|
|
|
|
|
|
|
|
মাধু মাধবী সংক্রান্ত |
মণিরত্ন মুখোপাধ্যায় |
দাদু ছিলেন টুলো পণ্ডিত, বাবা ছিলেন পুরোহিত, সবাই পুরুতমশাই বলত। অসম্মান করার জন্যে নয়, গ্রামের মানুষজন অমনিই। ইদানীং সেই পুরুতমশায়ের ছেলে দশরথ গাঁয়ের একমাত্র পুজো করার লোক। পরের হিত করে বেড়ায় সে, কিন্তু তেমন একটা পারিশ্রমিক পায় না। আতপচালটা, শুকনো বেগুনটা দিয়ে কি আর সংসার চলে? অতএব দশরথ একা, বিয়ে করার কথা ভাবতে পারেনি। সরকার থেকে প্রতিটি মানুষের শ্রমের সর্বনিম্ন পারিশ্রমিক বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু পুরোহিতদের দক্ষিণার রেট বলে কিছু নেই। এক টাকা দক্ষিণা দিয়ে মনে করে বেশি দেওয়া হল। এই বংশে পুত্র-কন্যা হওয়ার ইতিহাস আলোচনা করলে দেখা যাবে, দাদুর ছিল তিন মেয়ে, বাবারও তিন। দাশুর অবশ্য এখনও নেই, বিয়েই হয়নি তার ছেলে অথবা মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে দিতে দিতে ফতুর হয়ে গেছেন পূর্বপুরুষেরা। তার দায় এসে পড়েছে দাশুর কাঁধে।
মন্দের ভাল তার ঘরে একটা গাইগরু আছে, কিন্তু সে দুধ দেয় না কেবল গোবর দেয়। তার বাছুর দেওয়ার বয়স পেরিয়ে গেলেও বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। এ বংশের নিয়ম মেনে তার যদি গোটা তিনেক কন্যাসন্তান থাকত, তা হলেও দাশুর কিছু সুরাহা হত। গাইটি নিজে নিজে চরতে চলে যায়, এ দিকে ও দিকে মুখ দেয় না, কারও কোনও ক্ষতি করে না। নিজে নিজে ফিরে আসে ঘরে। তার মনিবের মতোই সে নির্বিরোধ নিরহঙ্কার। কনে বউটির মতো তার ব্যবহার। গাইটার নাম মাধবী। কেন তার এ হেন সুন্দর নাম দিয়েছে দাশু, সে কথা জিজ্ঞেস করলে সে কেবল হাসে। আসলে নামটা তার খুব পছন্দ। দাশুর সঙ্গে তার খুব ভালবাসা। |
|
এখন বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে যে, পাশের গাঁয়ের পাঠশালায় ক্লাস ফোর পর্যন্ত পড়া এবং ঘণ্টা বাজিয়ে নমো নমো করে পুজো করতে জানা দাশুর তা হলে বেশ কষ্ট। নিজে নিজে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খেতে হয়, নিজের কাপড় নিজে কাচতে হয়। হয়ই তো, কে করে দেবে? মন্দের ভাল বাবা সব ক’টা বোনকে পার করে গেছেন। তবে দাশুকে দেখলে মনে হবে না, সে বড় মনোকষ্টে আছে। একটা মানুষের জন্যে কত আর দরকার হয়? পুজোতে পাওয়া ধুতি দু’চারখানা বেশিই থাকে তার সংগ্রহে। লালপাড় শাড়িও আছে দশ-বারোখানা। সেগুলো পরার লোক যদি ঘরে আসে কখনও, তখন কাজে লাগতে পারে। কদাচিৎ এক-আধখানা কিনে নিয়ে যায় কেউ কেউ। কম মূল্যে দিয়ে দেয় দাশু, বলে কিনতে তো হয়নি, দাম কী নেব, দেন পঞ্চাশটা টাকা।
