স্বামী, ননদও খুন ব্যারাকপুরে
পুলিশের নাছোড় প্রেম, গুলিতে ঝাঁঝরা বধূ
কালবেলায় ব্যারাকপুরে বায়ুসেনা ছাউনির ফটকের পাশের মাঠ থেকে এলোপাথাড়ি গুলির শব্দ। ছুটে গেলেন এলাকার বাসিন্দারা। মাঠের পাশে পৌঁছে আতঙ্কে চোখ বুজে ফেললেন অনেকে। মাঠের এক ধারে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন দুই মহিলা-সহ মোট তিন জন। স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে তাঁদের ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছে। আর কাঁধে রাইফেল ঝুলিয়ে গটগটিয়ে আর্দালিবাজারের দিকে চলে যাচ্ছেন উর্দি পরা এক কনস্টেবল।
সকাল সাড়ে ৮টার ঘটনা। পুলিশ জানায়, ওই কনস্টেবলের নাম পীযূষকান্তি ঘোষ। নিহতেরা হলেন সর্বাণী পাল (৩০) ও মানবেন্দ্র পাল (৪০) নামে এক দম্পতি এবং মানবেন্দ্রবাবুর দিদি রোহিণী রায় (৪৫)। প্রাথমিক ভাবে পুলিশের অনুমান, প্রণয়ঘটিত কারণেই এই খুন। নিহতদের পরিবার এবং এলাকার বাসিন্দারা তদন্তকারীদের জানান, সর্বাণীদেবীর সঙ্গে ওই কনস্টেবলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক নিয়ে এলাকায় এবং সর্বাণীদেবীর পরিবারের মধ্যেও অনেক জলঘোলা হয়েছে বলে জানতে পেরেছেন তদন্তকারীরা।
ডিআইজি (প্রেসিডেন্সি রেঞ্জ) সিদ্ধিনাথ গুপ্ত বলেন, “পীযূষের বাড়ি মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থানা এলাকার সাগরপাড়ায়। তাঁর সঙ্গে সর্বাণীদেবীর সম্পর্ক ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। তার জেরেই এই খুন কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” তিনি জানান, পীযূষ শনিবার রাত ১০টার পর থেকে সার্ভিস রাইফেল এবং ৫০ রাউন্ড কার্তুজ-সহ নিখোঁজ। তাঁর খোঁজ চলছে।
মানবেন্দ্র ও সর্বাণী পাল (পারিবারিক অ্যালবামে)
পুলিশ জানায়, রাজ্য সশস্ত্র বাহিনীর অষ্টম ব্যাটেলিয়নের কনস্টেবল পীযূষ ব্যারাকপুর লাটবাগানে ‘সেন্ট্রি’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। শনিবার রাত ১০টায় তাঁর ‘ডিউটি’ শেষ হয়। তার পরেই সার্ভিস রাইফেল নিয়ে বেপাত্তা হয়ে যান তিনি। রবিবার সকালে উর্দিধারী পীযূষকে রাইফেল হাতে পলতা স্টেশনে ঘুরতে দেখেন স্থানীয় মানুষ। তদন্তে জানা গিয়েছে, ওই সময় স্টেশনে আসেন সর্বাণীদেবী, মানবেন্দ্রবাবু ও রোহিণীদেবী। রোহিণীদেবীর ১৯-২০ বছরের ছেলে সমীরণ, সর্বাণীদেবীর ভাই বিভাস সরকার এবং রূপম নামে তাঁর এক বন্ধুও তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।
বিভাস পুলিশকে জানান, সকালে মানবেন্দ্রবাবুই ফোন করে তাঁদের পলতা স্টেশনে চলে আসতে বলেন। সাংসারিক অশান্তি মেটাতে আলোচনার জন্য সবাই জড়ো হয়েছিলেন। স্টেশনের ভিড়ে কথা বলতে অসুবিধা হচ্ছে দেখে পীযূষই তাঁদের সকলকে ওই মাঠে যেতে বলেন। তখন তাঁর কাঁধে রাইফেল ছিল। স্টেশন থেকে একটি অটোরিকশা ভাড়া করে সবাই যান মাঠের কাছে। সেই অটোয় পীযূষও ছিলেন। বিভাস ও রূপম অবশ্য অটোয় ওঠেননি। তাঁরা দু’জনে একটি মোটরবাইকে মাঠে পৌঁছন বলে বিভাস পুলিশকে জানিয়েছেন। সমস্যা মেটাতে বাড়ি ছেড়ে কোনও নিরিবিলি জায়গা বেছে নেওয়া এবং সেখানে রাইফেল নিয়ে পীযূষের উপস্থিতিই পুলিশকে সংশয়ে ফেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, পীযূষের ডাকে স্ত্রী, দিদিকে নিয়ে মানবেন্দ্র কেন ওখানে যাবেন? বিশেষ করে যখন ওই কনস্টেবলের কাছে রাইফেল আছে?
