|
|
|
|
সম্পাদকীয় ২... |
পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞা |
ধূমপান যে ক্ষতিকর তাহা আর অস্বীকার করিবার উপায় নাই। বুদ্ধির গোড়ায় ধূম, যৌবন যাপনের জন্য ধূম ইত্যাদি নানা যুক্তিতে আর এই নেশাকে কোনও ভাবেই রক্ষা করিবার উপায় নাই। কারণ অন্যান্য নেশার সহিত ইহার একটি মৌলিক পার্থক্য রহিয়াছে। ইহা কেবল উপভোক্তার ক্ষতি করে না, পরিবেশের ক্ষতি করে। প্রতিবেশী মানুষের ক্ষতি সাধন করিয়া থাকে। সামাজিক পরিসরে আজকাল প্রায় সর্বত্রই ‘নো স্মোকিং জোন’ চিহ্নিত করিয়া দেওয়া হয়। কিন্তু তাহা যথেষ্ট নহে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সুবৃহৎ তামাক-ব্যবসাকারী কোম্পানিগুলির উপর সম্প্রতি একটি নির্দেশ জারি করা হইয়াছে। সেই নির্দেশ বলিতেছে, সিগারেটের খাপের গায়ে বিশেষ কতকগুলি চিত্র প্রদান করিতে হইবে। ধূমপানের ফলে দন্তের যে ক্ষতি হয়, তাহা বুঝাইবার জন্য ক্ষতিগ্রস্ত দন্ত ও মাড়ির কুৎসিত চিত্র প্রদান করা যাইতে পারে। সেই চিত্র দেখিয়া ক্রেতাগণের মনে ভয়ের সঞ্চার হইবে। বিবমিষার উদ্রেক হইবে। এমনকী খাপের গাত্রে মৃতদেহের ছবিও দেওয়া যাইতে পারে। উপভোক্তা এই চিত্র দেখিয়া ভাবিবেন, শেষের সে দিন ভয়ংকর। মৃত্যুর কথা ভাবিয়া হয়তো তিনি এই প্রাণঘাতী অভ্যাস ত্যাগ করিতে পারেন। এই পদ্ধতি প্রত্যক্ষ নহে, পরোক্ষ। উপভোক্তার উপর সরাসরি নিষেধাজ্ঞা জারি না করিয়া বিক্রেতার উপর পরোক্ষে চাপ দেওয়া হইতেছে। বিক্রেতাও ক্রেতাকে সরাসরি কিছু না বলিয়া ব্যঞ্জনার মাধ্যমে জানাইতেছেন, এই নেশা সত্যই সর্বনাশা।
নিষেধাজ্ঞার এই উপায়টি ধূমপায়ীদের সংখ্যা কমাইবে কি না, তাহা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা জ্ঞাপনের এই পদ্ধতিটির প্রতি আলাদা করিয়া মন দেওয়া আবশ্যক। মানবসমাজে নানা অভ্যাস প্রচলিত। এই অভ্যাসগুলির সবই যে সু-অভ্যাস, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু সেগুলি নিরোধ করার জন্য সর্বদা নৈতিক বিধি চাপাইয়া দেওয়া চলে না। সেই নৈতিক বিধি চাপাইতে চাহিলে সমাজ তো আর পরিণত মানুষের সমাজ থাকিবে না, শিশুদের স্কুলে পরিণত হইবে। সমাজে সব সময় নীতিবাগীশত্ব দেখাইলে চলিবে কেন? পরিণত মানুষের নিজের পছন্দের অধিকার ও নির্বাচনের অধিকার তো ছিনাইয়া লওয়া চলিবে না। বস্তুত, নৈতিকতার সেই বজ্রদৃঢ় বাঁধন এক প্রকার অবদমনের সৃষ্টি করিবে। অবদমিত সমাজে লুকাইয়া-চুরাইয়া যাহা চলিবার তাহা চলিবে। দেখা যাইবে, কড়া নিয়ম যদি বা কেহ সামনে মানিল তো তাহা পিছনে মানিল না। ইহাতে সমাজের স্বাস্থ্যের ক্ষতি ছাড়া লাভ হইবে না। নৈতিক দমননীতির পরিবর্তে অপর কোনও উপায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা তাই বিধেয়। এই অপর উপায়টি পরোক্ষ হইলে মন্দ হয় না। সিগারেট কোম্পানিগুলিকে যে উপায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করিতে বলা হইতেছে তাহা পরোক্ষ উপায়ের উদাহরণ। সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রেও এই উপায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা সম্ভব। পরিণত নাগরিক মানুষকে কান ধরে সরাসরি বলা হইল না, ইঙ্গিতে বলা হইল। ইঙ্গিত তো ভাবায়। তিনি ভাবিলেন। ভাবনা জরুরি। কী করিবেন না করিবেন, তাহা যেন এই পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে এক জনকে ভাবিবার অবকাশ দেওয়া হইতেছে। ইহাতে তাঁহার আত্মমর্যাদাও রক্ষিত হইল, আবার নিষেধের ভাব-ভাষাও সঞ্চারিত হইল। সুতরাং উপায়টি যে কাজের, তাহা মানিতেই হইবে। |
|
|
|
|
|