|
|
|
|
বাঁধে বাঁধে ফাটল, বন্যার মুখে জল না-ছাড়তে আর্জি মমতার |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
একে তিন দিনের প্রবল বর্ষণ।
তার উপরে উপচে পড়া বিভিন্ন জলাধার থেকে মাঝেমধ্যেই জল ছাড়তে হচ্ছে।
তারও উপরে চাপ বাড়তে থাকায় পাঞ্চেত ও মাইথন জলাধার থেকেও জল ছাড়তে চাইছে ডিভিসি।
তিনে মিলিয়ে বন্যা পরিস্থিতির মুখোমুখি পশ্চিমবঙ্গ।
দক্ষিণবঙ্গে বিভিন্ন নদীর বাঁধে ফাটল ধরেছে। জলাধারগুলি উপচে পড়ছে। রবিবার সন্ধ্যায় ডিভিসি এ রাজ্যের সেচসচিবকে জানিয়ে দিয়েছে, পাঞ্চেত ও মাইথন জলাধারে জলের চাপ বেড়ে গিয়েছে। তাই তাদের ১০ থেকে ১২ হাজার কিউসেক জল ছাড়তেই হবে। এই অবস্থায় হাওড়া, হুগলি ও বর্ধমান জেলাকে সতর্ক করে দিয়েছে মহাকরণ। ডিভিসি জল ছাড়লে বিশেষ করে ওই তিন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে সেচ দফতর।
পরিস্থিতির মোকাবিলায় কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, তা ঠিক করতে সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসেন। সেখানে ঠিক হয়েছে, রাজ্যের উদ্বেগজনক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ডিভিসিকে জল না-ছাড়তে অনুরোধ করবে পশ্চিমবঙ্গ। যদি একান্তই জল ছাড়তে হয়, তার জন্য তিন জেলাকে সতর্ক করে দেওয়ার সময় দিতে হবে। আর জল ছাড়তে হবে দিনের বেলায়। যাতে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সমস্যা না-হয়। সেচমন্ত্রী বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ, আগে মানুষকে সতর্ক করতে হবে। মানুষকে বাঁচিয়ে তবে জল ছাড়ার প্রশ্ন।” বন্যা হলে বিপন্ন মানুষ যাতে দ্রুত ত্রাণ পান, সেই জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ হাতের কাছে যা পাওয়া যাবে, তা নিয়েই উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। ত্রাণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনীতির রং দেখে যাতে কোনও বৈষম্য করা না-হয়, সেই নির্দেশও দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
নিম্নচাপের প্রভাবে প্রবল বর্ষণে দক্ষিণবঙ্গের সব জেলাতেই বহু নদীবাঁধের অবস্থা শোচনীয় বলে সেচ দফতরে রিপোর্ট এসেছে। উত্তরবঙ্গের মালদহের পরিস্থিতিও খারাপ হচ্ছে। পরিস্থিতি বিচার করে রাজ্যের সর্বত্র ক্ষতিগ্রস্ত নদীবাঁধগুলির পাশের বাসিন্দাদের সতর্ক করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। প্রয়োজনে তাঁদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের নদীগুলির জলধারণ ক্ষমতা কমে যাওয়ায় তারা বর্ষার প্রথম বৃষ্টির ধকল নিতে পারেনি। বাঁধের উপরে প্রচণ্ড চাপ পড়ছে। সেই কারণেই সেগুলিতে ফাটল ধরছে বলে সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারেরা জানান।
পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে তুলেছে ঝাড়খণ্ডের অতিবৃষ্টি। সেচমন্ত্রী বলেন, “একেই তো এই রাজ্যে বিভিন্ন নদীবাঁধের অবস্থা খারাপ। রাজ্যের কয়েকটি এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তার উপরে মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধার থেকে জল ছাড়লে বর্ধমান, হুগলির বিস্তীর্ণ এলাকা ভেসে যাবে।” রাজ্যের সব মন্ত্রী, সাংসদ এবং বিধায়ককে নিজেদের এলাকায় গিয়ে পরিস্থিতির উপরে নজর রাখার আর্জি জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বিশেষ কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে মহাকরণে। সেটির দায়িত্ব চার মন্ত্রীকে ভাগ করে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মন্ত্রী মণীশ গুপ্ত এবং বিপর্যয় মোকাবিলা মন্ত্রী জাভেদ খান পালা করে কন্ট্রোল রুমে থাকবেন। সমন্বয়ের দায়িত্ব বর্তেছে সেচমন্ত্রী মানসবাবুর উপরে। কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে সল্টলেকের জলসম্পদ ভবনেও।
