|
|
|
|
পনেরো বছর পর ক্রিকেটের শেষ বিচার পেলেন রাহুল |
গৌতম ভট্টাচার্য • কলকাতা |
পনেরো বছর আগে ঠিক এই দিনটাতে নিয়তি গ্রাস করেছিল অভিষেকেই লর্ডসে সেঞ্চুরি পাওয়ার ভাগ্য।
পনেরো বছর পর ঠিক এই দিনটাতে নিয়তি ফিরিয়ে দিয়ে গেল অসাধারণ এক সেঞ্চুরি-ভাগ্য যা না হওয়ারই কথা ছিল।
লর্ডসে সে দিন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় সেঞ্চুরি করেছিলেন। ৫৬ রানে অপরাজিত রাহুল দ্রাবিড় থেমে যান ৯৫-তে। ফেসবুকে, টুইটারে, কাগজে, অনুষ্ঠানে সৌরভ-ভক্তরা গত ক’দিন ধরে যখন চুটিয়ে পনেরো বছর পূর্তির উদযাপন করছেন, দ্রাবিড় সে সময় ভরপুর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে থেকেও আলো-আঁধারিতে। আসলে ৫ রান কম থাকাটা সংখ্যাতেই ৫ রান কম থাকা। স্কোরবোর্ডে বিজিত হয়ে যাওয়া। জীবনের আর পাঁচটা শাখার মতোই ব্যাট হাতে বিজিতকে কেউ মনে রাখে না। রাহুলকেও রাখছিল না।
জামাইকার অনবদ্য সেঞ্চুরিতে, যেখানে দলে পরবর্তী সর্বোচ্চ রান ২৮, রাহুল আবার পনেরো বছর আগের প্রাপ্য মুকুট ফেরত পেলেন। ক্রিকেটবিশ্বে ধন্য ধন্য পড়ে গিয়েছে চাপের মুখে সাবেকি টেস্ট ক্রিকেটের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ছবি যে ভাবে তাঁর ব্যাটে উঠে এসেছে। |
|
সাবাইনা পার্ক ২০১১। সেঞ্চুরির গরিমায়। |
ক্রিকেটের মধ্যে যাঁরা নিরন্তর জীবন খোঁজেন তাঁদের এর পর বিশ্বাস গজাবে, বিচার বিলম্বিতই হতে পারে, চির অস্বীকৃত থাকে না। জাস্টিস ক্যান বি ডিলেড ক্যান নেভার বি ডিনায়েড।
ক্রিকেটের মধ্যে যাঁরা শোভনতা, সৌজন্য এবং নিষ্ঠা খোঁজেন তাঁদের মনে হবে সাবাইনা পার্কে যেন এই গুণগুলোরই অলক্ষ্যে কোথাও সংবর্ধনা হল। নইলে কেউ কোথাও দেখেছে যে লোকটা আগের বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিল, সে বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ থাকা অবস্থায় টুর্নামেন্ট চলাকালীন শহরের বাইরে যাচ্ছে না। বরঞ্চ বিশ্বকাপ ম্যাচ সংগঠনে সুবিধের জন্য মোটা মোটা ফাইল নিয়ে বেঙ্গালুরু স্টেডিয়ামের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত চষে ফেলছে। সারাক্ষণ পাশে থাকছে তার দুই বন্ধু ক্রিকেটার সচিব আর প্রেসিডেন্টের। ঘটনাচক্রে যাঁদের নাম শ্রীনাথ আর কুম্বলে।
ক্রিকেটের মধ্যে যাঁরা আন্ডারডগের মরণপণ লড়াই খোঁজেন, তাঁদের মনে হবে এটা হার না ছেড়ে দেওয়া নাছোড় মনোভাবের পুরস্কার। শেষ বিচারের রোম্যান্টিক তত্ত্ব তাঁরা মেনে নাও নিতে পারেন। আর সেই মেনে না নেওয়ার সঙ্গে বিরোধে যাওয়া সমস্যার। তাঁরা যে এই ফাইল বয়ে বেড়ানোর পিছনে যেতে চাইবেন। আরও পিছনের গ্রিন রুমে গিয়ে দেখাবেন লোকটা ফাইল হাতে নিয়েছিল সকাল দশটায়। কিন্তু তার আগে সাতটা থেকে সকালে নেট প্র্যাক্টিস করছিল। যখন মিডিয়ার ভিড় ছিল না। যখন টিভি ক্যামেরা ছিল না। ধোনি দলবল নিয়ে অনুশীলনে আসার আগে লোকটা তার মতো করে ভিড়ে হারিয়ে যায়।