ঠিক কী ঘটেছিল ওই মাঠে?
বিভাসের কথায়, “আমি, সমীরণ এবং রূপম একটু দূরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। পীযূষের সঙ্গে দিদি (সর্বাণী) ও জামাইবাবুর (মানবেন্দ্র) বচসা হচ্ছিল। কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলেন জামাইবাবুর দিদি। আচমকা পীযূষ হাতের রাইফেল উঁচিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে শুরু করে। দিদি, জামাইবাবু ও রোহিণীদি মাটিতে পড়ে যান। আমরা ভয়ে পালিয়ে যাই।”
পুলিশ জানিয়েছে, গুলির শব্দ শুনে ঘটনাস্থলে যান স্থানীয় বাসিন্দারা। মোহন যাদব নামে এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “পাশেই সেনা ছাউনি। অথচ দিনের বেলা নাগাড়ে গুলি চালিয়ে উর্দি পরা ওই কনস্টেবল হেঁটে চলে গেল। কেউ তাকে আটকানোর সাহস পায়নি।” স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এক জন কনস্টেবল রাত ১০টায় ডিউটির শেষে রাইফেল ও কার্তুজ নিয়ে লাটবাগান থেকে বেরিয়ে গেলেন, অথচ কেউ তাঁর খোঁজ করল না! পুলিশের এই দায়িত্বহীন আচরণের প্রতিবাদে কংগ্রেসের পক্ষ থেকে এ দিন ব্যারাকপুর থানায় বিক্ষোভ দেখানো হয়। কংগ্রেসের দাবি, মানবেন্দ্রবাবু তাদের দলের কর্মী ছিলেন।
গুলিতে নিহত দম্পতির দেহ। ছবি: বিতান ভট্টাচার্য
সর্বাণীদেবীর সঙ্গে পীযূষের সম্পর্কের ব্যাপারে এলাকার বাসিন্দা ও সর্বাণীদেবীর পরিবারের কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন তদন্তকারীরা। মানবেন্দ্র-সর্বাণীর ন’বছরের একটি ছেলে এবং পাঁচ বছরের একটি মেয়ে আছে। পুলিশ জানিয়েছে, সর্বাণীদেবীর সঙ্গে অবিবাহিত পীযূষের পরিচয় বছর ছয়েক আগে। নিজেকে এমবিএ-র ছাত্র বলে পরিচয় দিয়ে সর্বাণীদেবীর বাপের বাড়ির একতলায় একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন পীযূষ। বিবাহিতা সর্বাণীদেবী মাঝেমধ্যেই বাপের বাড়িতে আসতেন। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পীযূষের ঘনিষ্ঠতা হয়। ওই সম্পর্ক নিয়ে জলঘোলা হয় এলাকাতেও। তার পরেই সর্বাণীদেবীর আত্মীয়-পরিজনদের চাপে পড়ে পীযূষ ওই বাড়ি ছেড়ে চলে যান। কিন্তু সর্বাণীদেবীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আগের মতোই ছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
সর্বাণীদেবীর বাবা বিজয় সরকার বলেন, “এর পরেও আমার মেয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত পীযূষ। এই নিয়ে মেয়ে-জামাইয়ের মধ্যে অশান্তি হয়েছে বিস্তর। মিটমাটও হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের মতো করে বাঁচতে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে স্ত্রী আর দুই সন্তানকে নিয়ে মানবেন্দ্র সম্প্রতি একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতে শুরু করেছিল। কিন্তু এ দিন কেন এমন হল, বুঝতে পারছি না।” এ দিনের ঘটনার পরে সর্বাণীদেবীর ছেলেমেয়ে আছে রোহিণীদেবীর বাড়িতে।
কাশীপুর গান অ্যান্ড শেল ফ্যাক্টরির কর্মী মানবেন্দ্রবাবু বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন পলতা এলপি এলাকায়। গত দেড় মাসে পীযূষ অন্তত ১২ বার সেই বাড়িতে গিয়েছে বলে জেনেছে পুলিশ। মানবেন্দ্রবাবুর বাড়িওয়ালা মৃদুল বিশ্বাসও বলেন, “বাড়ির একতলা ভাড়া নিয়েছিলেন ওই দম্পতি। মানবেন্দ্রবাবু যখন বাড়িতে থাকতেন না, প্রায়ই একটি লোক মোটরবাইক নিয়ে আসত। দীর্ঘ ক্ষণ থাকত।” পীযূষই ওই মোটরবাইক আরোহী কি না, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
এ দিন ঘটনার পরে মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি থানার সাগরপাড়ায় পীযূষের বাড়িতে যোগাযোগ করা হয়। তাঁর বাবা অশোককুমার ঘোষ বলেন, “শনিবার রাতেও ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু বুঝতে পারিনি। কেন এই ঘটনা ঘটল, সেই ব্যাপারে আমরাও অন্ধকারে।”
First Page South Next Story



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.