যাওয়া গেল। এটা-ওটা কথার পর যখন ওঠার সময়, তখন ফ্রান্সেস তাঁর কনুইটি ধরে বললেন, ‘উঠছ তা হলে? আচ্ছা এসো, তবে এই ভদ্রলোককে রেখে যাও।’ সঙ্গে দারুণ দুষ্টুমির একটা হাসি। বার্ধক্যের সঙ্গে যৌনতার যে কোনও বিরোধ নেই, ওদের বৃদ্ধাদের দেখে তা বেশ মালুম হয়। আমাদের দেশে দু’চারটি ছবিতে যদি বা প্রৌঢ় পুরুষদের যৌনতার স্বীকৃতি এসেছে, মেয়েদের নিয়ে তেমন কোনও কথা হয়নি বললেই চলে। আর ফ্রান্সেস চার্চে গিয়ে ফাদারদের সঙ্গে অবাধে হরকত করেন ‘কী ব্যাপার, এ-দিকে দেখছ না? আমার পারফিউমটা কি পছন্দ হচ্ছে না?’ উত্তর না দিলে জামা ধরে ঝুলোঝুলি করেন। রোম্যান্স জিনিসটার কোনও বয়স নেই। ক্রিসমাসের শপিং করতে গিয়ে কানে ভেসে আসে, ‘আচ্ছা, এটা কি আমার গ্র্যান্ডমা-র বয়ফ্রেন্ডের জন্য ভাল হবে তোমার মনে হয়?’ তাই ও দেশে বাজারও অন্য রকম টিন এজ রোম্যান্সের চাইতে ‘কিংস স্পিচ’-এর মতো পরিণত রসের ছবি হিট হয় বেশি, জর্জ ক্লুনি বা শ্যারন স্টোনের মতো মধ্যবয়সী নায়ক-নায়িকারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, কারণ সিনেমা হলে গিয়ে টিকিট কেটে ছবি দেখার মতো টাকা আর সময় রয়েছে পঞ্চাশ-পেরোনো মানুষদের হাতে।
বার্ধক্যে বিনোদনের তীব্র চাহিদার জন্য করে খাচ্ছে ক্যাসিনোগুলো। ফিলাডেলফিয়া থেকে বাস ছাড়ে আটলান্টিক সিটির জন্য। সেখানে মস্ত হোটেলে ক্যাসিনোর রমরমা। আমাদের বাসে দেখা গেল, যাত্রীরা প্রায় সকলেই সত্তর ছাড়িয়েছেন, যদিও প্রাণশক্তিতে ভরপুর। ওঁদের কথার্বাতা, এ ওর পিছনে লেগে হইহই করে হেসে ওঠা, উজ্জ্বল সাজগোজ সব কিছুর মধ্যে একটা ‘হাম কিসিসে কম নেহি’ ভাব। আন্দ্রে জিদ লিখেছিলেন, যৌনতা থেকে মুক্তি পেয়ে বার্ধক্য আরও সুন্দর হয় ভাবাটা তেল ফুরিয়ে আসলে প্রদীপ আরও উজ্জ্বল হবে মনে করার সামিল। যখন দেখি যে নাকে অক্সিজেনের নল, এক হাতে লাঠি, অন্য হাতে চাকা-দেওয়া অক্সিজেন সিলিন্ডার টেনে এক বৃদ্ধ চলেছেন ক্যাসিনোয় সারাদিন স্লট মেশিন খেলার আগ্রহে, মনে হয় সত্যিই তো। যৌনতার নেশা হোক বা জুয়ার নেশা, এই ঘোরটুকু না থাকলে বাঁচাই মুশকিল।
|
পিঠ যদি চুলকোয় |
অন্য নেশাটা শপিং। যাঁরা স্পার্টান লাইফস্টাইল মেনে চলে ‘গোল্ডেন কমণ্ডলু’ অ্যাওয়ার্ড আশা করেন, তাঁরা প্লিজ আমেরিকা যাবেন না। এ দেশে জিনিসের দরকার হলে আমরা বাজার যাই। ও দেশে গেলে বোঝা যায়, সেই জিনিসটাই কিনে মজা যেটা দেখলেই মনে হয়, আরে, এটাই তো আমার দরকার ছিল! উদাহরণ চাই? বেশ, ধরুন পিঠ চুলকোনো। পিঠ কার না চুলকোয়, কিন্তু পৃষ্ঠস্ক্র্যাচকারী যদি বা পাওয়া যায়, ঠিক কোনখানটা চুলকোচ্ছে কিছুতেই বোঝানো যায় না। ‘একটু বাঁ দিকে, আর একটু উপরে, না না অতটা না’ এমন করে গাইড করেও ঠিক জায়গায় তার নখটি পৌঁছয় না। এ বার ধরুন আপনার হাতে রয়েছে একটা গ্রাফ কাগজ, ঠিক আপনার পিঠের মাপের। আর আপনার পিঠের উপরেও ফেলা আছে ঠিক তেমনি একটা কাগজ। এখন আপনি স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন, ‘ঠিক ডি ১৬-র মধ্যিখানটা, হ্যাঁ হ্যাঁ, এ বার একটু সি-৬ এ যা দেখি।’ বলুন, এমন এক সেট গ্রাফ কাগজ আপনার দরকার ছিল না? কিংবা একজোড়া তিন-ঠ্যাঙের রণপা, যা পরে আপনি আলমারির মাথা, রান্নাঘরের উপরের দিকের তাক, সব পরিষ্কার করতে পারেন? খাবারের গন্ধ নাকে এলে যেমন খিদে টের পাওয়া যায়, ফুরফুরে হাওয়া দিলে যেমন টের পাওয়া যায় কপালে বিনবিনে ঘাম জমেছিল, তেমনই ঠিক জিনিসটি দোকানে দেখলে মনে পড়ে যায় কীসের অভাব ছিল জীবনে, কীসের অস্বস্তি।
