|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
বিধান পরিষদ কেন |
পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ প্রবর্তন করিতে চাহে নূতন সরকার। নূতন আকাঙ্ক্ষা নহে। তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির তালিকায় বিধান পরিষদ ছিল। সুতরাং মুখ্যমন্ত্রী বলিবেন, তিনি প্রতিশ্রুতি পালন করিতে চাহেন। সমস্যা একটিই। এই প্রতিশ্রুতি ভুল চিন্তার পরিণাম। ইহা পালন করিলে পশ্চিমবঙ্গের অকল্যাণ, পালন না করিলে তাহার মঙ্গল। কেন? শাসক দল বা দলনেত্রীর সমালোচকদের একটি অংশ বলিবেন, পছন্দসই ব্যক্তিবর্গকে প্রসন্ন করিবার উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হইয়াই মুখ্যমন্ত্রী এই প্রতিষ্ঠানটি তৈয়ারি করিতে চাহেন। এই ধারণা সত্য কি মিথ্যা, তাহা অজ্ঞেয়। কিন্তু অভিসন্ধি বা উদ্দেশ্য খুঁজিবার বুদ্ধিটিই ক্ষুদ্রবুদ্ধি। বাঙালি যত ক্ষুদ্র হইয়াছে, সকল বিষয়ে অভিসন্ধি খুঁজিবার ক্ষুদ্রতা তাহার তত প্রবল হইয়াছে। এই ব্যাধি বিষবৎ পরিত্যাজ্য। বিধান পরিষদ সম্পর্কে যথার্থ আপত্তি কোনও ক্ষুদ্র কারণে নহে, আপত্তি নীতিগত। বিধান পরিষদ গণতন্ত্রে অনাবশ্যক, তদুপরি গণতন্ত্রের পক্ষে হানিকর।
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের যে মডেলটি এ দেশে প্রচলিত, তাহাতে রাজ্য স্তরে বিধানসভা এবং কেন্দ্রীয় তথা জাতীয় স্তরে লোকসভাই প্রধান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আইন প্রণয়নের কাজটি তাহার হাতেই ন্যস্ত। আইনসভার দ্বিতীয় কোনও কক্ষ থাকিলে তাহা এই প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদা হানি করে। কেবল রাজ্যের বিধান পরিষদ নয়, কেন্দ্রের রাজ্যসভাও এই কারণেই অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর। ইহারা কেন? ইহাদের যৌক্তিকতা কোথায়? ইহাদের সদস্যরা কাহার প্রতিনিধি? তাঁহারা যে প্রক্রিয়াতেই নির্বাচিত হউন, পরোক্ষ ভাবে তাঁহাদের জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবেই দেখিতে হইবে, গণতন্ত্রে অন্য কোনও ভাবে আইনসভার সদস্য হইবার নৈতিক অনুমোদন থাকিতে পারে না। কিন্তু জনসাধারণের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিরাই তো লোকসভা এবং বিধানসভার সদস্য। এবং পরোক্ষ জনপ্রতিনিধিরা প্রত্যক্ষ জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব লাঘব করিবেন কোন নৈতিক অধিকারে?
ইহার প্রচলিত উত্তর সুপরিচিত। যুক্তি দেওয়া হয় রাজ্যসভা বা বিধান পরিষদের সদস্যরা তুলনায় প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ, চিন্তায় প্রবীণ, তাঁহারা আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়াটিকে আপন চিন্তায় ঋদ্ধ করিবেন। ইহা কুযুক্তি। প্রথমত, লোকসভা বা বিধানসভার বিভিন্ন বিষয়ে কমিটি থাকে, তাহারা আইন-প্রস্তাব বিবেচনা করে। বিচক্ষণ জনপ্রতিনিধিদের লইয়াই এই সব কমিটি তৈয়ারি হয়, অন্তত হওয়া উচিত। সুতরাং সুবিবেচনার জন্য নূতন সভা গড়িবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। দ্বিতীয়ত, বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা বিদ্বজ্জনের অভিমত জানিবার জন্য তাঁহাদের রাজ্যসভা বা বিধান পরিষদে স্থান করিয়া দেওয়ার দরকার নাই, সরকার বা আইনসভা সর্বদাই তাঁহাদের পরামর্শ গ্রহণ করিতে পারে, করেও। প্রয়োজনে তাঁহাদের লইয়া নির্দিষ্ট কমিটি বা সংস্থা তৈয়ারি করা যায়, পশ্চিমবঙ্গের নূতন সরকার তেমন বিস্তর করিয়াছে। রাজ্যসভার ক্ষেত্রে ইহার পরেও একটি যুক্তি থাকিতে পারিত, সেখানে যদি মার্কিন সেনেট-এর মতো প্রতিটি রাজ্যের সমসংখ্যক প্রতিনিধি থাকিতেন, অর্থাৎ রাজ্যসভায় উত্তরপ্রদেশ এবং মিজোরামের গুরুত্ব সমান হইত। সে ক্ষেত্রে রাজ্যসভা হইত রাজ্য হিসাবেই রাজ্যের প্রতিনিধি। যুক্তরাষ্ট্রে তাহার নিজস্ব যুক্তি আছে। কিন্তু ভারতে তাহাও হয় নাই, লোকসভার মতোই রাজ্যসভাতেও রাজ্যের সদস্যসংখ্যা স্থির হইয়াছে জনসংখ্যার অনুপাতে। তাহার ফলে রাজ্যসভা লোকসভার ‘নকল’ সংস্করণে পর্যবসিত হইয়াছে। এহ বাহ্য। বিধান পরিষদের সমর্থনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওই তাত্ত্বিক এবং সম্ভাব্য যুক্তিও দিতে পারিবেন না, যদি না তিনি এই পরিষদকে জেলার প্রতিনিধি হিসাবে দেখিতে চাহেন। সুতরাং তিনি পত্রপাঠ বিধান পরিষদের উদ্যোগ হইতে বিরত হউন। বরং বিধানসভা যাহাতে যথার্থ গণতান্ত্রিক বিতর্কের পরিসর হইয়া ওঠে, তাহার জন্য যত্নবান হউন। তাহা কেবল পরিবর্তনের সূচক হইবে না, তাহা অবশিষ্ট ভারতকেও পথ দেখাইবে। গণতন্ত্রের পথ। |
|
|
|
|
|