সিনেমা সমালোচনা...
পর্দা ফুঁড়ে বুকের উপর আছড়ে পড়ে
গান লেখা এত সোজা না বুঝলে? কী বলার আছে তোমার? ‘তোমাকে চাই’ লেখা হয়ে গেছে...‘বিষ শুধু বিষ দাও’ লেখা হয়ে গেছে...আর কী লিখবে তুমি? বৃষ্টি-টিষ্টি নিয়ে কী সব লিখেছ...কী আছে কী এর মধ্যে? যত্ত জোলো সেন্টিমেন্টাল!! বৃষ্টি দেখে এত কান্নাই বা পাচ্ছে কেন তোমার?”
অবনী সেনের গোলা-বৃষ্টির সামনে পড়ে শিলিগুড়ি থেকে গিটার কাঁধে ছুটে আসা বছর কুড়ির মেয়েটা কি থিতিয়ে যায়? যায়, কিছুটা তো যায়ই। কিন্তু তার একগুঁয়ে দৃষ্টি বুঝিয়ে দেয়, দমবার পাত্র সে নয়। একটু পরেই সে বলে উঠবে, “আমি হয়তো আপনার মতো ভাল লিখতে পারি না। কিন্তু আমার কাছে আমার গান খুব বড়।”
এই ধরতাইটুকু থেকে ‘রঞ্জনা আমি আর আসব না’ সম্পর্কে কী কী আন্দাজ করে ফেলা যায়?
এক, প্রবীণ আর নবীনের মোলাকাতটা গোড়ায় খুব সুখের না হলেও শেষ পর্যন্ত একটা বোঝাপড়া নিশ্চয়ই তৈরি হবে। কী ভাবে হবে, কোন কোন ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে, সেটাই নিশ্চয়ই গল্প।
দুই, অবনী আর রঞ্জনার মধ্যে একটা অসমবয়স্ক প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে।
তিন, অবনী আর রঞ্জনা হতে পারে গুরু-শিষ্য যুগলবন্দিতে আরও একটি ‘আমরা করব জয়’-এর গল্প। প্রথমে বেশ কিছু দিন পরস্পরকে যাচাই করার পালা। তার পর, অবশ্যম্ভাবী স্বপ্নপূরণের দু’ছক্কা পাঁচ।
দর্শকদের জানিয়ে দেওয়া যাক, শুধু এক নম্বর উত্তরের জন্য নম্বর পাবেন। বাকি দু’টো উত্তর বাতিল করতে হচ্ছে। তার মানে কি রঞ্জনায় প্রেম নেই? গুরু-শিষ্য নেই? আছে। সব আছে। কিন্তু যে ভাবে থাকতে দেখে এসেছেন আজ অবধি, সে ভাবে নেই।
রঞ্জনা আমি আর আসব না
অঞ্জন, পার্নো, সুমন
‘রঞ্জনা’ পর্দা ফুঁড়ে বুকের উপর আছড়ে পড়ে আপনার যাবতীয় আন্দাজ, অভিজ্ঞতাকে স্রেফ দুরমুশ করে দেবে। এই অঞ্জনকে আগে আপনি দেখেননি। ‘রঞ্জনা’ নিঃসন্দেহে অঞ্জনের সেরা ছবি। ‘রঞ্জনা’ নিঃসন্দেহে অঞ্জনের সেরা অভিনয়। এতটা সমকালীন, এতটা দুঃসাহসী, এতটা প্রাপ্তবয়স্ক রক-মিউজিকাল এর আগে বাংলায় হয়নি। ‘রঞ্জনা’ সেদিক থেকে অবশ্য-দ্রষ্টব্য হতে বাধ্য।
‘রঞ্জনা’ কি তা হলে অঞ্জনের ‘সোয়ান সং’? ভাবনার সমূহ উপাদান কিন্তু ছড়িয়ে রেখেছেন অঞ্জন। অবনী-স্ট্যানলিকে দেখতে দেখতে মনে হয়, গানের জীবন আর জীবনের গান নিয়ে যা কিছু উপলব্ধি-পাগলামি-ব্যর্থতা-ভালবাসার কথা যেন এ ছবিতে উজাড় করে বলে গেলেন তিনি। অঞ্জন, সুমন, কলকাতার রক-চর্চার তিন স্তম্ভ নন্দন বাগচী, অমিত দত্ত ও লিউ হিল্টকে সঙ্গে নিয়ে একটা গোটা পরিক্রমাকে যেন পর্দায় হাজির করা হল। দেখতে দেখতে মনে হয়, এ ছবি যেন অঞ্জনকে করতেই হত, অঞ্জনকেই করতে হত।
