ভোট অন অ্যাকাউন্ট দু’মাসের
কর্মসংস্থানে নজর রেখেই উৎসাহ ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পে
রাজ্যের এক কোটি বেকারের কর্মসংস্থানের লক্ষ্য সামনে রেখে আর্থিক পরিকল্পনা তৈরি করতে চায় বর্তমান সরকার। আর সেই উদ্দেশ্যেই শুক্রবার বিধানসভায় অগস্ট ও সেপ্টেম্বর, আপাতত দু’মাসের ‘ভোট অন অ্যাকাউন্ট’ পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র। তাতে বরাদ্দ হয়েছে ১১,১৬৫ কোটি ৬২ লক্ষ ২২ হাজার টাকা।
এই কারণে সাধারণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে উৎসাহিত করে রাজ্য জুড়ে ১৭টি ‘ক্লাস্টার’ চিহ্নিত করা হয়েছে। ভবিষ্যতে সেখানেই ব্যাপক উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা আছে বলে অর্থমন্ত্রীর দাবি। তিনি বলেন, “রাজ্যের ৫৬ হাজারেরও বেশি কারখানা বন্ধ। এটাকে জাতীয় কলঙ্ক বলা যেতে পারে।”
এ দিন সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার সুযোগে আগের বামফ্রন্ট সরকারের আর্থিক নীতিকে আক্রমণ করেন অমিতবাবু। তাঁর অভিযোগ, আগের সরকার এক দিকে যেমন ভাঁড়ার শূন্য করে রেখেছে, তেমন শিক্ষা ক্ষেত্রেও অব্যবস্থা চরমে।
বিধানসভায় অর্থমন্ত্রী।-নিজস্ব চিত্র
তিনি বলেন, “রাজ্যের ২০ হাজার স্কুলে ছাত্রীদের শৌচাগার নেই। স্বাভাবিক ভাবেই স্কুলছুট ছাত্রীর সংখ্যা বেড়েছে। মিড-ডে মিলের ৫৭ হাজার রান্নাঘর তৈরি হয়নি।” তিনি জানান, রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে মাত্র এক বছরে বিগত সরকার ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি দেখিয়েছিল। ২০১০-’১১ সালের সঙ্গে তুলনা করে এটা দেখানো হয় ২০১১-’১২ সালের প্রথম চার মাসের ভোট অন অ্যাকাউন্টে। তাঁর কথায়, “এটা অবাস্তব। অসঙ্গতিপূর্ণ।” ফলে সেটা কার্যত বাতিল করে নতুন করে ভোট অন অ্যাকাউন্ট প্রস্তুত করতে হয়েছে বলে জানান তিনি। অন্য দিকে, বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অর্থমন্ত্রীর ভোট অন অ্যাকাউন্টের সমালোচনা করে বলেন, “এতে কোনও আর্থিক বিবরণী নেই। যা প্রতিটি বাজেটে থাকা কার্যত বাধ্যতামূলক। এ ক্ষেত্রে সেটা না-থাকায় বোঝা মুশকিল, কোথা থেকে কত অর্থ সংগ্রহ করা হবে। কোথায় কী খরচ করা হবে।” মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেছেন, রাজ্যের এই দেউলিয়া আর্থিক পরিস্থিতির জন্য ৩৪ বছরের বাম শাসনই দায়ী। এ প্রসঙ্গে সূর্যবাবু বলেন, “উনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করার কথা বলেছেন। উনি করুন। আমরা তা দেখতে চাই। তবে উনি যে ইতিমধ্যেই শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছেন, আর্থিক বিবরণীর সাদা পাতা দেখেই তা বোঝা যাচ্ছে!”
