|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
ব্যক্তি বনাম ব্যবস্থা |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর হইতেই মন্ত্রীদের তরফে বিনা নোটিসে অকুস্থল পরিদর্শনে গিয়া অব্যবস্থা ও অনিয়ম শনাক্ত করার এক অভিযান শুরু হইয়া গিয়াছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজেই এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসাবে তিনি প্রায় প্রত্যহই শহরের কোনও-না-কোনও হাসপাতাল আচমকা সফরে গিয়া স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ও পরিষেবার ত্রুটি ধরিতেছেন। তাঁহার দেখাদেখি অপরাপর মন্ত্রীরাও নিজ-নিজ মন্ত্রকের কাজ সরেজমিনে যাচাই করিতে দফতর ছাড়িয়া পথে নামিয়াছেন। তেমনই এক সফরে গিয়া পরিবেশমন্ত্রী শিবপুরের বাগান দূষণকারী এরটি কারখানা বন্ধ করাইয়া দেন। ওই কারখানা হইতে নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য বাগানের পরিবেশ দূষিত করিলেও এবং বাগান কর্তৃপক্ষ একাধিকবার পুলিশকে অভিযোগ জানাইলেও প্রতিকার মেলে নাই। যে কাজ এত দিন কিছুতেই হয় নাই, পরিবেশমন্ত্রীর এক সফরের ঘায়ে জেলা পুলিশ সুপার তাহা সাধন করিলেন।
সন্দেহ নাই, এই ধরনের সফর ও দৃষ্টান্তস্থাপন বিশেষ অভিনন্দনযোগ্য কাজ। কোনও অজুহাত কিংবা কুযুক্তি দর্শাইবার সুযোগ না দিয়া মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও উপস্থিতির দ্বারা কর্ম-সংস্কৃতি ফিরাইয়া আনিবার এই প্রয়াস চলিতে থাকিলে রাজ্যেরই মঙ্গল। তাঁহাদের আচমকা পরিদর্শন যে পশ্চিমবঙ্গের মতো কর্ম-বিমুখতার রাজধানীতে কতটাই প্রয়োজনীয়, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। বিশেষত অতীত অভিজ্ঞতা যখন বলে, প্রশাসন আসলে একান্ত ভাবেই আমলা-নির্ভর একটি বস্তু এবং আমলা-অফিসাররা জনসাধারণ হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, দফতরের ঠাণ্ডা ঘরে বসিয়া ফাইল-স্বাক্ষর-করা একটি গোষ্ঠী, ফাইল আটকাইয়া রাখা কিংবা তাহা হারাইয়া ফেলাই যাঁহাদের একমাত্র সরকারি কাজ তখন সেই প্রশাসনে একটু নাড়া দিতে এবং তাহাতে মোতায়েন কায়েমি স্বার্থচক্র ভাঙিতে এ ধরনের সচল অমাত্যদের অত্যন্ত প্রয়োজন। কিন্তু একটি প্রশ্ন উঠিবেই। কেবল মন্ত্রীরা নড়াচড়া করিলে বা অকুস্থল পরিদর্শনে যাইলেই কি প্রশাসন চাঙ্গা হইয়া উঠিবে? নতুবা নয়? শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাটিই এমন দাঁড়াইয়া যাইবে না তো যে মন্ত্রীরা আসিলে কাজে নাড়া পড়ে, না আসিলে সকলে হাত গুটাইয়া আরামে থাকেন? মন্ত্রীরা কতই বা দৌড়াদৌড়ি করিবেন? এ জন্যই তো ব্যক্তিগত স্তর পার হইয়া একটি ‘ব্যবস্থা’র স্তর তৈরি হয়, বন্দোবস্ত হয়, প্রশাসনিক পদ্ধতি নির্মিত হয়। প্রয়োজন সেই ‘ব্যবস্থা’টিকে ফিরাইয়া আনা। প্রশাসনিক সংস্কার অবশ্যই জরুরি, কিন্তু সেই সংস্কার যেন ব্যক্তিমুখাপেক্ষী না হইয়া ব্যবস্থাভিত্তিক হয়, তাহা দেখিতে হইবে। ত্রুটি-বিচ্যুতি যাহা থাকিবে, তাহা ব্যবস্থার নিজস্ব টানেই প্রতিবিধান রীতির মধ্য দিয়া তাহার প্রতিকার হইবে।
যেমন এ ক্ষেত্রে, দূষণ সৃষ্টিকারী একটি কারখানা বন্ধ করিতে পরিবেশমন্ত্রীর সশরীরে বোটানিকাল গার্ডেনে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল কি? বাগান কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ সে-কাজ করিতে পারিত না? না করিতে পারিলে কিন্তু সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্তারা কড়া শাস্তির পাত্র। সে শাস্তির ব্যবস্থা মহাকরণে বসিয়াও করা যায়। অতিবৃহৎ কোনও বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে নিশ্চয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা ঘটনাস্থলে যাইবেন। অনেক সময় জনসাধারণের প্রত্যাশাকে মর্যাদা দিতে এবং তাঁহাদের ‘পাশে থাকা’র আশ্বাস দিতেও সেটুকু দরকার হয়। অবশ্য সে ক্ষেত্রেও দেখা গিয়াছে, ঘটনাস্থলে ভিআইপিদের উপস্থিতি বিপর্যয় মোকাবিলা ও ত্রাণের কাজে যথেষ্ট ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। সুতরাং প্রশাসনকেই এমন তৎপর, দায়বদ্ধ ও জনমুখী করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীদের অনুপস্থিতিতেও দফতরের অফিসার-কর্মীরা, পরিকাঠামো ও পরিষেবা জনসাধারণের দাবিদাওয়াগুলি পূরণ করিতে পারেন, নিয়মভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতে পারেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনপ্রণালীর অভিমুখ সেই দিকেই নির্দেশিত হওয়া উচিত । |
|
|
|
|
|