|
|
|
|
অনুপ্রেরণা সিঙ্গুর, জমি ফেরানোর দাবি বর্ধমান, শিলিগুড়িতে |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
সিঙ্গুরে জমি ফেরতের সিদ্ধান্ত ‘একেবারে আলাদা’। রাজ্য সরকার অন্য জমির ক্ষেত্রে এ ধরনের মনোভাব নিচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারেবারে এ কথা বলছেন। কিন্তু সর্বত্র সে ‘বার্তা’ যে পৌঁছচ্ছে না, রবিবার তার দৃষ্টান্ত মিলল রাজ্যের উত্তর এবং দক্ষিণে।
শিলিগুড়ির উপকন্ঠে প্রস্তাবিত কাওয়াখালি উপনগরী এলাকায় এ দিন একটি বেসরকারি হাসপাতালের কাজ বন্ধ করে দেন জমিহারাদের একাংশ। তাঁদের অভিযোগ, তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রস্তাবিত উপনগরীর জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তাঁরা চান, ‘সিঙ্গুর-মডেলে’ অনিচ্ছুক ব্যক্তিদের জমি ফেরত দেওয়া হোক। আর এ দিনই বর্ধমানের গোদা মৌজায় প্রস্তাবিত স্বাস্থ্য-উপনগরীর জন্য জমিহারা ৮৪ জন কৃষক বর্ধমান দক্ষিণের বিধায়ক তথা রাজ্যের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের কাছে নিজেদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান।
রাজ্য সরকার অবশ্য কোনও ভাবেই সিঙ্গুরের সঙ্গে রাজ্যের অন্য কোনও জায়গাকে এক করে দেখার পক্ষপাতী নয়। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “সিঙ্গুরের কৃষকদের আন্দোলনের সঙ্গে অন্য কোনও জায়গার দাবির তুলনা চলতে পারে না। বিধানসভায় বিলও পাশ হয়েছে সিঙ্গুরের জন্য নির্দিষ্ট ভাবে। এইটা সকলকে বুঝতে হবে। যে কোনও জায়গায় দাবি তুলে কেউ যদি সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফেরতের পথে জটিলতা সৃষ্টি করতে চান, সেটা আলাদা কথা!” শিল্পমন্ত্রী জানান, বর্ধমানের গোদার ঘটনাটি সরকারের জানা নেই। কিন্তু শিলিগুড়ির কাওয়াখালিতে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে মামলা পর্যন্ত গড়িয়ে যাওয়ার পরে এখন আবার নতুন করে ‘জটিলতা’ দেখা দিচ্ছে কেন, তাতে শিল্পমন্ত্রী যথেষ্ট ‘বিস্মিত’!
বস্তুত, তৃণমূলের নেতারাও যদি স্থানীয় স্তরে কোথাও ‘সিঙ্গুর-মডেলে’ জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন, তাঁদের প্রতি ‘কড়া বার্তা’ দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, “জেলা বা রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে কথা না-বলে কোথাও এই ধরনের আন্দোলন করা যাবে না। দলে সকলকেই এটা মনে রাখতে হবে।”
শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এসজেডিএ) উদ্যোগে প্রস্তাবিত কাওয়াখালি উপনগরীর জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০০৮-এ। এসজেডিএ-র তৎকালীন চেয়ারম্যান তথা প্রাক্তন পুরমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য বলেন, “জোর করে জমি নেওয়ার প্রশ্নই নেই। আইন মেনেই জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। তা নিয়ে একটি মামলা হয়েছে।” তাঁর ‘কটাক্ষ’, “সিঙ্গুরে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তাতে জমি ফেরতের এমন দাবি উঠতেই পারে! যাঁরা এখন ক্ষমতায় রয়েছেন, বিষয়টি তাঁরা দেখবেন।” ওই সিপিএম নেতার ‘ইঙ্গিত’, রাজ্যের অন্যত্রও ‘সিঙ্গুর মডেলে’ উৎসাহী হয়ে জমি ফেরত চাইতে পারেন জমিহারারা। সে ক্ষেত্রে সামগ্রিক ভাবেই উন্নয়ন-প্রক্রিয়া বাধা পাবে। তবে উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “এলাকায় গিয়ে জমিহারাদের সঙ্গে কথা বলব। বিশদে জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।”
প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, কাওয়াখালিতে প্রস্তাবিত উপনগরী এলাকায় ১০০ শয্যার হাসপাতাল গড়তে প্রায় ৫ বিঘা জমি নিয়েছিল ওই বেসরকারি সংস্থা। গত বছর এসজেডিএ-র তরফে জমি হস্তান্তর করা হয়। গত কয়েক দিন ধরে ওই জমিতে কাজ শুরু করেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সেই মতো সীমানা প্রাচীর দেওয়ার কাজ হচ্ছিল। এ দিন জমিহারাদের সংগঠন ‘থিকনিকাটা-কাওয়াখালি ল্যান্ড ওনার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর লোকজন সেখানে গিয়ে জমি ফেরতের দাবি তুলে ওই কাজ বন্ধ করে দেয়। ওই সংগঠনের দাবি, হাসপাতালের প্রকল্পে তাদের সদস্যদের প্রায় ১০ কাঠা জমি রয়েছে। তা ছাড়া, জমির মালিকদের একাংশের অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপনগরী প্রকল্পে প্রায় ৩০০ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। ‘জোর করে’ অধিগ্রহণ করার অভিযোগে প্রথমে কলকাতা হাইকোর্ট এবং গত ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা হয়েছে। সংগঠনের সম্পাদক মণিমোহন বিশ্বাস বলেন, “সিঙ্গুর নিয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত আমাদের উৎসাহ জুগিয়েছে। আমরা চাই, সিঙ্গুরের মতো আমাদেরও জমি ফেরত দেওয়া হোক। মুখ্যমন্ত্রীকেও সেই আর্জি জানানো হয়েছে।”