অর্থমন্ত্রীর বাংলা বক্তৃতাকে কটাক্ষ করে সূর্যবাবু বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ করব, ওঁকে ভাল করে সহজ পাঠ পড়তে বলুন। কোনও অসুবিধা নেই। কারণ, আমরাও হিন্দিভাষী এলাকায় গেলে কথা বলার জন্য হিন্দি ভাষা শিখি।”
এ দিন বক্তৃতার সময় সরকার পক্ষের বেঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী এবং অন্য বেশ কয়েক জন মন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের উদ্দেশে মন্তব্য করতে থাকেন। সেই প্রসঙ্গ তুলে সূর্যবাবু বলেন, ‘‘আমরা ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিলাম। কখনও দেখিনি, কোনও মন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে কিছু বলছেন! বরং সরকার পক্ষের অন্য সদস্যেরা চিৎকার করলে মন্ত্রীরা তাঁদের সংযত করেন। এটাই প্রথা। আগামী দিনে যাতে এমনটা হয়, তা দেখতে স্পিকারকে অনুরোধ করছি।” অমিতবাবুর দু’মাসের আর্থিক বিবরণীতে প্রধানত ন’টি বিষয়ের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে।
সেই মুহূর্ত: ভোট অন অ্যাকাউন্ট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রীর উদ্দেশে উড়ে আসে বিরোধী পক্ষের
টিপ্পনী। তাতেই রেগে যান মুখ্যমন্ত্রী। বিধানসভায় শুক্রবার অশোক মজুমদারের তোলা ছবি।
তার মধ্যে আছে দারিদ্রসীমার নীচের বাসিন্দাদের চাল সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের কথা। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্প, অখণ্ড নগর উন্নয়ন প্রকল্প, গ্রামীণ পানীয় জল প্রকল্প, সর্বশিক্ষা ও মাধ্যমিক শিক্ষা অভিযান, মিড-ডে মিলের জন্যও অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দের উল্লেখ রয়েছে। পূর্ব-পশ্চিম মেট্রো প্রকল্পের জন্যও অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। এই তালিকায় আছে জঙ্গলমহল, পার্বত্য অঞ্চল, সুন্দরবনও। পরে সাংবাদিক বৈঠকে অর্থমন্ত্রী জানান, বিগত কয়েক বছরে তখনকার রাজ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা যথাযথ ভাবে খরচ করে কেন্দ্রের কাছ থেকে যত টাকা পেতে পারত, তা পায়নি। এটা বিগত সরকারের ব্যর্থতা বলে মন্তব্য করে অমিতবাবু বলেন, “কেন্দ্র থেকে আরও বেশি অনুদান পাওয়ার লক্ষ্যে আমাদের ভোট অন অ্যাকাউন্টে রাজ্যের আর্থিক আনুপাতিক বরাদ্দ ২২০০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, “আর্থিক বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন্দ্রের সঙ্গে বারবার আলোচনা করছেন। যোজনা কমিশনের সঙ্গেও কথা হয়েছে তাঁর। রাজ্যের আর্থিক অবস্থার নিরিখে কেন্দ্র সহানুভূতিশীল অবস্থান নেবে বলে আমরা আশা করছি। ঘাটতি বাজেট থেকে কী করে বেরিয়ে আসা যায়, তার রাস্তা খোঁজা হচ্ছে। কিন্তু নগদ যে-ঘাটতি রয়েছে, কী করে তার সমাধান করা যায়, তা নিশ্চিত হয়নি।” কেন্দ্র যে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে রাজ্যকে বিশেষ অনুদান দিতে পারে, তারও উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
চলতি আর্থিক বছরে কেন্দ্রের কাছ থেকে ১৭৮০০ কোটি টাকা ঋণ পেতে পারে রাজ্য। তার মধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকা নিয়েছিল আগের বাম সরকার। তিন হাজার কোটি টাকা নিয়েছে নতুন সরকার। অমিতবাবুর কথায়, “রাজ্যের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে পারলে এই ঋণ পাওয়ার ক্ষমতাও বাড়বে। আমরা সেই চেষ্টাও করছি।” তাঁর মন্তব্য, ইন্টারনেটের মাধ্যমে কর আদায়ে জোর দিলে এবং কর ফাঁকি আটকাতে পারলে রাজ্য লাভবান হবে।