পঞ্চাশটা টাকা পেয়ে উপকার হয় দাশুর। তেলটা, নুনটা, কেরোসিনটা কিনে রাখে ঘরে। গাঁয়েঘরে অত কিছু লাগে না একটা মানুষের খেতে-পরতে। অতএব দাশু ভাতের হাঁড়িতে একটা আলু ফেলে ফুটিয়ে নামিয়ে নিয়ে, ঘরেরই কচি কচি গোটা তিনেক ঢ্যাঁড়শ একটু তেলে ভেজে নিয়ে দিব্বি পেট ভরে ভাত খেয়ে নিতে পারে। আর মাধবীর বড় সুবিধে যে তার খেতে-পরতে কিছু কিনে আনতে হয় না, রান্না করতে হয় না। ভাতের ফ্যানটুকু তার বেশ পছন্দ, দাশুর সোহাগের দৃষ্টির সামনে আচারের মতো চেটে চেটে ফ্যান খায়। ভাতের ফ্যান, তরকারির খোসা, দাশুর কুড়িয়ে আনা আমপাতা, বটপাতা দিয়ে তার রাতের দিকের ডিনারটা হয়ে যায়। বক্তব্য হল, মাধবী এবং দাশু পুরুত এই দুঃখময় পৃথিবীতে স্বচ্ছন্দে বাস করছিল। তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের পরিধি এত কম ছিল যে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না।
পাঁচ বছরের মাধবী আর বছর তিরিশের দশরথ বড় ভাল ভাবে বেঁচে ছিল। তাদের পিতৃপুরুষের রেখে যাওয়া দোতলা মাঠকোঠা মাটির ঘর প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বড়। এখন কথা হল, এমন করে তো চলা উচিত নয়। নিয়ম বহির্ভূত হয়ে কেউ থাকে না, থাকতে পারে না। কেননা, সেটাই নিয়ম।
ঘটনা তেমন কিছু নয়, কোনও এক পারমিতার বিয়ে ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পর কেমন করে যেন আবিষ্কার হয়ে গেল পাত্রের মাথার রোগ আছে, দু’দু’বার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বলেছে এপিলেপ্সি হয়েছে। আবার চুপি চুপি খবর এসেছে গাঁজা খাবার দোষও নাকি আছে। সব শুনে বেঁকে বসল মেয়ে। পারমিতা যার ডাকনাম মাধু, বলল যার সঙ্গে সারা জীবন কাটাব, সে লোকটা গাঁজাখোর, তার ওপর মাথার দোষও আছে। সর্বনাশের মাথায় পা। করব না অমন বিয়ে, যাও। |
|
মেয়ের দাদু-মা-বাবা-কাকা-কাকিমা মিলে ভেবে দেখল কথাটা সত্যি। তবে এই বিয়ে ভেঙে গেলে মেয়ের পাত্র জুটবে কোথা থেকে? এমনিতেই মাধু তিরিশ পার, দেখতে শুনতেও মোটে ভাল নয়। কনে পছন্দ হয়েছিল অনেক কষ্টে। আর পাত্র পাওয়া যাবে?
