ব্যাগ গুছিয়ে...

ফুটবে, ফুল ফুটবে
ছিপছিপে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হৃষীকেশ ছেড়ে আসা বাসটা দাঁড়াল যোশিমঠে। ঘড়ি বলছে সন্ধ্যা প্রায় সাতটা। পথে পার হয়ে এসেছি দেবপ্রয়াগ, রুদ্রপ্রয়াগ, চামোলি, পিপলকোটি। এই আঁধারে সারথি আর চলতে নারাজ। অগত্যা পথে পা রাখি। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া হাত বুলিয়ে যায় মুখে, মাথায়। ‘সাব আপ এক কাম কিজিয়ে, সামনে গুরুদ্বোয়ার মে চলা যাইয়ে, আপকো রহনেকা বন্দোবস্ত হো যায়গা।’ একমুখ ধোঁয়ার সঙ্গে কথাগুলো ভেসে এল যার কাছ থেকে সে তখন এক দোকানের আধো-অন্ধকারে অদৃশ্যপ্রায়। ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে হাঁটা লাগালাম। পঞ্জাবি তীর্থযাত্রীদের ভিড়। তাঁরা সকলেই এসেছেন হেমকুণ্ড সাহিব যাবেন বলে। তবে আমার ঠাঁই হল সেখানে। সঙ্গে কম্বল আর গরম চা। রাতে খাবার ব্যবস্থাও।
পরদিন সকালে আবার বাসের চলা শুরু। আকাশ পাঁশুটে। বিষ্ণুপ্রয়াগ পার হয়ে বাস আমাকে নামিয়ে দিল গোবিন্দঘাট। এখান থেকে বদ্রীনাথ আরও প্রায় ১৯ কিলোমিটার। গোবিন্দঘাট তীর্থযাত্রীদের ভিড়ে সরগরম। এখানেও আশ্রয় নিই গুরুদ্বারে। ক্যামেরা, জলের বোতল, ছাতা, শুকনো কিছু খাবার আর দরকারি ওষুধ বাদে বাকি সব বড় ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে রেখে দিই গুরুদ্বারের লকারে। কালকের প্রস্তুতি। পরদিন ১৫ অগস্ট। আকাশের মুখ অল্প ভার থাকলেও নীলের ছোঁয়া দেখতে পাচ্ছি। এ বারের যাত্রায় আমি একেবারে একলা। তবে পথে বান্ধবের অভাব নেই। আমি চলেছি ১৯ কিলোমিটার দূরে ঘাংঘারিয়ার উদ্দেশে। আজ সেখানেই থাকা। দলে দলে পঞ্জাবি তীর্থযাত্রীরা পুণ্যার্জনের আশায় চলেছেন। বড় অবাক হলাম। একটি দলের সবথেকে ছোট ছেলেটিও এই ঠান্ডায় জলে ভেজা পাথুরে পথে খালি পায়ে পা মিলিয়েছে দলের বড়দের সঙ্গে। কীসের টানে কে জানে!
অলকানন্দাকে সঙ্গে নিয়ে পথের শুরু। মাঝে তাকে পার হয়ে যাই। এ সময়ে তীর্থযাত্রীদের জন্য ঘোড়া, ডান্ডি এ পথে প্রচুর। তাদের পথ করে দিতে সরে দাঁড়াই মাঝেমধ্যে। কিছুটা চড়াই শেষে রাস্তা ঘুরল বাঁ দিকে। অলকানন্দা নীচে মিশছে ভুইন্ডার গঙ্গার সঙ্গে। ভুইন্ডার গঙ্গার গর্জনের সঙ্গে সঙ্গে পথচলা। পথ পিছল তবে কষ্টের নয়। অজস্র পথের সঙ্গী, মাঝে-মধ্যেই কুশল বিনিময়, একটু দাঁড়ানো, তার পরে আবার চলা। ওপর থেকে যারা নামছেন তাঁদের ফুলের উপত্যকা নিয়ে প্রশ্ন করেও কিছু জানতে পারলাম না। কারণ যাঁদের প্রশ্ন করলাম তাঁরা কেউ ও পথে যাননি।
পুলনা পৌঁছে ভুজগাছের ছবি তুলছি যখন, তখন বৃষ্টি এল। বৃষ্টি এল তার সবটুকু নিয়ে। পথ ভাসিয়ে, মন ভিজিয়ে, তার নিজের মতো করে। ছোট চায়ের ঝুপড়ি থাকলেও তাতে আশ্রয় না নিয়ে আশ্রয় নিলাম আমার ছাতার তলায়। অঝোর ধারা... প্রায় আধঘণ্টা, তার পরে সে বিরাম নিল। কিন্তু আকাশের যেন মন ভরল না, সে তখনও গম্ভীর। আবারও পা ফেলি রাস্তায়। গঙ্গার ও পারে পাথরের দেওয়াল বেয়ে নেমে আসা ঝর্না, পাইন, দেবদারু, রডোডেনড্রনের ভেলভেট সবুজ রঙা শাড়ির ঘোমটার ফাঁকে যেন এক রুপোলি টিকলির ঝলক...সেই সবুজের গায়ে ভেসে থাকা কালচে দু’টুকরো ছেঁড়া মেঘ...গ্রামবাংলার তন্বী মেয়েটার কাজলকালো চোখের কথা মনে করিয়ে দেয়...কবে যেন দেখেছিলাম তাকে...
কোথায় যেন!
বিকেল বিকেল পৌঁছে গেলাম ঘাংঘারিয়া। হাজার দশেক ফুটের কিছু বেশি উঁচুতে এই গ্রাম। আগের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে এখানেও আশ্রয় নিলাম গুরুদ্বারেই। এই মানুষগুলির আন্তরিকতাই মনকে জয় করে নেয়। ঘাংঘারিয়ার সে রাতটার কথা অনেক দিন মনে থাকবে। কুপির আলোয় চায়ের দোকানে গাছের গুঁড়ির বেঞ্চে বসে চা-পকোড়া খেতে খেতে বাইরের দিকে চোখ মেললাম। আকাশে দু’চারটে তারা...ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ নিয়ে রাতের নীল আকাশ...আবছায়ায় দু’চারটে লোক...চায়ের দোকান আর ছোট ছোট চটিগুলোয় মিটমিট করে আলো জ্বলছে...হিমেল হাওয়া...একটু পরে চাঁদ উঠল তার চন্দ্রকলা নিয়ে...চারপাশ শুনশান। আমার চোখের পাতা ভিজে উঠছে। নিজের অজান্তেই। এই চাঁদ, তারা, আকাশ সবই এত চেনা, তবু কেন যে অচেনা মনে হয় কোনও কোনও মুহূর্তে! আমি আবারও এক অদ্ভুত ভালবাসায় হারিয়ে যেতে থাকলাম...।

