|
|
|
|
ব্যবসায়ী খুন |
পানশালায় নজরদার টিভি দেখে সঙ্গী-সহ নর্তকী ধৃত |
নিজস্ব সংবাদদাতা |
নাচের তালে তালে মাঝেমধ্যেই নর্তকীর হাত চলে যাচ্ছে ব্যবসায়ীর কোমরের পিছনে।
ব্যবসায়ীর পকেটে থাকা পার্সটা কত মোটা, বুঝে নিচ্ছে সেই হাত!
মাঝেমধ্যে নর্তকীর চোখ পড়ছে ব্যবসায়ীর গলার সোনার হার আর হাতের আংটির দিকেও।
দৃশ্যগুলি দেখা যাচ্ছে পানশালার সিসিটিভি-তে। আর ছবির ওই অংশটুকু দেখেই কলকাতা পুলিশের গুন্ডা দমন এবং হোমিসাইড শাখার গোয়েন্দারা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যান যে, পরিবহণ ব্যবসায়ী সৈয়দ মহম্মদ সালাউদ্দিনকে খুন হতে হয়েছে লোভীদের
হাতে। এবং তাতে কোনও মক্ষিরানির হাত আছে। সালাউদ্দিন-হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে শুক্রবার ভোরে বীরভূমের মুরারইয়ের রতনপুর গ্রামের একটি বাড়ি থেকে মিলি পাল ওরফে কাজল নামে এক পানশালার নর্তকী এবং বাপি পাল ওরফে অজয় সেন ওরফে অজয় চট্টোপাধ্যায় নামে তার সঙ্গী এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। তাদের জেরা করে গোয়েন্দারা জেনেছেন, ছিনতাইয়ের জন্য নির্জন জায়গা বাছতেই সালাউদ্দিনকে নিয়ে যাওয়া হয় সল্টলেকে। খুনের সময় মিলি গাড়িচালক সালাউদ্দিনের বাঁ দিকে বসে ছিল। আর গাড়ির পিছনের আসনের বাঁ দিকে বসে ছিল বাপি।
জেরায় পাওয়া তথ্য অনুসারে গোয়েন্দারা জানান, সালাউদ্দিনের কানে নাইন এমএম পিস্তল ঠেকিয়ে টাকা, সোনার গয়না, এটিএম কার্ড, প্যান কার্ড এবং দু’টো মোবাইল ফোন কেড়ে নেওয়ার পরে মিলি আর বাপি নেমে চলেই যেত। কিন্তু রিমোট সুইচে গাড়ির দরজার লক খোলার আওয়াজ পেতেই বাপির মনে হয়, সালাউদ্দিন গাড়ি থেকে নেমে চেঁচিয়ে প্রাতর্ভ্রমণকারীদের ডাকতে যাচ্ছেন। সালাউদ্দিন চিৎকার-চেঁচামেচি করলে ছিনতাই করা যাবে না, এই আশঙ্কা থেকেই পিস্তল বার করে বাপি। কিন্তু ‘পরিচিত’ নর্তকীর সঙ্গী যে এ কাজ করতে পারে, তা ভাবতেই পারেননি সালাউদ্দিন। বাপির হাতে পিস্তল দেখে তিনি ভেবেছিলেন, নিছক ঠাট্টার ছলে ‘খেলনা’ পিস্তল বার করেছে সে। শুরু হয় বাপির সঙ্গে সালাউদ্দিনের কথা কাটাকাটি। লোক জড়ো হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় দু’-এক মুহূর্তের মধ্যেই বাপি কোনাকুনি পরপর তিন বার গুলি চালিয়ে দেয় পিছনের আসন থেকে। প্রাতর্ভ্রমণকারীরা টের পাওয়ার আগেই তারা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দময়ন্তী সেন এ দিন জানান, মিলি ও বাপি সোনাগাছির দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের বাসিন্দা। জেরায় জানা গিয়েছে, সোনাগাছি ছাড়াও তারা আরও চার-পাঁচটা জায়গায় থাকে। রতনপুরের পলশা গ্রামের যে-বাড়িতে ওই দু’জন আশ্রয় নিয়েছিল, সেখানে নিজেদের স্বামী-স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিল তারা। এই ধরনের ছিনতাই বা অন্যান্য দুষ্কর্ম তারা আগে কখনও করেছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুলিশের দাবি,