অমিতবাবু বলেন, “একটা বাজেট পেশ করার জন্য কমপক্ষে তিন মাসের প্রস্তুতি লাগে। আমরা সেই সময় পাইনি। তাই দু’মাসের জন্য এই ভোট অন অ্যাকাউন্ট পেশ করা হল। এর ফলে কিছুটা সময় পাব।”
বিধানসভায় সূর্যকান্ত মিশ্র। -নিজস্ব চিত্র
প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অসীম দাশগুপ্ত মন্তব্য করেন, যোজনা কমিশনের সঙ্গে সম্প্রতি রাজ্যের আলোচনার ভিত্তিতে যে-যোজনা ঠিক হয়েছে, তার কতটা কেন্দ্রীয় প্রকল্প খাতে, কতটা কেন্দ্রের অনুদান বা ঋণ মকুব খাতে পাওয়া যাবে এবং কতটা রাজ্য সরকারকে দিতে হবে, ভোট অন অ্যাকাউন্টে তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা থাকলে ভাল হত। অসীমবাবু জানান, গত বছর রাজ্যের যোজনা বরাদ্দ বেড়েছিল ২৭ শতাংশ। এ বার বেড়েছে ২৩.৬ শতাংশ।
অসীমবাবু বলেন, “নতুন অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বামফ্রন্ট সরকার ৩৯ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির ব্যাপারে যা বলেছে, সেটা অনেক বাড়িয়ে বলা হয়েছিল। অথচ বর্তমান সরকারও বাস্তবে ৩০ শতাংশ রাজস্ব বৃদ্ধির কথা বলেছে।” বাকি যে-নয় শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল, তারও একটি হিসেব দেন তিনি। বলেন, “কয়লা থেকে সেস বাবদ কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের প্রাপ্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা। তার থেকে চলতি বছরে কমপক্ষে দু’হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে ধরে নিয়েই রাজস্ব ঠিক করা হয়েছিল। ওই টাকা সাংবিধানিক ভাবেই রাজ্যের প্রাপ্য। সেই টাকা ছেড়ে দেওয়া যায় না।”
অসীমবাবু জানান, এ বারেও রাজ্যের ঋণ হিসেবে এক লক্ষ ৮৬ হাজার কোটি টাকার উল্লেখ করা হয়েছে। আসলে রাজ্যের ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। কারণ, এই রাজ্য স্বল্প সঞ্চয়ে দেশের মধ্যে প্রথম। আর কেন্দ্রের আইন অনুযায়ী রাজ্যের মোট স্বল্প সঞ্চয়ের ৮০ শতাংশ রাজ্যকে ঋণ হিসেবে নিতেই হবে। তাই কেন্দ্রকে বারবার ঋণের বোঝা কমাতে বলা হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করেছে কেন্দ্র। তিনি বলেন, “নতুন অথর্মন্ত্রী কৃষি বিপ্লবের কথা বলেছেন। রাজ্যে সেই বিপ্লব বেশ কিছু দিন আগেই শুরু হয়েছে। তাই ভারত সরকারের নথি অনুযায়ী খরা না-হলে পশ্চিমবঙ্গ চাল ও সব্জি উৎপাদনে দেশের মধ্যে প্রথম।” অসীমবাবু জানান, নতুন অর্থমন্ত্রী রাজ্যে ৫৬ হাজার ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধের কথা বলেছেন। কিন্তু এটা বলেননি যে, বিআইএফআরে থাকা রুগ্ণ শিল্প পুনরুজ্জীবনে দেশে প্রথম স্থানে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে এখন ২৭ লক্ষ ক্ষুদ্র শিল্প রয়েছে।
শিক্ষা পরিকাঠামো উন্নয়ন ও সামাজিক খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধিকে স্বাগত জানিয়ে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী বলেন, “কোন খাতে ঠিক কত বরাদ্দ করা হয়েছে, ভোট অন অ্যাকাউন্টে তার উল্লেখ নেই। আশা করি, পূর্ণাঙ্গ বাজেটে তিনি তা জানিয়ে দেবেন।”
First Page Rajya Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.