রাজ্য সরকারকে ভাবাচ্ছে বিভিন্ন জেলার নদীবাঁধের অবস্থাও। সেচ দফতর সূত্রের খবর, উত্তর ২৪ পরগনায় সুন্দরবন এলাকায় ১৮৫টি জায়গায় নদীবাঁধে ফাটল ধরেছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সুন্দরবন এলাকায় নদীবাঁধে ৪০০টি জায়গায় ফাটল দেখা দিয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমা ব্লকের বাঘডাঙা, দেবনগর, বোটখালি, রামতনুনগর, নামখানা, সাগরদ্বীপ, কাকদ্বীপ, গোসাবা, বাসন্তীর বিস্তীর্ণ এলাকার নদীবাঁধের অবস্থা উদ্বেগজনক। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় জল ঢুকছে। ইছামতী, রায়মঙ্গল, কলাগাছি নদীতে কোথাও ফাটল ধরেছে, কোথাও বা নদীবাঁধ বসে যাচ্ছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল, দাসপুর, চন্দ্রকোনা, কেশপুর ডেবরা, সবং-সহ বিস্তীর্ণ এলাকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। কেলেঘাই, কপালেশ্বরীর বাঁধের অবস্থাও খুব খারাপ বলে জানান সেচমন্ত্রী। দাসপুরে জলের তোড়ে ক্রেন কাজ করছে না। তিন দিনের প্রবল বর্ষণে কংসাবতী, দ্বারকেশ্বর, গন্ধেশ্বরী, শিলাবতী, রূপনারায়ণ নদীর জল বিপজ্জনক মাত্রার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। কংসাবতীর বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে ডেবরা ব্লকের ১০-১২টি গ্রাম। বিকেলের দিকে দাসপুরের নিজামপুরে কংসাবতীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকতে শুরু করে দাসপুর-২ ব্লকের বেশ কিছু গ্রামে। বর্ধমানের দাঁইহাট, মঙ্গলকোটের অজয় নদের বাঁধের অবস্থাও বিপজ্জনক। নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ-সহ উত্তরবঙ্গের নদীগুলিও ফুলেফেঁপে উঠেছে। ওই সব নদীর বাঁধের উপরেও সতর্ক নজর রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেচমন্ত্রীর অভিযোগ, গত ৩৪ বছরে নদীবাঁধগুলি মেরামত করা হয়নি। ফলে অবস্থা সঙ্গিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রবল বর্ষণে মালদহের মানিকচকে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ভাঙন রোধের কাজ। কিন্তু ফরাক্কা ব্যারাজ-কর্তৃপক্ষ তা জেলা প্রশাসনকে না-জানানোয় জেলাশাসক রাজেশ সিংহ ক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, “বাঁধের কাজ যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এ কথা কেউ আমাকে জানায়নি। তা ছাড়া এই সময় তো ভাঙন রোধের কাজ করার কথা নয়। অনেক আগেই ভাঙন রোধের কাজ শেষ করার কথা ছিল।” ফরাক্কা ব্যারাজ প্রজেক্টের জেনারেল মানেজার এ কে সিংহ বলেন, “শনিবার পর্যন্ত মানিকচকে ভাঙন রোধের কাজ হয়েছে। রাতভর প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় ভাঙন রোধের কাজ বন্ধ করতে হয়েছে।” ভাঙন রোধের কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মানিকচকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। হুগলির আরামবাগ মহকুমাতেও বাঁধ ভাঙার উপক্রম হয়েছে ১৪টি জায়গায়। দ্বারকেশ্বর নদে সবে মাত্র ২৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে কংসাবতী ব্যারাজ থেকে। তাতেই এই অবস্থা। |
|
|
|
|
|