আর হ্যাঁ, স্ট্যানলির ভূমিকায় কবীর সুমনকেই থাকতে হত। অবনী-স্ট্যানলির কথোপকথন তো আসলে সুমন-অঞ্জনেরই। অবনী তাই স্ট্যানলির কাছে অকপটে বলেন, “তোমার মতো লিখতে পারলাম না কোনও দিন!” অতিথি শিল্পী হলেও সুমন বা স্ট্যানলি এ ছবির অন্যতম প্রধান চরিত্র। যিনি বলবেন, চারপাশের মানুষ যে পরিমাণ বঞ্চনার মধ্যে বাঁচছে, সেখানে কনসার্ট করে বেড়ানোটা ক্রমশ তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে! অঞ্জনের সঙ্গীত পরিক্রমায় অবনীর সঙ্গে রঞ্জনার সেতুবন্ধন যতটা জরুরি ছিল, স্ট্যানলির সঙ্গে একান্ত কথনও ততটাই। ‘জাগরণে যায় বিভাবরী’ সম্পূর্ণ হত না সুমনকে ছাড়া, ‘রঞ্জনা’ সম্পূর্ণ হত না ‘গানওলা’কে ছাড়া।
কিন্তু অবনী আর রঞ্জনার অন্য গল্পটা? গুরু-শিষ্য সংবাদ বলবেন? অবনী, রঞ্জনার মধ্যে সম্ভাবনা আবিষ্কার করেছিলেন ঠিকই। রঞ্জনাকে গড়েপিটে নিয়ে তার আত্মপ্রকাশের রাস্তাও তিনিই তৈরি করেছেন, এও ঠিক। কিন্তু অবনীর মধ্যে ‘খিদ্দা’কে খুঁজতে যাওয়া বৃথা। ১৯৮৬ (কোনি) আর ২০১১ (রঞ্জনা)-র পৃথিবীর মধ্যে কয়েক আলোকবর্ষের দূরত্ব। খিদ্দা টাস্কমাস্টার ছিলেন, কিন্তু কোনিকে বিছানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য গেলাসে ড্রাগ মিশিয়ে দিতেন না।
প্রেম? অ-প্রেম? এক কথায় বলা যাবে না কোনওটাই। রঞ্জনার আগমনে অবনীর বিস্রস্ত জীবনে শান্তির জল বর্ষিত হল, তাঁর ভিতরকার স্বার্থপর দৈত্য চিরকালের মতো ঘুমিয়ে পড়ল, এমনটাও ঘটেনি কিন্তু। এবং সেটাই ‘রঞ্জনা’-র সবচেয়ে জোরের জায়গা। ‘রঞ্জনা’ আপনাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে, মানুষের মধ্যে এবং একমাত্র মানুষের মধ্যেই এক দেহে বাস করতে পারে ভগবান আর শয়তান। ঠিক এই জন্যই অবনী সম্পর্কে রঞ্জনা (“আপনি বড় ‘সং-রাইটার’ হতে পারেন। কিন্তু আপনি খুব খারাপ মানুষ”) এবং অবনী সম্পর্কে দীপান্বিতা (“আপনি অনেকের অপকার করে থাকতে পারেন। কিন্তু আপনার গান অনেককে বাঁচতে সাহায্য করেছে”) দু’জনের কথাই সমান সত্যি থেকে যায়। আর এই জন্যই ‘রঞ্জনা’কে এতটা আধুনিক মননের ছবি বলে মনে হয়।
