‘প্যাচ’ গৌতম
আলাদিনের আশ্চর্য সেবা
হোয়াইট কোট সিনড্রোমে ভুগছে সাড়ে চার বছরের মেয়ে। সাদা অ্যাপ্রন পরা চিকিৎসক বা সাদা রঙের পোশাক পরা নার্সকে দেখলেই ভীষণ ভয় করে তার। এলেই তাঁরা ইঞ্জেকশন দেন, সিরিঞ্জে রক্ত নেন, তেতো-তেতো ওষুধ খাইয়ে দেন। তাই সাদা জামা পরা কাউকে হাসপাতালের ঘরে ঢুকতে দেখলেই চিৎকার করতে থাকে সে। পালিয়ে যেতে চায় স্যালাইনের নল খুলে।
তার পরে এক দিন হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে ঢুকল ঝকমকে পোশাক পরা এক জাদুকর। তার হাতে কত রকম লাল-নীল বল, বেলুন, রঙিন ঝোলা। ঝোলা দোলালেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে কাগজের ফুল, হাঁসের ডিম। সামনে রাখা প্লাস্টিকের খালি খাঁচা, ‘গিলি গিলি গে’ বলে ছড়ি ঘোরালেই তাতে চলে আসছে সাদা ফটফটে একটা পায়রা! মেয়েটি তো মুগ্ধ! তার পরে কখন যেন সেই জাদুকরই গল্প করতে-করতে, টুক করে ইঞ্জেকশন দিয়ে দিল, পুঁচকে মেয়ের একটুও ভয় করল না। এর পর থেকে রোজই সেই কালো জরির জামা পরা জাদুকরই তাকে ওষুধ খাওয়ায়, রক্ত নেয়, জাদুও দেখায়। কত মজার মজার গল্প বলে। ছোট্ট মেয়ের আর হাসপাতাল থেকে পালাতে ইচ্ছা করে না।
জাদুকরের নাম গৌতম বর্মণ। বছর আটত্রিশের রোগাপাতলা যুবক। সল্টলেকের কলম্বিয়া এশিয়া হাসপাতালের পুরুষ নার্স। ম্যাজিক দেখানোটা তাঁর নিছকই শখ। সেই শখকে হাতিয়ার করেই শিশুদের ‘হাসপাতাল ফোবিয়া’ কাটানোর পন্থা নিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কাজের ফাঁকে শিশু ওয়ার্ডের বিভিন্ন ঘরে জাদুকরের পোশাকে ঘুরে বেড়ান গৌতম। জাদুর খেলা দেখিয়ে অসুস্থ ছোটদের মন ভাল করে দেন। আবার খেলা দেখানোর ছলে ইঞ্জেকশনও দিয়ে দেন। এবং, তার জন্য এক পয়সাও নেন না।
শিশু মনস্তাত্ত্বিকেরাই জানিয়েছেন, এমনিতেই হাসপাতাল, চিকিৎসক, নার্সদের ছোটরা ভয় করে। একেই ‘হোয়াইট কোট সিনড্রোম’ বলা হয়। এর জন্যই ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকলে বা ডাক্তারকে দেখলেই অনেক শিশু হাত পা ছুড়ে কাঁদতে শুরু করে। এটা খুব স্বাভাবিক। ভয় কাটাতে ছোটদের চিকিৎসা পদ্ধতি বা চিকিৎসার পরিবেশটাকেই যদি অন্য রকম করা যায় সেটা সবচেয়ে ভাল।
চিকিৎসকেরা বলছেন, বিদেশে এ বিষয়ে অনেক চিন্তাভাবনা হয়েছে। কিন্তু আমাদের রাজ্যে সরকারি হাসপাতালে যেখানে সাধারণ পরিষেবা মেলাই দুষ্কর সেখানে বাচ্চাদের চিকিৎসা নিয়ে এমন পরীক্ষানিরীক্ষা সোনার পাথরবাটি। বেসরকারি কিছু হাসপাতাল বাচ্চাদের ওয়ার্ডে দেওয়ালে ছবি আঁকায় উদ্যোগী হয়েছে, রয়েছে খেলার ঘরও, কিন্তু জোকার বা জাদুকর সেজে চিকিৎসক বা নার্স চিকিৎসা করছেন এমন পরিষেবা নেই বললেই চলে। সে দিক দিয়ে এ রাজ্যে গৌতমের কাজ ব্যাতিক্রমী।
পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে কিন্তু সেই কবে থেকেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এক ‘ক্লাউন ডাক্তার’। পঁয়ষট্টি পার করা সেই পাগলাটে ডাক্তারের নাম হান্টার ‘প্যাচ’ অ্যাডামস। মার্কিন চিকিৎসক, যিনি সেই সত্তরের দশকে বার করে ফেলেছিলেন হাসপাতালে ভর্তি মন খারাপ করে থাকা ছোটদের মন ভাল করার চাবিকাঠি। তাঁর কাছে ওষুধ, ইঞ্জেকশনের পাশাপাশি হাসি, মজা, ভালবাসা, হুল্লোড়টাও পুঁচকেদের চিকিৎসার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তাই তিনি নিজে জোকার সেজে ঘুরে বেড়ান বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতালের শিশু বিভাগে। হইহই করে চিকিৎসা করেন, মজাও করেন। ইতিমধ্যে তিনি তৈরি করে ফেলেছেন একটি ইনস্টিটিউট। সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকেরাও জোকার সেজে অসুস্থ শিশুদের আনন্দ দেন। ক্লাউন ডাক্তারের জীবন অবলম্বনেই হলিউডে তৈরি হয়েছিল বিখ্যাত ছবি ‘প্যাচ অ্যাডামস’, যার নামভূমিকায় ছিলেন রবিন উইলিয়ামস।
হান্টার ‘প্যাচ’ অ্যাডামস
ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় ‘হিউমার ফাউন্ডেশন’ এবং ইউরোপে ‘থিওডোরা ট্রাস্ট’-ও ‘ক্লাউন ডক্টর’ এর কনসেপ্ট-এ কাজ করে সাড়া ফেলেছে। যদিও ভারত এখনও এ ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে। একমাত্র চণ্ডীগড়ে ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এ শিশুবিভাগের চিকিৎসকেরা পরীক্ষামূলক ভাবে জোকারের পোশাক পরে ছোটদের চিকিৎসা করে দারুণ ফল পেয়েছেন। সেখানে মহিলা চিকিৎসকদের শিশুরোগীরা ডাকে ‘মিসেস হিহি’ নামে আর পুরুষ চিকিৎসকদের নাম হল ‘মিস্টার হাহা।’ পশ্চিমবঙ্গে বোধহয় পথটা দেখালেন গৌতম আর তাঁর হাসপাতালই। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীর এই যুবক অবশ্য ‘প্যাচ অ্যাডামস’ বা ‘মিস্টার হাহা’দের চেনেন না। শুধু বুঝতে পারেন হাসি হাসি মুখের মজারু ডাক্তারবাবু বা নার্স মুহূর্তে একশো বাল্বের আলো জ্বালতে পারেন অসুস্থ ছোট্ট মুখগুলোয়। গৌতম বর্মণ বললেন, “আমার মেসোমশাই জাদুকর। ছোটবেলা থেকে তাঁর খেলা দেখতাম অবাক হয়ে। আর ভাবতাম কোনও এক দিন আমিও পারব। কিন্তু রোজগারের ধান্দা করতে গিয়ে ম্যাজিক শেখা হয়নি। হল অনেক পরে। মাস চারেক আগে খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিলাম। হাসপাতালের এক অনুষ্ঠানে সে সব দেখাতেই কর্তৃপক্ষই আমাকে বাচ্চাদের ওয়ার্ডে খেলা দেখাতে বললেন। কাজের বাইরে ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে যখন দেখি দুঃখ-দুঃখ মুখগুলো ঝলমলিয়ে উঠছে তখন সেটাই হয় আমার পারিশ্রমিক।”
Previous Story

Kolkata

Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.