|
|
|
|
সরকার গুছিয়ে নিতে হাতে সময় চান সমস্যায় জেরবার মনমোহন |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
গোড়ায় ঠিক হয়েছিল, সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হবে ২১ জুলাই থেকে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহকে জানান, ওই দিনটা তৃণমূল কংগ্রেস শহিদ দিবস হিসেবে পালন করে। প্রত্যেক বছর ওই দিনটায় নানা রকম কর্মসূচি নেয় তাঁর দল। তাই ওই দিনটা বাদ দিয়ে অন্য যে কোনও দিন থেকে বাদল অধিবেশন শুরু করা হোক। সরকারের সবচেয়ে বড় শরিক দলের প্রধানের অনুরোধে অধিবেশন পিছনোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশাপাশিই কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব আরও একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। তাড়াহুড়ো না করে একেবারে পরের মাসের পয়লা তারিখ থেকে শুরু করা হোক এ বছরের বাদল অধিবেশন।
অধিবেশন পিছিয়ে দেওয়ার পিছনে অবশ্য অন্য একটি অঙ্কও আছে কংগ্রেসের। এই মুহূর্তে একের পর এক সমস্যায় জর্জরিত কংগ্রেস পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য কিছুটা সময় কিনতে চাইছে। দলের আশা, লোকপাল বিল থেকে অর্থমন্ত্রীর দফতরে গোয়েন্দাগিরির অভিযোগ সবক’টি বিষয়ই তত দিনে থিতিয়ে যাবে।
একই ভাবনা প্রধানমন্ত্রীরও। দল এবং সরকারে তিনি নিজে যথেষ্ট সমস্যায়। দিল্লি দরবার সামলানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে তাঁর পক্ষে। সে কারণে সমস্যা সামাল দিয়ে ঘর গোছাতে কিছুটা সময় চাইছেন তিনি। সে কারণেই অধিবেশন পিছনোর প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন তিনিও।
এই মুহূর্তে মনমোহনের সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, দলের একাংশ নানা ভাবে তাঁর বিরোধিতা করতে শুরু করেছে। এবং সেটা বেশ প্রকাশ্যেই। রামদেব থেকে লোকপাল নানা বিষয়ে দল এবং সরকারের মতপার্থক্য প্রকাশ্যে এসে পড়েছে। ইউপিএ-র প্রথম ইনিংসে এ ধরনের ঘটনা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। দিগ্বিজয় সিংহ থেকে জনার্দন দ্বিবেদী সুযোগ বুঝে কংগ্রেসের অনেক নেতা মনমোহনকে এ বছরের শেষে প্রধানমন্ত্রিত্ব থেকে সরানোর প্রস্তাব নিয়ে দলের মধ্যেই আলাপ-আলোচনা শুরু করেছেন। দলের ভিতরে অনেকেই আওয়াজ তুলেছেন, ২০১২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করে দেওয়া হোক মনমোহনকে। রাহুল গাঁধীর জন্মদিনে তাঁকে প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসানোর কথা বলে ঘরের বিতর্ক বাইরে এনে পরিস্থিতি আরও ঘোরালো করে ফেলেছেন দিগ্বিজয় সিংহ। সব মিলিয়ে গভীর সমস্যায় মনমোহন।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে বিদেশ থেকে ছুটি কাটিয়ে ফিরেই মনমোহন সিংহের সঙ্গে আলোচনায় বসেছিলেন সনিয়া গাঁধী। প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে চলে সেই বৈঠক। ১০ জনপথ সূত্রের খবর, সনিয়া স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, ২০১৪ সালে মনমোহন সিংহের নেতৃত্বেই কংগ্রেস লোকসভা নির্বাচনে যাবে। কংগ্রেসের তরফে পরে বিষয়টির সবিস্তার ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। |
|
দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে। পিটিআই |
কিন্তু এত কিছুর পরেও প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে পরিস্থিতি সামলানোটা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে মনমোহনের পক্ষে। সুযোগ বুঝে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বিরোধীরা। বিজেপি বা বাম দু’পক্ষই সরকারের সমালোচনার সুর ক্রমশ চড়াচ্ছে। বাদল অধিবেশনেও সিপিএম এবং বিজেপি-র মধ্যে কক্ষ সমন্বয়ের সম্ভাবনা যথেষ্ট। অরুণ জেটলি-সুষমা স্বরাজের সঙ্গে এ জন্য সীতারাম ইয়েচুরি যোগাযোগ রেখে চলছেন। সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট নিজেও কংগ্রেসকে বেগ দেওয়ার জন্য এই সমন্বয়ের পক্ষে। দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে সরকারকে প্যাঁচে ফেলাটাই আপাতত তাদের লক্ষ্য।