পরদিন সকাল ছ’টা। মেঘ ছেয়েছে আবার। এ বার পথ লক্ষ্মণগঙ্গা পার হয়ে। ডান দিকের পাথুরে রাস্তার শেষে প্রায় ছ’কিলোমিটার দূরে হেমকুণ্ড আর বাঁ দিকের পথ গিয়েছে ফুলের উপত্যকা বা ‘ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স’-এ। এ পথের দূরত্ব প্রায় সাড়ে ছ’কিলোমিটার। নাম লিখিয়ে, ক্যামেরার অনুমতি নিয়ে প্রবেশদ্বার পার হয়ে পা রাখি ফুলের উপত্যকার পথে। ভুইন্ডার গঙ্গাকে ডান হাতে রেখে পুব থেকে পশ্চিমে ‘ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স’-এর শুরু প্রায় ১১৪০০ ফুট-এ আর শেষ ১৪৫০০ ফুটে। ঘাংঘারিয়া থেকে পুরো রাস্তাটাই বড় সুন্দর। এক জায়গায় কাঠের নড়বড়ে সেতু ধরে পার হলাম ভুইন্ডার গঙ্গা, নীচে বিরাট জলোচ্ছ্বাস। অল্প আলো ফুটছে সকালের আকাশে। উপত্যকার বুকে আজ আমি প্রথম অভিযাত্রী। চারপাশ চুপচাপ...পিছনে ফেলে এসেছি সব কোলাহল...বয়ে চলা জলের শব্দ আর ঝিঁঝিঁর ডাক একটা আবেশ ছড়াচ্ছে...নিজের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি...হঠাৎ একটা খোলা প্রান্তর। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে গাঢ় বেগুনি রঙের ক্যাম্পানিউলাটা...তাদের উপরে মাথা তুলে হেরাক্লিয়াম...তাদের মাঝে অজস্র জোনসিয়ানা, জেরানিয়াম, পোটেনটিলা, প্রাইমুলা...আরও কত কী!
ক্লোরোফিল-সবুজ সতেজ ফার্ন, তাদের মাঝে অ্যাকোনিটাম...শুধু ফুল আর ফুল...আমার চলার পথ ফুলে ঢাকা...প্রতি পদক্ষেপেই আমাকে থামতে হচ্ছে। কী অপরূপ এই সৃষ্টি! কী অপূর্ব রঙের মিশেল সবুজ ক্যানভাসের বুকে। শুয়ে পড়ি ফুলের বিছানায় আকাশকে বুকে নিয়ে। নীল গলথেরিয়া আমার কানে কানে যেন বলে, এত দেরি করে এলে বন্ধু! আমি ভাষাহীন। কী অদ্ভুত এক আনন্দ! আমার মুখের ওপর দু’ফোঁটা জল। আকাশ কাঁদছে। মন খারাপ নয়, আমার আনন্দে। আমি মুখ লুকোই ইমপেশেন্স আর মর্নিংগ্লোরিদের ঘেরাটোপে। জুনিপারের মিষ্টি গন্ধ ঘাসে মিশে আছে। আমি হারিয়ে যাচ্ছি...অনেক ক্ষণ পরে মুখ তুলি...আমি কি পাগল হয়ে যাব! পাথরের আড়ালে বৃষ্টির ফোঁটায় সেজে নীলরঙা ফুলটা কে? মুখ লুকোল? বুকে হেঁটে উঁকি দিইআরে! এই তো সেই নীল পপি! নরম করে হাত বুলিয়ে দিই ওর গায়ে, খুশিতে হেলে পড়ে। আরও কিছুটা এগোতেই ব্রহ্মকমল, কোবরা লিলি, অর্কিড আর স্কেলি রডোডেনড্রন...।