মেয়ে বলল যাবে যাবে, ভগবান বলে একটা বিষয় আছে, সে দেখবে। আমার বর কোথায় আছে তাকে খুঁজে বের করো। এখনও একত্রিশ দিন সময় আছে, ওই দিনেই আমার বিয়ে হবে।
মা বলল কোথায় পাব ছেলে এত তাড়াতাড়ি? বামুন চাই, অবস্থাপন্ন ঘর চাই, লেখাপড়া জানা চাই।
তাই বলে পাগল গাঁজাখোরের সঙ্গে ঝুলে পড়তে হবে? সস্তা? চাই না অবস্থাপন্ন ঘর। চাই না লেখাপড়া জানা ছেলে। লেখাপড়া জানা মাথার দোষওলা গাঁজাখোর, মরে যাই, কী একখানা বাহাদুর ছেলে পেয়েছিলে তোমরা! গরিবের ঘর দেখো, ভাল মানুষ দেখো, চরিত্র ভাল দেখো।
পরিষ্কার কথাবার্তা, কোনও গোলমাল নেই। বেশি খোঁজ করতে হল না, দাশুকে পেয়ে গেল ওরা। ছেলের সঙ্গে কথা বলে মাধুর কাকা আর বাবা দু’জনেই সন্তুষ্ট। ভারী ভাল ছেলে, নিখুঁত চরিত্র, কিন্তু ছেলে যে বিয়ে করবে না বলছে, সেটা একটা পয়েন্ট। বউকে খাওয়াবে কী? বেজায় গরিব, রোজগার নেই। তবে বংশ খুব ভাল, দাদুর টোল ছিল, বাবা নামকরা পুরুত ছিলেন। মেয়ের ভাগ্য বলেও তো কিছু আছে।
রাজি হল দাশু, রাজি হল তার একমাত্র কারণ মেয়ের নাম মাধু, নিশ্চয় মাধবী থেকে ছেঁটে ছোট করা নাম মাধু। নামটা তার বড় পছন্দ। মেয়ের মা আর কাকিমা এসে কথাবার্তা বলে রাজি করিয়ে গেল তাকে। মাধু মাধু করে যখন মেয়ের কাকিমা কথা বলছিল, তখনই বার বার মাধবীর দিকে দেখছিল দাশু। ফিরে গিয়ে মাধুকে বলেছিল।
খুব ভাল ছেলেরে মাধু। কী সুন্দর ব্যবহার, দেখতে শুনতেও ভাল। বয়েস কিন্তু বেশি নয়, সব মিলে তোর পছন্দ হবে দেখিস। কেন ভাল হবে না বল, ভাল বংশের ছেলে যে! এক বাক্যে বলেছে গাঁয়ের সবাই, দিন বিয়ে, ভালই হবে দেখবেন। ঘরে একটা গাইগরু ছাড়া আর কেউ নেই রে। শ্বশুর নেই শাশুড়ি নেই, ননদদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। একেবারে ঝাড়া হাত-পা সংসার। আমাদের কেমন সুন্দর করে চা করে দিল। বেশ ভাল চা করতে পারে।
আর কোনও গুণ জানতে পেলে? এই ভালবাসাটাসা ছিল কি না, কোনও মেয়ে দাগা দিয়েছে কি না, খবর নিলে? এত দিন বাবু বিয়ে করেননি কেন জানতে পেরেছ?
পেরেছি। নিজেই খেতে পায় না, বউকে খাওয়াবে কী, কচু?
তা হলে আমাকে বিয়ে করে খাওয়াবে কী, কচু?
আহা, তা কেন হবে? তার ব্যবস্থা করা হবে। ভাল ছেলে রে, বেশ ভাল ছেলে। মজার কথা কী জানিস, গরুটার নাম রেখেছে মাধবী। আমরা যত বার মাধু মাধু করে বলছি তত বার দাশু গরুটার দিকে তাকাচ্ছে।
সবাই যখন বলছে ভাল, তখন ভাল হতেই হবে। গাঁজা খাওয়া ছেলের থেকে তো ভাল। গরিব তো কী হয়েছে, নিজের বাড়ি, নিজে রেঁধে খায়। দেখতে শুনতে বলছে ভাল, বাড়িতে অন্য কেউ নেই যে, কথায় কথায় তাকে জ্বালাবে। গরুর নাম মাধবী হলেই বা কী হয়েছে, অমন এক-আধটা সামান্য দোষ ধরতে নাই।
শুভদৃষ্টির সময় মাধু ওকে দেখে মনে মনে ভাগ্যকে প্রণাম জানাল। কত সুন্দর কচি মুখখানা, বড় সরল, মায়াবী। মনে মনে গলে গেল সে। দ্বিরাগমন সেরে আসার পর দাশুর দিদিরা সব ছেলেপুলে নিয়ে যে যার শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা দিল। তার পরের দিনও মাধুকে রান্না করতে দেয়নি দাশু। ওর মতো করে রাঁধতে পারবে না মাধু। ওর মতো করে মাধবীকে ভালবাসতে পারবে না। গরুটাও হয়েছে তেমনি, বারে বারে মাধুর দিকে তাকায় আর যেন বলতে চায়, সবাই তো চলে গেল, তুমি কেন গেলে না এখনও। হিংসেটা পরিষ্কার দেখতে পায় গরুটার চোখে। দাশু যে একটা অন্য সঙ্গী পেয়ে গেছে, সেটা ওর ভাল লাগবে কেন!