শপিং ক্যাটালগ পড়া ও দেশে টি ভি সিরিয়াল দেখার চেয়ে কম পপুলার নয়। আর কী সব ক্যাটালগ! জানতেন কি ‘দ্য অরিজিনাল স্লিপ সাউন্ড জেনারেটর’ বলে কিছু আছে? একটা গোল, সাদা, আভেন টাইপ যন্ত্র, যা থেকে এমন একটা সুদিং ‘হুশশশ’ শব্দ বেরোবে সারারাত, যে সমস্ত স্নায়ু ঢিলে হয়ে গিয়ে, শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন আপনি, গ্যারান্টি! অফিসে রাখলেও মন্দ নয়, কলিগদের বাঁকা কথা, চাপা হাসি ফিল্টার করে দিচ্ছে। মানবজাতির শত্রু অ্যালার্ম ক্লক সকালবেলায় বিদঘুটে আওয়াজ করে বেজে উঠে দিনটাই খারাপ করে দেয়। কিন্তু এমনও ঘড়ি আছে, যাতে প্রথমে জ্বলবে হালকা একটা আলো, যা পরের আধ ঘণ্টায় একটু একটু করে বাড়বে। তার পর সুগন্ধী ‘অ্যারোমাথেরাপি’র তেলের সুবাস ভাসবে হাওয়ায়। তার পর প্রকৃতির নানা মধুর শব্দ এক এক করে বাজবে, কয়েক মিনিট অন্তর, মোট ছ’বার। এত কিছুর পর যখন ঘণ্টি বাজবে, তখন নিশ্চয়ই আপনার রাগ হবে না। বাড়ির সামনে পাপোশ রাখতেই হয়, কিন্তু তাতে যদি নিজের বাড়ির ল্যাটিচিউড-লংগিচিউড বোনা থাকে? মাত্র কয়েক ডলারে (খুব কম নয় অবিশ্যি গোটা পঞ্চাশেক ডলার তো হবেই) এমন জিনিসের হোম ডেলিভারি পাওয়া গেলে মনে হবে, এত দিনে নিজের অবস্থানটা বোঝা গেল। কী পাওয়া যেতে পারে, তা না জেনেই আমাদের চাহিদাগুলো ঠিক করা হয়ে গিয়েছে। যখন জানা যায় যে বেবিকে ঠেলে হাঁটতে হলে এক রকম প্যারামবুলেটার কিনতে হয় আর গাড়ি ঠেলে জগিং করতে হলে আর এক রকম, তখন জীবনটাই একটু অন্য রকম দেখায়।
সেই দৃষ্টিতে আমেরিকার মানুষের চেয়ে ভাগ্যবান যদি কেউ হয়, সে আমেরিকার কুকুর। তার জন্য রয়েছে আলাদা পার্লার, স্পা, তার নখ কাটা, চুল কাটা, শ্যাম্পু-পার্মিং সব কিছুর এলাহি ব্যবস্থা। এ দেশে কুকুর ট্রেনিং নেয় মানুষের কাজ করতে, ও দেশে কুকুরের জন্য ট্রেনিং নেয় মানুষ। তার জামা-জুতোর আলাদা দোকান, তার খাবারে নানা ফ্লেভার, তার পটি-ট্রেনিং-এর জন্য তিনটি বিশদ নির্দেশিকার সিডি-সহ হাইজিনিক ক্রোম-ফিনিশ টয়লেট মজুদ আছে। যদি এখনও না গিয়ে থাকেন আমেরিকায়, তা হলে খেয়াল রাখবেন যে ও দেশে কারও ছোট্ট শিশুকে দেখে ‘ও মা, কী সুইট, পুচুপুচুপুচু’ বলা নেহাত অসভ্যতা, গাল টিপে দিলে জেলও হতে পারে। কিন্তু কুকুরকে দেখে একলাফে ও ফুটপাথ থেকে এ ফুটপাথে এসে তার পিঠ-গলা-মাথায় হাত বুলিয়ে যত ইচ্ছে আদর করা যায়। কুকুরের মালিক বিনয়ের সেলোফেনে গর্বটি মুড়ে তার কুকুরের অসাধারণ গুণপনার ব্যাখ্যা শোনায়, যেমন এ দেশের মায়েরা নার্সারির ছানাদের ব্রিলিয়ান্সের গল্প করে, ‘ও তো হন্ডুরাস স্পেলিং-ও বলে দিল, আন্টি অবাক!’
যেখানে শিশুরা স্কুল ছাড়লেই বাড়ি ছাড়ে, আর কুকুরকে আরও জায়গা দিতে মানুষ বাড়ি বদলায়, সে দেশই হল আমেরিকা। |
|
|
|
|
|