বিশেষ যোজনাও চাইবেন মমতা
পাহাড়-জঙ্গলমহলের সাহায্য দেবে কেন্দ্র
ক দিকে জঙ্গলমহল, অন্য দিকে দার্জিলিং। এই দুই এলাকার অনুন্নয়ন দূর করতে এ বার পশ্চিমবঙ্গকে বড় অঙ্কের অর্থসাহায্য দিতে চলেছে কেন্দ্র। আগামিকাল মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নয়াদিল্লি আসার কথা। তিনি এলে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর বৈঠকে এই নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
মাওবাদী এলাকার উন্নয়নে কেন্দ্রের কাছে পাঁচশো কোটি টাকার একটি বিশেষ যোজনা দাবি করছে রাজ্য। এই টাকা বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও পশ্চিম মেদিনীপুরের মতো মাওবাদী অধ্যুষিত জেলার উন্নয়নে কাজে লাগানো হবে। গত বছর বিহারকে ‘অনগ্রসর এলাকা অনুদান তহবিল’ থেকে একটি বিশেষ প্যাকেজ দেওয়া হয়েছিল। এ বার সেই তহবিল থেকেই মাওবাদী এলাকা উন্নয়নে অর্থ চাইছে পশ্চিমবঙ্গ। সূত্রের খবর, তিন জেলার মাওবাদী অধ্যুষিত জঙ্গলমহলের এলাকা নিয়ে একটি পৃথক জেলার প্রস্তাব দিতে পারে কেন্দ্র। জঙ্গলমহলের উন্নয়নে বামফ্রন্ট আমলে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ গড়া হয়। কিন্তু কেন্দ্র মমতাকে যুক্তি দিতে পারে, আলাদা জেলা গড়ে তা মাওবাদী অধ্যুষিত বলে ঘোষণা করা হলে অনুদান অনেক বেশি পাওয়া যাবে।
গত বছর ‘পার্বত্য এলাকা উন্নয়ন কর্মসূচি’ থেকে লাদাখের জন্য একটি বিশেষ যোজনা অনুমোদন করেছিল কেন্দ্র। সেই দৃষ্টান্ত দেখিয়ে দার্জিলিঙের উন্নয়নে দু’বছরের জন্য ন্যূনতম ছ’শো কোটি টাকা চাইছে রাজ্য সরকার। খুব শীঘ্রই পাহাড় নিয়ে ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হতে চলেছে। রাজ্য চাইছে, তার আগেই উন্নয়নের প্যাকেজ চূড়ান্ত করে ফেলতে। কেন্দ্রের সঙ্গে বৈঠকে মমতা এবং সঙ্গী রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এই দু’টি বিষয়েই জোর দেবেন।
বিহারে এনডিএ জোটের সরকার। তা সত্ত্বেও ২০০৫-০৬ সাল থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে বিশেষ যোজনায় নীতীশ কুমারের রাজ্যের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মোট ৮ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। এবং পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছর নীতীশ বরাদ্দ অর্থ রাজ্যের জন্য নিয়েও গিয়েছেন। এই বিশেষ যোজনায় শুধু মাওবাদী অধ্যুষিত জেলার উন্নয়নই নয় অর্থ সাহায্য করা হয় বিদ্যুৎ, জলসেচ, বনাঞ্চল, সড়ক সংযোগের কাজেও। তা ছাড়া, এই তহবিলগুলি শতকরা একশো ভাগ অনুদানভিত্তিক।
মমতার সরকার এখন কেন্দ্রকে বলছে, নীতীশকে যদি এত টাকা দেওয়া হয়, তা হলে পশ্চিমবঙ্গকে কেন পাবে না? রাজ্যের যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গ চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে। তাই কেন্দ্রের বিশেষ সহযোগিতাও প্রয়োজন। তবে জঙ্গলমহল ও পাহাড়ের জন্য অর্থসাহায্য চূড়ান্ত করতে শুধু অর্থ মন্ত্রক নয়, যোজনা কমিশনের সঙ্গেও রাজ্যকে কথা বলতে হবে। তাই প্রণববাবুর সঙ্গে বৈঠকের পর মমতা যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়ার সঙ্গেও আলোচনায় বসবেন। বুধবার এই বৈঠক হওয়ার কথা।
শুধু জঙ্গলমহল বা পাহাড়ই নয়, সামগ্রিক ভাবে রাজ্যের জন্য কী করা সম্ভব, তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করছে মমতার সরকার। কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ হওয়া সত্ত্বেও নিয়মের জটে আটকে আসেনি, তার হিসেবও কষছে তারা। সঙ্গে থাকছে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি।
যেমন, এখন অনুন্নত এলাকার জন্য ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ। এই টাকা অনেকটা বাড়ানোর জন্য দাবি করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও রাজ্য