সকাল পার করে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল মাধবী বাইরে। বাঁধা তো থাকে না সে, নিজের ইচ্ছেয় যায়, নিজের ইচ্ছেয় ফিরে আসে। তখন মশলা বাটছিল দাশু, একটু ধনে, হলুদ, আর একটা শুকনো লঙ্কা একসঙ্গে পিষে নিচ্ছিল। খেয়েদেয়ে দাশু গিয়েছিল বাইরে, মাধু ওপর নীচে ঘুরে ঘুরে দেখছিল তার নিজের সংসার। কী যে ভাল লাগছিল তার, সব ওই লোকটার দান।
ঘণ্টা দুয়েক পরে মাধবী ফিরে এল, বাইরের দরজায় ঝড়াম করে পাল্লার ধাক্কায় শেকলের শব্দ উঠল। ভাব করার ইচ্ছে করল মাধুর। মুখে বলল আয় মাধবী, আয়, তোর সঙ্গে ভাব করি। গল্প করবি আমার সঙ্গে? একটু গুড় দেব খেতে।
গরুটা সত্যি চলে এল দাওয়ার কাছে। মাধবী একটা গুড়ের ডেলা এনে দিল ওর মুখে। চোখের ভাব দেখে মনে হল গরুটার ভাল লেগেছে। কোনও দিন তো গুড় খেতে পায় না এ বাড়িতে। তা ছাড়া কয়েকটা দিন ধরে তার পাওনা ভালই হচ্ছে। সুতরাং তার পক্ষে হিংসে থাকলেও সেটা বেশিক্ষণের জন্যে নয়। মাধু আর মাধবী দু’জনেই গরুটার চালায় এসে দাঁড়াল।
গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মাধু বলল এ বার আমি এসেছি, তোকে একটা বাচ্চা দিতে হবে। এ বার থেকে আমাদের একটু করে দুধ দিবি।
মাধবী ফোঁস করে প্রতিবাদ জানাল। বাচ্চা দিতে হবে, দুধ দিতে হবে, এ সব খারাপ কথা নয়। তবে এমন কী বুঝল মাধবী যে, একেবারে ফোঁস করে উঠল। বিকেল পার করে দাশু ফিরে এলে তাকে কথাটা বলল মাধু।
তোমার মাধবীর সঙ্গে ভাব করতে গিয়েছিলাম। বললাম, একটা বাচ্চা দে এ বার, দুধ দিতে হবে আমাদের, তা শুনে একেবারে ফোঁস করে উঠল।
এত দিন একা একা থাকত, সময় লাগবে চিনতে তোমাকে।
পারমিতা, যার ডাক নাম মাধু, সে গ্রামের মেয়ে, অনেক কিছু সে জানে, আবার অনেক কিছু সে জানে না। যেমন সে জানে বিয়ে হলে মেয়েদের ঘরসংসার হয়, বাচ্চাকাচ্চা হয়। তার পেছনে কতটা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি কাজ করে, সে সম্বন্ধে তার কোনও জ্ঞান নেই। তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। খুঁজতে গেলে অমন অনেক ছেলেমেয়ে পাওয়া যাবে এই দুনিয়ায়। অতএব গার্হস্থ্যবিদ্যায় অজ্ঞ মাধু নিজের মতো করে যা হোক কিছু বুঝে নিয়ে চলে এসেছে এত দিন। গরু মাধবী কারও সঙ্গে মেশে না, কোথাও যায় না, খিদে পেলে চরতে চলে যায় একা একা, নিজে নিজেই ফিরে আসে। তার সঙ্গী না থাকলে সংসার পাবে কেমন করে, ছেলেপুলে পাবে কেমন করে, সামান্য এইটুকু বুঝতে পেরেছিল মাধু।