আধুনিকতার আরও একটা অব্যর্থ সিলমোহর ‘রঞ্জনা’র শরীরে খোদাই হয়ে আছে। ঝাঁঝ আর ‘ডার্কনেস’-এর সঙ্গে ‘প্যাশন’ আর ‘ভালনারেবিলিটি’র এক তুখোড় মিশেল। সেখানে অবনী অক্লেশে বলে উঠতে পারেন, ‘‘তোমার সঙ্গে আমি আমার গানবাজনা শেয়ার করতে চাই। কিন্তু তুমি যদি প্রতি মুহূর্তে ভয় পেতে থাকো যে, আমি তোমাকে রেপ করব, তাহলে তুমি ফোটো!” আবার আপনি যদি ভেবে থাকেন অবনী একাই সক্কলকে ঝাঁঝ দেখিয়ে গেলেন আর সবাই গলবস্ত্র হয়ে সব সয়ে গেল, ভুল ভেবেছেন। ঝাঁঝ আর প্রতি-আক্রমণে অবনীর সঙ্গে রীতিমতো টক্কর দেয় রঞ্জনা। মৃতা স্ত্রীকে নিয়ে অবনীর ‘পজেসিভনেস’-এর মধ্যে যে ভণ্ডামি আছে, সেই মুখোশটা হ্যাঁচকা মেরে খুলে দেয় বছর কুড়ির ওই মেয়েটাই। এবং এ কথা বলতেই হবে, রঞ্জনার চরিত্রে পার্নো মিত্র রীতিমতো পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন অঞ্জনের পাশে।
ভালবাসা আর ঘৃণা, সমর্পণ আর আক্রমণের এই এক্কাদোক্কা যতক্ষণ ছিল, রঞ্জনার ঠাসবুনোট কোথাও আলগা হয়নি। কিন্তু ওই হোটেলের ঘরে মারামারি থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত অংশটা, খানিকটা যেন এলিয়ে গেল, মেদবহুল হল, দীর্ঘায়িত লাগল। মারামারির দৃশ্যায়নেই এ ছবিতে প্রথম ফর্মুলা ঢুকে পড়ল। রেকর্ড সংস্থার সিইও-র চরিত্রে (আবির চট্টোপাধ্যায়) ব্যোমকেশের রেফারেন্সটা বাড়তি মনে হল। দীপান্বিতাকেও ঠিক বোঝা গেল না। পেশায় সাংবাদিক, অবনীকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাতে চাওয়া মেয়েটির চরিত্রে উষসী চক্রবর্তীকে মানিয়েছে ভাল। কিন্তু যে অবনী তাকে মুখের উপর হাঁকিয়ে দিল, তার ছবি ভণ্ডুল হয়ে গেল, অবনীর প্রতি তার কোনও ঝাঁঝ রইল না? ‘রঞ্জনা’র সামগ্রিক মেজাজের সঙ্গে যায় না কিন্তু।
অবনী প্রায়শ গজগজ করে বলতেন, ‘‘একটা মেয়ে দেখাও তো! যে স্টেজে উঠে একা গিটার বাজিয়ে গান গেয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে! মহিলা রকস্টার!! হুঁ!!!”
সত্যি কথা। কলকাতা এমন অবতারে কোনও মেয়েকে সে ভাবে দেখেনি এখনও। চন্দ্রাণীর মতো শিল্পীও ব্যান্ডের লিড ভোকালিস্ট হয়েই থেকে গিয়েছেন। রঞ্জনা কিন্তু এই জায়গাটায় একটা বৈপ্লবিক সম্ভাবনা তৈরি করে দিয়ে যায়। নীল দত্তের সঙ্গীত পরিচালনায় সোমলতা যে দাপটে গান গেয়েছেন এ ছবিতে, এমন একটা স্বপ্ন গুনগুনিয়ে উঠবেই। এক দিকে পার্নো, আর এক দিকে সোমলতা, দুই ‘রঞ্জনা’ই কি ভবিষ্যতের নিশ্চিত তারকা?
রঞ্জনারা আসবে বলেই তো নিজের গিটারটি রেখে যাচ্ছেন সুমন ওরফে স্ট্যানলি। আর যাবার বেলায় ‘রঞ্জনা’কে রেখে গেলেন অঞ্জন। তোলপাড় করে দিয়ে গেলেন
Previous Item Patrika First Page


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.