পরিস্থিতি সামাল দিতেই অধিবেশন পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাবে সায় দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সময় নিয়ে সরকারের অন্তর্কলহকে আপাতত সামাল দিয়ে ঘর গোছাতে চাওয়ার পাশাপাশি আরও একটি কাজ সারতে চান তিনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অভিযানকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে বিরোধীদের সমালোচনার তির ভোঁতা করে দিতে। তাঁর অধীনে থাকা সিবিআইকে এ জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছেন মনমোহন। কিন্তু সেখানেও প্রশ্ন আছে। এত কিছুর পরেও শেষ পর্যন্ত দুর্নীতির রাঘব-বোয়ালদের বিরুদ্ধে সত্যি সত্যিই কোনও ব্যবস্থা নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
দল এবং সরকারে তাঁর বিরোধীদের থামাতে আরও একটি কাজ করতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তা হল, মন্ত্রিসভার রদবদল করে প্রশাসনে একটা ঝাঁকুনি দিতে। কিন্তু যা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, তাতে বিদেশ, স্বরাষ্ট্র, অর্থ এবং প্রতিরক্ষা এই চারটি গুরুত্বপূর্ণ দফতরে রদবদলের সম্ভাবনা খুবই কম। কৃষ্ণকে সরিয়ে বিদেশ মন্ত্রক চাইছেন আনন্দ শর্মা। তিনি ১০ জনপথের ঘনিষ্ঠও। কিন্তু মনমোহন এখনই কৃষ্ণকে সরাতে চান না। আবার চিদম্বরম অর্থ মন্ত্রক ফিরে পেতে চান। সে জন্য তিনি প্রণব মুখোপাধ্যায়কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ছেড়ে দিতেও প্রস্তুত।
সমস্যা সেখানেও। এমনিতেই প্রণববাবুর অর্থ এবং চিদম্বরমের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিবাদ ইদানীং দিল্লির সংবাদপত্রগুলির প্রথম পাতায় জায়গা পাচ্ছে। এক দিকে প্রণববাবুর উপদেষ্টা অমিতা পল কেন এত গুরুত্বপূর্ণ, এই অভিযোগ তুলে প্রণব-বিরোধী গোষ্ঠী তাঁকে বিপাকে ফেলতে চান। আবার প্রণববাবুর দফতরে আড়ি পাতার অভিযোগ তুলে চিদম্বরমকে পাল্টা কাঠগড়ায় তোলার চেষ্টা হচ্ছে। প্রণববাবুর অফিসে এবং বাড়িতে গোয়েন্দা লাগিয়ে ফোনে আড়ি পাতার অভিযোগ নিয়ে রাজধানীর রাজনৈতিক মহলও সরগরম। মনমোহন জানেন, এই অবস্থায় দফতর রদবদল করা মানে সমস্যা আরও বাড়িয়ে তোলা। তিনি এখন দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর দফতরের মধ্যেকার সমন্বয়ের অভাব দূর করতে চান।
মনমোহনের সমস্যার শেষ এখানেই নয়। টু-জি স্পেকট্রাম কাণ্ড নিয়ে সিবিআই তদন্তে যখন শিল্পপতি অনিল অম্বানী বিপাকে, তাঁর অফিসারেরা জেল-বন্দি, তখন মুকেশ অম্বানীর গ্যাস-ভাণ্ডারের অনিয়ম নিয়ে সিএজি-র রিপোর্ট কী ভাবে ফাঁস হল, তা নিয়ে দল এবং সরকারের মধ্যে জোর কাজিয়া চলছে।
ফলে এক দিকে কর্পোরেট যুদ্ধ, অন্য দিকে সরকারের অন্তর্কলহ দু’টি নিয়েই নাজেহাল প্রধানমন্ত্রী। কংগ্রেসের অনেকেই মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে এমন কাউকে আনা প্রয়োজন, যিনি এই ধরনের সঙ্কট মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারবেন। রামদেবকে নিয়ে সরকার এবং দলের মধ্যে যে চূড়ান্ত সমন্বয়হীনতা দেখা গিয়েছে, তা এক জন প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সামলানো কঠিন। সরকারের অনেকের অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের প্রতিমন্ত্রী ভি নারায়ণস্বামী এই কাজটি করতে মোটেই সফল নন। বরং পৃথ্বীরাজ চহ্বান এ ব্যাপারে অনেকটাই কার্যকরী ছিলেন বলে তাঁদের মত।
সমস্যা মিটছে না কয়েক জন শরিককে নিয়েও। এর মধ্যে প্রথমেই আছে ডিএমকে। দয়ানিধি মারানের যে কী হবে, তা এখনও অস্পষ্ট। স্পেকট্রাম-কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে এ রাজা গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁর টেলিকম মন্ত্রকের ভার দেওয়া হয়েছিল কপিল সিব্বলকে। সেই দফতর এখন ফিরে পেতে চায় ডিএমকে। অনেকেই মনে করছেন, স্পেকট্রাম-কেলেঙ্কারির পরে টেলিকম মন্ত্রকের ভার ফের ডিএমকে-র হাতে দিলে, কংগ্রেসের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। অন্য কয়েক জন শরিককে নিয়েও অল্পবিস্তর সমস্যা আছে। তবে তুলনামূলক ভাবে তৃণমূল কংগ্রেসকে নিয়ে অনেক নিশ্চিন্ত মনমোহন। সরকারও।
এত সমস্যার মধ্যেও মনমোহন সিংহ একটা ব্যাপারে অন্তত নিশ্চিন্ত।
প্রধান বিরোধী দল বিজেপি এখনও ছত্রভঙ্গ। তাদের নেতৃত্ব দিশাহারা।
আপাতত সেটাই এক মাত্র স্বস্তি! ভরসাও! |
|
|
|
|
|