|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
কঠোরতাই কাম্য |
প্রস্তাবিত লোকপাল বিল লইয়া বিগত কিছুকাল ধরিয়াই ভারতীয় রাজনীতি আলোড়িত। এই বিষয়ে রাজনৈতিক সমাজ এবং জনসমাজের ভিতরে একটি আড়াআড়ি বিভাজনের সৃষ্টি হইয়াছে। আন্না হাজারে তাঁহার প্রথম দফায় ‘সফল’ অনশনের পরে সরকারের সহিত কথাবার্তা শুরু করিয়াছিলেন। সেই আলোচনায় ফের জটিলতার সৃষ্টি হওয়ায় তিনি পুনরায় আরও এক দফা অনশনের হুমকি দিয়াছেন। সাম্প্রতিক সংবাদ অবশ্য তাঁহার নিকট ঈষৎ নেতিবাচক ঠেকিতে পারে, কারণ এই দ্বিতীয় দফার অনশনটি লইয়া তাঁহার নিজ শিবিরের মধ্যেই কিছু মতদ্বৈধ দেখা গিয়াছে। অন্য দিকে, যোগগুরু বাবা রামদেব অনশন লইয়া দিল্লির রামলীলা ময়দানে বাহ্বাস্ফোটের পরে অন্তিমে হাসপাতালের শয্যায় গিয়া খাদ্যগ্রহণ করিয়াছেন। প্রাথমিক দিশাহীনতা এবং নমনীয় মনোভাব ছাড়িয়া কেন্দ্রীয় সরকারও এই বিষয়ে কঠোর মনোভঙ্গি গ্রহণ করিয়াছে। আন্দোলনকারীদিগের বিষয়ে দৃঢ় মনোভাব গ্রহণের পাশাপাশি রাজনৈতিক তৎপরতাও শুরু হইয়াছে। লোকপাল লইয়া গঠিত সরকারি কমিটির প্রধান প্রণব মুখোপাধ্যায় এই বিষয়ে বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের চিঠি দিয়াছেন। এই তৎপরতাটি প্রশাসনিক স্তরে কিছু তাৎপর্যপূর্ণ খাতবদলের ইঙ্গিত দেয়। মাত্র কিছু কাল পূর্বে নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে বাবা রামদেবকে বুঝাইবার জন্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর আগমন যদি কেন্দ্রীয় সরকারের নমনীয়তার স্মারক হয়, তাহা হইলে সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডগুলি প্রশাসনিক কঠোরতার চিহ্ন। এই মনোভাবটি ধরিয়া রাখা জরুরি, কারণ তাহার ফলও মিলিতে শুরু করিয়াছে। ‘আইনের চক্ষে সমতা’-র সূত্র ভারতীয় গণতন্ত্রের সাংবিধানিক কাঠামোয় বিচারব্যবস্থার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। সেই সূত্রটি বলিতেছে, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার সম্মুখে প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকই সমান, এবং আইন তাঁহাদের সকলের সহিতই সমান আচরণ করিবে। অর্থাৎ, বিশেষ কোনও পদমর্যাদা বা অন্য কোনও ক্ষমতার সুবাদে কেহই আইনকে নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করিতে পারিবেন না। ভারতীয় বিচারব্যবস্থার এই মৌলিক সূত্রটি যদি মানিতে হয়, তাহা হইলে ‘লোকপাল’-এর ন্যায় সমান্তরাল আরও একটি বিচারব্যবস্থার যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। ভারতের বিভিন্ন আদালতে বিভিন্ন সময় বিবিধ মন্ত্রী এবং তদ্রূপ ক্ষমতাবান ব্যক্তিকে কাঠগড়ায় দাঁড়াইতে হইয়াছে। অর্থাৎ, ভারতীয় বিচারব্যবস্থার আদর্শ কাহাকেও ‘বিশিষ্ট’ বলিয়া রেহাই দেয় নাই। এই আদর্শায়িত বন্দোবস্তটি বাস্তবে যে ভাবে বলবৎ হয়, তাহা লইয়া বিভিন্ন মত থাকিতেই পারে। বাস্তবের মাটিতে পুঁথিবদ্ধ আইনের প্রয়োগে নানাবিধ উত্থানপতন দেখা যায়। তাহা লইয়া বিতর্ক চলিতে পারে, কিন্তু সেই বিতর্কে আদর্শটির মহিমা ক্ষুণ্ণ হয় না। একই সঙ্গে, ইহাও স্বীকার করা কর্তব্য যে বিধিবদ্ধ আইন অবিকল গ্রন্থভুক্ত পথে চলিবে, তাহা কোনও কল্পরাষ্ট্রে ঘটিলেও ঘটিতে পারে, কোনও পার্থিব ভূমিতে তাহা ঘটা নিতান্তই অসম্ভব স্বীকার করিলে ইহাও কবুল করা কর্তব্য যে, ‘লোকপাল’-এর প্রবর্তন অপেক্ষা দেশে আরও অনেক জরুরি কাজ আছে যাহা আশু মনোযোগ দাবি করে। দেশের জাগ্রত জনসমাজ যদি একান্তই সক্রিয় হইবার সংকল্প করে, তাহা হইলে কর্তব্যের অভাব হইবে না। কেন্দ্রীয় সরকার তাহার পূর্বতন দ্বিধা ঝাড়িয়া ফেলিয়া যে ভাবে বিষয়টির মোকাবিলা করিতেছে, তাহাই সঙ্গত। এই বিষয়টি লইয়া অকারণে নমনীয়তা বিভ্রান্তিই বাড়াইবে শুধু, নতুন কোনও দিশার সূচনা করিবে না। এই বিষয়ে ভারতীয় জন-সমাজের তরফেও গভীরতর ভাবনাচিন্তা জরুরি। সংশয় জাগে, লোকপাল লইয়া তাঁহাদের সাম্প্রতিক কোলাহলের ভিতরে সেই যুক্তির স্বরটি ক্রম-বিলীয়মান নহে তো? |
|
|
|
|
|