দেড়শো কোটি টাকা খরচ করতে পারেনি। চলতি ব্যয়বরাদ্দে এই প্রকল্পে প্রায় পাঁচশো কোটি টাকা চাইছে তারা। সড়ক ক্ষেত্রে ইতিমধ্যেই প্রণববাবু অর্থসাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রে একশো থেকে দেড়শো কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়াতে চাইছে রাজ্য। ২০০৯-এ আয়লার পর সুন্দরবনের বাঁধ তৈরির জন্য এক হাজার কোটি টাকার একটি বিশেষ যোজনা ঘোষণা হয়েছিল। কিন্তু পাওয়া গিয়েছিল ৫০৭ কোটি টাকা। এই খাতেও ৪৪০ কোটি টাকা রাজ্য পাবে। তিস্তা জলসেচ প্রকল্পে গত বছরে মাত্র ৭০ কোটি টাকা তোলা হয়েছিল। তার আগের বছর কিছুই হয়নি। এই খাতে মোটা টাকা রাজ্য পেতে পারে রাজ্য। মেগা-ট্যুরিস্ট সার্কিট তৈরির জন্য ২০০ কোটি টাকার সুসংহত যোজনা রাজ্য পেশ করতে পারে। যে সব রাজ্য চূড়ান্ত ঋণগ্রস্ত, তাদের জন্য বিশেষ অনুমোদন হলে অর্থ সাহায্য পাওয়া যায় ‘কনসলিডেটেড সিঙ্কিং ফান্ড’ থেকেও। পশ্চিমবঙ্গ এখান থেকেও দু’হাজার কোটি টাকা নিতে পারে। সাধারণত, কোনও রাজ্য ওভারড্রাফ্ট নিলে এই তহবিল থেকে টাকা দেওয়া হয় না। বাম আমলে বহু বার পশ্চিমবঙ্গ ওভারড্রাফ্ট নিয়েছে। এ বার কিন্তু আর ওভারড্রাফ্টের পথে হাঁটছে না মমতার সরকার। আগামী ৩-৪ বছরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক থেকে যাতে তিন হাজার কোটি টাকা ঋণ পাওয়া যায়, সে জন্য রাজ্য ইতিমধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে।
বাজেট ঘাটতি কমাতে ঠিক সময়ে ‘ফিসক্যাল রেসপন্সিবিলিটি অ্যান্ড বাজেট ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট’ বা আর্থিক দায়বদ্ধতা এবং বাজেট নিয়ন্ত্রণ আইন চালু করতে পারেনি রাজ্য। তাই কেন্দ্র দ্বাদশ অর্থ কমিশনের আওতায় রাজ্যকে অনুদান দেয়নি। দেখা যাচ্ছে, এই আইন চালু না হওয়ায় ২০০৫-’০৬ থেকে ২০০৯-’১০ সাল পর্যন্ত রাজ্যের ৩ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। সিএজি-র হিসেবেই এ কথা বলা হয়েছে। ফলে সঙ্কট আরও বেড়েছে।
এ বার অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রের নেতৃত্বে আর্থিক সঙ্কট থেকে বেরতে চাইছে রাজ্য। কেন্দ্র বলছে, শুধু এককালীন অর্থসাহায্য নিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। আগে রাজ্যে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক শৃঙ্খলা আনতে হবে। সে জন্য ভর্তুকি কমাতে হবে। কর সংগ্রহ বাড়াতে হবে। খাদ্যপণ্যের উপর কর বসানো যেতে পারে। ভ্যাট বা যুক্তমূল্য করের হার ৪ থেকে ৫ শতাংশ করা যেতে পারে। সম্পত্তি নথিভুক্তকরণের মতো ক্ষেত্রে কর ফাঁকি বন্ধ করতে হবে। পরিকাঠামো ক্ষেত্রে উন্নয়নও জরুরি, যার ফলে শিল্পায়নে গতি আসতে পারে। যেমন, জাতীয় সড়কের জন্য বরাদ্দ টাকা কাজে লাগালে পরে তা শিল্পায়ন ও উন্নয়নে সাহায্য করবে। এ বিষয়ে প্রণব-মমতা একমত।
এর পাশাপাশি কিছু মধ্যমেয়াদি কর্মসূচির কথাও বলেছে কেন্দ্র। সেগুলি হল কৃষি, জল ব্যবস্থাপনা, রাস্তা-সেতু এবং ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে তোলা। কয়লার রাজস্ব নিয়ে ১৯৮১ থেকে রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের বিতর্ক চলছে। সেই সময় থেকেই রয়্যালটির হারের সংশোধন করা হয়নি। ফলে রাজ্যের ৫ হাজার কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অন্য রাজ্য যেখানে ‘নন-কুকিং’ কয়লায় প্রতি টনে ২০৯ টাকা রয়্যালটি পায়, সেখানে পশ্চিমবঙ্গ পায় মাত্র সাড়ে পাঁচ টাকা। কারণ একটাই, রাজ্য সরকার কয়লায় উপর সেস নিয়ে থাকে। সেই পদ্ধতি বদলে পশ্চিমবঙ্গ এখন শুধু রয়্যালটি নেওয়ার কথা বলতে পারে। তা হলে আয় অনেক বেড়ে যাবে।
প্রণববাবু বহু দিন ধরেই রাজ্যকে পরিকল্পনা-বহির্ভূত ব্যয় কমাতে বলছেন। জ্যোতিবাবু যখন মুখ্যমন্ত্রী, তখন যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি এই পরামর্শ দিতেন। পশ্চিমবঙ্গে এক টাকার মধ্যে ৭ পয়সা উন্নয়নে খরচ হয়। বাকি ৯৩ পয়সা খরচ হয় সরকারি কর্মীদের বেতন, কেন্দ্রীয় ঋণের উপর সুদ আর ভর্তুকি দেওয়ার মতো পরিকল্পনা-বহির্ভূত খাতে।
কেন্দ্র ও রাজ্য এখন একমত যে, ‘ব্যয় সংস্কার কমিশন’ তৈরি করা হতে পারে। কমিশন পুরো যোজনা বরাদ্দ ব্যয়ের হাল হকিকত খতিয়ে দেখে ভবিষ্যতের রাস্তা ঠিক করবে। কেন্দ্র মনে করছে, শিল্প Sক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মতো পশ্চিমবঙ্গকেও ‘বিশেষ ইনসেনটিভ প্যাকেজ’ দেওয়ার কথা ভাবা যেতে পারে।
মমতার কাছে এই মুহূতে কেন্দ্রের আর্থিক সাহায্য চূড়ান্ত করাটাই অগ্রাধিকার। দিল্লি এসে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও রাজ্যের সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন তিনি।
Previous Story Rajya Next Story


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.