কয়েকটা জলাধার পার হয়ে মার্গারেট লেগির স্মৃতিফলক। এই ব্রিটিশ মহিলা উদ্ভিদবিজ্ঞানী ফুলের উপত্যকায় এসে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। স্থানীয় মানুষজন তাকে স্বর্গ থেকে আসা ক্ষণজন্মা পরি ভেবে এই ফুলের রাজ্যেই সমাধিস্থ করে। বড় শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন মার্গারেট। আরও কিছুটা এগিয়ে যাই। মনে মনে ভাবি কী আশ্চর্য প্রকৃতির এই সৃষ্টি। সারা বছর বরফ চাপা এই ফুলেরা বর্ষার অপেক্ষায় থাকে। বর্ষায় বরফ গলে যায়, মাথা তোলে সবুজেরা...ফুল ফোটে। দু’মাসেই সব শেষ। আবার ফুলেরা বরফের চাদরে, শীতঘুমে।
এখন দুপুর। আকাশ বলছে একটু পরেই বৃষ্টি নামবে। অগত্যা অতৃপ্ত মনে ফিরতে থাকা। ঘাংঘারিয়ার আগের রাতের চায়ের দোকানটায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে যখন বসে আছি তখন মাথায় ঘুরে ফিরে আসছে একটা গানের লাইন, ‘শ্রাবণের মেঘ ঝুলে আছে বিষণ্ণ বিকেলবেলা...’। রাতটা ঘাংঘারিয়ায় কাটিয়ে ভোরের আকাশকে সঙ্গী করে যখন ফেরার পথে পা রেখেছি, গোলাপি ইমপেশেন্সরা যেন আমার কানে কানে বলল, তুমি বাড়ি ফিরছ, তা হলে সবাইকে বোলো আগামী দিনগুলোর জন্য আমাদের আজকের দিনগুলো দিয়ে গেলাম। ভুলে যেও না বন্ধু...।
কেউ কি নিজের ভালবাসাকে ভুলতে পারে?

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে হরিদ্বার/হৃষীকেশ ট্রেনে। সেখান থেকে বদ্রীনাথের বাসে গোবিন্দঘাট। গোবিন্দঘাট থেকে ঘোড়া কিংবা ডান্ডিতে ঘাংঘারিয়া। সেখানে এক রাত থেকে পায়ে হেঁটে ফুলের উপত্যকা বা ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স। ওই পথেই ফেরা। যদি ইচ্ছে হয় একটা দিন বাড়তি দিয়ে হেমকুণ্ড সাহিবও ঘুরে নিতে পারেন।
কোথায় থাকবেন
এ পথে সব জায়গাতেই থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। ছোটখাটো চটি, লজ, বেসরকারি হোটেল এবং গুরুদ্বার।
কখন যাবেন
সব থেকে ভাল সময় জুলাই-অগস্ট। সঙ্গে নেবেন একটা জুতসই ছাতা অথবা রেনকোট অবশ্যই নেবেন। গরম জামাও।
Previous Story

Kolkata

Next Story




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.