হাসপাতালের তরফে কাজ দেখভালের দায়িত্বে থাকা দীপক শর্মা বলেন, “বিতর্ক না মেটা পর্যন্ত আর কাজ হবে না। এসজেডিএ, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করে, তাঁরা মত দিলে তবেই কাজ হবে।”
বর্ধমানের সমস্যাটি অবশ্য দীর্ঘ দিন ধরেই জিইয়ে রয়েছে। ২০০৬-এ স্বাস্থ্য-উপনগরী প্রকল্পের জন্য বর্ধমানের উপকণ্ঠে গোদা মৌজায় মোট ৫৭ একর জমি অধিগ্রহণ করে বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থা (বিডিএ)। ২০০৭-এ তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রকল্পের শিলান্যাস করেন। এর পরে বিডিএ এবং ‘বেঙ্গল কনসালটেন্সি সার্ভিস প্রাইভেট লিমিটেড’-এর যৌথ উদ্যোগে জমির সীমানা নির্ধারণ ও বালি ভরাটের কাজ শুরু হয়। প্রায় আড়াইশো জমিদাতা ক্ষতিপূরণের চেকও নিয়েছেন। কিন্তু কাজ শুরুর পর থেকেই কিছু ‘অনিচ্ছুক’ চাষি এই অধিগ্রহণ করা জমির একাংশ (প্রায় ২৩ একর) ফেরতের দাবি জানাতে থাকেন। তাঁদের অভিযোগ, জোর করে তাঁদের কাছ থেকে ‘নামমাত্র দামে জমি ছিনিয়ে’ নেওয়া হয়েছে। তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী তথা বর্ধমান উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি নিরুপম সেন এবং বর্ধমান পুরসভার সিপিএমের পুরপ্রধান আইনুল হক বেশ কয়েক বার ওই চাষিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। কিন্তু লাভ হয়নি। যখনই স্বাস্থ্যনগরীর কাজ শুরুর চেষ্টা হয়েছে, ‘অনিচ্ছুক’ চাষিরা বাধা দিয়েছেন। তবে ধীর গতিতে হলেও কাজ চালু ছিল।
ভোটে জিতলে ওই স্বাস্থ্য-উপনগরীর কাজ জোরকদমে শুরু করায় উদ্যোগী হবেন বলে নির্বাচনী ইস্তাহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রবিরঞ্জনবাবু। সেই কারণেই এ দিন গোদায় গিয়ে চাষিদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিলেন তিনি। ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের অন্যতম, গোদার বাসিন্দা খোন্দেকার এনামুল কাদেরের অভিযোগ, “সিপিএম আমার জমি জোর করে কেড়ে নিয়েছিল। আমি চাষ করেই খেতে চাই।” তবে পুরপ্রধান তথা সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য আইনুল হকের দাবি, “আমরা জোর করে কোনও জমি নিইনি। স্বাস্থ্যনগরীর অধিকাংশ জমিই কিছু ব্যবসায়ী কিনে নিয়েছিলেন। ফলে, প্রকল্পের কাজ যখন শুরু হয়, তখন চাষিদের তরফে কোনও বাধাই ছিল না।”
এই পরিস্থিতিতে ‘সিঙ্গুর মডেল’ই যে তাঁদের ‘উদ্দীপিত’ করেছে, তা কার্যত মেনে নিয়েছেন ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের সংগঠন ‘পশ্চিম বর্ধমান কৃষি কল্যাণ সমিতি’-র কার্যকরী সভাপতি খোন্দেকার ফজলুর রহমান। তাঁর কথায়, “২০০৬ থেকেই আমরা জমি ফেরতের দাবিতে আন্দোলন করছি। আমরা আদালতেও গিয়েছি। মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে সিঙ্গুরের অনিচ্ছুক চাষিদের ৪০০ একর জমি ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছেন, আশা করব, তা তিনি গোদার ক্ষেত্রেও করবেন।”
জমি ফেরতের প্রশ্নে তাঁরা যে ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের পাশেই রয়েছেন, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন তৃণমূলের স্থানীয় নেতারাও। বর্ধমান শহর তৃণমূলের দুই নেতা সমীর রায় ও খোকন দাস বলেন, “গোদায় স্বাস্থ্য-উপনগরী হোক তা আমরাও চাই। কিন্তু প্রকল্পের জন্য কতটা জমি দরকার, তা স্পষ্ট নয়। অনিচ্ছুক চাষিদের জমি ফেরত দিয়ে বাকি জমিতে ওই নগরী হোক।” স্থানীয় নেতারা যা-ই বলুন, শিল্পমন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থবাবুর পরিষ্কার বক্তব্য, “সিঙ্গুরের সঙ্গে অন্য কোনও ঘটনাকে কেউ যেন গুলিয়ে না ফেলেন!” পক্ষান্তরে, এ দিনের বৈঠকের পরে মন্ত্রী রবিরঞ্জনবাবু বলেন, “আমরা জোর করে এক ছটাক জমিও নিতে রাজি নই। অনিচ্ছুক চাষিদের এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে, ওঁরাই বিবেচনা করে ঠিক করুন।” |
|
|
|
|
|