ধৃতেরা জেরায় জানিয়েছে, তারা নানা প্রয়োজনে এক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা ধার নিত। দেনা বেড়ে যাওয়ায় ছিনতাইয়ের ছক কষতে বাধ্য হয়েছিল তারা।
কী ভাবে ছিনতাইয়ের ছক কষেছিল মিলি? |
|
|
ধৃত বাপি এবং মিলি (ডান দিকে)। নিজস্ব চিত্র |
|
গোয়েন্দাদের দাবি, কৈখালির পানশালার উঁচু দরের সদস্য সালাউদ্দিন যে সপ্তাহের শেষ দু’দিন মোটা টাকা খরচ করেন, মিলি তা বুঝতে পেরেছিল। সে জানত, সালাউদ্দিনের সঙ্গে সব সময় বেশ কয়েক হাজার টাকা থাকে। ১৯ জুন, রবিবার রাত ৩টের কিছু পরে সে তার সঙ্গী বাপিকে পানশালার বাইরে অপেক্ষা করতে বলে। বাপি কোমরে পিস্তল গুঁজে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। সল্টলেকের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মিলি পানশালা থেকে বেরোনোর আগেই অনুরোধ করেছিল সালাউদ্দিনকে। (ছিনতাইয়ের জন্য ‘নির্জন জায়গা’ হিসেবে সল্টলেককেই বেছেছিল মিলি।) পানশালায় নাচতে নাচতে নেশার ঘোরে সালাউদ্দিন তাকে আশ্বাসও দিয়েছিলেন, ঠিক সময়ে তিনি তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে গাড়ি আছে। জেরায় পুলিশ জেনেছে, মিলি পানশালা থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাপির সঙ্গে সালাউদ্দিনের পরিচয় করিয়ে দেয়। মিলি তাঁকে বলেছিল, বাপিও তার পাড়ায় থাকে। তাই তিনি যেন তাকেও গাড়িতে তুলে নেন এবং বাড়ি পৌঁছে দেন। রাজি হয়ে যান সালাউদ্দিন। ওই সময় সালাউদ্দিনের মোবাইলে ফোন আসে এবং তিনি জানতে পারেন, দিল্লি থেকে আসা তাঁর ট্রাক ডানলপে অপেক্ষা করছে। মিলি ও বাপিকে তিনি বলেন, ডানলপ থেকে ট্রাকটিকে পথ দেখিয়ে মধ্য কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে তিনি সল্টলেকের দিকে রওনা হবেন। সেই কারণেই সালাউদ্দিনের মোবাইলের ‘কল’ অনুযায়ী ভোর ৫টার কিছু আগে তাঁর শেষ ‘লোকেশন’ পাওয়া যায় আমহার্স্ট স্ট্রিট-চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ এলাকা। গোয়েন্দারা জানান, মধ্য কলকাতা থেকে পৌনে ৫টার কিছু পরে পরে সল্টলেক রওনা হন সালাউদ্দিন। সল্টলেকে তাঁকে গুলি করা হয় ৫টা নাগাদ। তার পরে অটোয় শিয়ালদহ স্টেশনে যায় বাপি ও মিলি। সেখান থেকে ট্রেনে চাপে তারা।
কী করে ধরা পড়ল মিলি-বাপি? গোয়েন্দারা জানান, সালাউদ্দিনের মোবাইল ফোনের ‘কল ডিটেলস’ থেকে মিলির নম্বর পাওয়া যায়। মিলির ফোনের ‘কল ডিটেলস’ থেকে পাওয়া যায় বাপির নম্বর। দেখা যায়, ২০ জুন সকাল থেকে ওই দু’টি ফোন বন্ধ আছে। এর ফলে গোয়েন্দাদের সন্দেহ দৃঢ় হয়, তারা একসঙ্গেই আছে। এ দিকে, গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে নর্তকীর নাম-ঠিকানা জানিয়ে দেন কৈখালির সেই পানশালার কয়েক জন কর্মী। সোনাগাছি এলাকা থেকে তাদের গতিবিধির ব্যাপারেও খবর পায় পুলিশ। সেই সঙ্গে বাপির পরিচিতদের বাড়ি সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করতে থাকেন গোয়েন্দারা। তত ক্ষণে গোয়েন্দাদের হাতে এসে গিয়েছে বাপি ও মিলির নতুন মোবাইল নম্বরও। ফোনে আড়ি পেতেই জানা যায়, বীরভূমে লুকিয়ে আছে ওই দু’জন। |
|
|
|
|
|