ক্রিকেটের মধ্যে যাঁরা চিরন্তন স্কিল খোঁজেন, তাঁরা এক একজন মুগ্ধ হয়ে ভাববেন আহা রাহুলের সঙ্গে আমরা এক একজনও জিতলাম। হংকং থেকে সম্পূর্ণ অপরিচিত ক্রিকেটউৎসাহী ব্লগ লিখেছেন, দ্রাবিড়ের গোটা ইনিংসের শটগুলোর একটাও ক্রিকেট স্ট্রোকের সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা জেতার মতো নয়। ভীষণ বিরক্তিকর। চোখের পক্ষে ক্লান্তিকর। কিন্তু সৌন্দর্যটা দেখলে যে চলবে না। ইনিংসের স্পিরিটটা বুঝতে হবে। আর তখনই দ্রাবিড়কে বোঝা যাবে।
এত কম শব্দে দ্রাবিড়কে ঠিকঠাক ব্যাখ্যা ইদানীংকালে কোনও ক্রিকেট সাংবাদিককেও করতে দেখিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের করা সর্বকালীন মোট রানে গাওস্করকে ছাপিয়ে গিয়েছেন। ৩২ তম সেঞ্চুরি হল। দু’ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে প্রায় তেইশ হাজার রান। টেস্টে সবচেয়ে বেশি ক্যাচ। টেস্ট রান যদি এ ভাবেই বাড়তে থাকে শিগগির পন্টিংকে পিছনে ফেলে সামনে একমাত্র সচিনকে দেখতে পাবেন। কিন্তু সংখ্যার সার্বভৌমত্বর বাইরেও ক্রিকেটে স্বাধীন চেতনা এবং বিশ্বাস থেকে যায়। দ্রাবিড় এখন সেই সাম্রাজ্যেরই প্রতীক।
বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি বয়সি ক্রিকেটার। ৩৮। মাত্র কিছু দিন আগেও যাঁর ক্রিকেটীয় ভবিষ্যৎ নিয়ে শুধু প্রশ্নচিহ্ন নয়। প্রশ্নচিহ্নের একটা গোটা পরিচ্ছেদ হাজির হয়ে গিয়েছিল। নিউজিল্যান্ড সিরিজে দু’টো সেঞ্চুরি করার পরেও প্রাক্তন ডাকসাইটে ক্রিকেটারদেরও বলতে শুনেছি, রাহুল শেষ। কী প্লেয়ার ছিল, আর এখন কী খেলছে! পুরোটা ওর দোষ নয়। ও বুঝতে পারছে না খেলাটা চলে গিয়েছে। অফ স্টাম্পের বাইরে যে বলগুলো ছেড়ে দিত, সেগুলো ছাড়তে পারছে না। আন্দাজটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। স্পোর্টসে বয়সের সঙ্গে এটাই হয়ে থাকে। |
|
লর্ডস’৯৬। সে দিন সেঞ্চুরি থেকে পাঁচ রান দূরে থেমে যান। |
এর সঙ্গে বিষফোঁড়ার মতো ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের সঙ্গে টানা সাড়ে ছ’মাস যুক্ত থাকতে না পারা। টেস্ট ক্রিকেট এখন এত কম হয় যে শুধুমাত্র টেস্ট খেলে এমন প্লেয়ার এখন মন দিয়ে অনায়াসে দশটা-পাঁচটার চাকরি করতে পারে। শুধু আর্নড লিভ নিয়ে ম্যানেজ করে দিতে পারে টেস্ট ক্রিকেট। রাহুল এবং লক্ষ্মণ উৎকৃষ্ট নমুনা। দু’জনেই ২০ জুন জামাইকাতে খেলতে নামার আগে শেষ আন্তর্জাতিক খেলেন ৬ জানুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকায়। কিংস্টনের ওই যমদূতের মতো উইকেটে টানা সাড়ে ছ’মাস বিশ্বপর্যায়ের ক্রিকেট না খেলে ৪০ এবং ১১২।
সর্বোচ্চ মানের প্রতিভা এবং প্রতিজ্ঞা যদি যোগ হয়, একমাত্র তাহলেই যুক্তির এমন ফালাফালা হয়ে যাওয়া সম্ভব।
গত সপ্তাহেও ভারতীয় ক্রিকেট সাংবাদিকদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল আসন্ন ইংল্যান্ড সফরে দু’টো জিনিস দ্রষ্টব্য হবে। সচিনের শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি। রাহুলের অবসর। প্রবল ভোটাধিক্যে বলা হচ্ছিল, বিরাট কোহলিদের জন্য এ বার রাহুলের জায়গা ছেড়ে দেওয়ার সময় এসেছে। বোর্ড সচিব শ্রীনিবাসনের জন্য তিনি ঠেলে ঠেলে জায়গা পাচ্ছেন। সৌরভ হলে কবেই ছুটি হয়ে যেত। জামাইকা সেই অবসর সংক্রান্ত আলোচনাকে এমন কৌতূহলী অলিন্দে নিয়ে ফেলল যেখানে দ্রাবিড়ও সহাস্যে যোগ দিতে পারেন।
শ্রীনিবাসন তাঁর জন্য কঠিন সময়ের কল্পতরু হিসেবে হাজির ছিলেন কি না সেটা কেউ টিভিতে দেখেননি। লোকে টিভিতে যা দেখেছে তা থেকে তর্কহীন সিদ্ধান্ত হল একক ভাবে নায়ক হওয়ার অদৃষ্ট নিয়েই আসেননি কর্নাটকী। নিয়তি নিয়ে বরাবরই দ্রাবিড় শুভানুধ্যায়ীদের তিক্ততম অভিজ্ঞতা। বুধবার রাতের ঐতিহাসিক সংঘর্ষ জয়ের পরেও তাঁরা সিঁদুরে মেঘ দেখছেন। অতীতের যে পশলা কালো মেঘগুলো দেখিয়েছে, রাহুল ভাল খেলা মানেই এক রুটিন: ট্রফিটা নির্ঘাৎ অন্য কেউ নিয়ে বেরিয়ে যাবে। হয় ভারতেরই আর কেউ অসাধারণ কিছু করে দেবে। বা বিপক্ষ আচমকা জিতে তাঁকে জয়ীর বরেণ্য আসন পেতে দেবে না।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের ফল তাঁদের ভুল প্রমাণিত করে আশঙ্কাকেই অমূলক দেখিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাতে কী এসে যেত ভারত জিতলে বা হারলে? দ্রাবিড় তাঁর ব্যক্তিগত মহাযুদ্ধ তো জিতেই গিয়েছেন পনেরো বছর বকেয়া থাকা মামলার রায়ে। সে দিন ৯৫-তে ফিরে গিয়েছিলেন, স্রেফ মন্দ ভাগ্যে। এ বার ডারেন স্যামি মাত্র ৬ রানে তাঁর সহজতম স্লিপ ক্যাচ ফেলে দিলেন। অথচ স্কোরবোর্ডে সেই ক্যাচ ফেলা থাকবে না। থাকবে ১১২। আর ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার। সে দিন যেমন ছিল ৯৫।
২১ জুলাই থেকে আবার লর্ডস টেস্ট। ইংল্যান্ড সিরিজে অবসর নিন বা না নিন, মুক্তির দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে সেন্ট জনস উডের মাঠে রাহুল ঢুকতে পারবেন। বকেয়া সম্মান ঠিক পনেরো বছর পূর্তিতে পেয়ে গিয়েছেন। আর তাঁর এত পুরোনো মামলা জেতা বিশাল তাৎপর্যশালী।
বিশ্বের যাবতীয় আন্ডারডগ ক্রিকেটার, যে যেখানে আছে অসীম প্রেরণা পেয়ে গেল। তারা জেনে গিয়েছে, বিচার বিলম্বিতই হতে পারে চির অস্বীকৃত থাকতে পারে না!
|
|
টেস্ট |
রান |
গড় |
সচিন তেন্ডুলকর |
১৭৭ |
১৪,৬৯২ |
৫৬.৯৪ |
রিকি পন্টিং |
১৫২ |
১২,৩৬৩ |
৫৩.৫১ |
রাহুল দ্রাবিড় |
১৫১ |
১২,২১৫ |
৫২.৬৫ |
|
|
|
|
|
|