বরের পাশে শুয়ে শুয়ে সেই কথাই বলছিল মাধু। বলছিল, তোমার মাধবীর একটা সংসার থাকা দরকার। ওরও তো একটা ঘর-বর চাই। আমাদের বাড়িতে গরুরা সব পালে যায়। সেখানেই তারা সঙ্গীসাথি পেয়ে যায়। ওদের হাসাহাসি, ফক্কড়ি করা, খেলা করা, মজা করা সব সেখানেই হয়ে যায়। আহা গরু হলে কী হবে, ওদেরও তো এ সব চাই। তুমি ওকে পালে পাঠাও।
ওর অভ্যাস নেই, যেতে চাইবে না।
প্রথম প্রথম ভাল লাগবে না, দু’চার দিন না-হয় নিজে নিজে চলে আসবে। মন বসে যাবে কয়েক দিনের ভেতর।
প্রথম দিন দাশু নিজেই সঙ্গে করে নিয়ে গেল পালের সঙ্গে, ঘণ্টাখানেক পরে ঘুরিয়ে নিয়ে এল। দিন পাঁচেকের মধ্যে মাধবী পালের থেকে নিজে নিজে পালিয়ে এল না, বিকেলে অন্য সকলের সঙ্গে ফিরল।
দাশুর পাশে শুলেও মাধু আজও বউয়ের ভূমিকাতে উত্তীর্ণ হয়নি। তার কারণ আর কিছু নয়, সে জানেই না তার ভূমিকাটা কী? দাশুও চেষ্টা করেনি, ভেবেছে যাক না কয়েকটা দিন, নিজে নিজেই আসবে কাছে।
ঘুমিয়ে পড়েছিল মাধু, সহসাই ডাকল মাধবী, বেশ জোরে ডাকল। কয়েক বার ডাকার পর ঘুম ভেঙে মাধু জিজ্ঞেস করল গাইটা ডাকছে কেন গো বারে বারে? ওর কী কোনও অসুখবিসুখ হল নাকি?
বকনা গরু, ডাক দিয়েছে মানে এ বার ওর বাচ্চা দেওয়ার সময় হয়েছে, তাই জানান দিচ্ছে। তুমি জান না পাল খাওয়ানো কাকে বলে?
না তো?
মাধু এই প্রথম শুনল ‘পাল খাওয়ানো’ বলে নতুন দু’টি শব্দ। গরুর পালের মধ্যে একটা করে ষাঁড় থাকে, সে-ই ছেলেদের কাজটা করে দেয়। ছেলে গরু না থাকলে গাইগুলো বাচ্চা পাবে কোথা থেকে।
বড় দুশ্চিন্তা নিয়ে আর এক বার ঘুমিয়ে পড়ল মাধু। দাশু একটু মুচকি হেসে ভাবল গাঁয়ের মেয়ে হয়েও মাধু কতখানি নির্বোধ। সামান্য এই খবরটুকু ওকে কেউ দেয়নি। বাড়িতে দিদি-বউদি একটা কেউ থাকলে তবু কিছুটা জানতে পারত।
সকালবেলাতেও কয়েক বার ডাকল মাধবী। পালে চলে যাওয়ার সময় এক বারও এ দিকে চেয়ে দেখল না। দাশু বাগালদের বলে দিল বকনাটা ডাকছে রে, একটু দেখিস তোরা।
তুমি ভেবো না, পাল খাইয়ে একেবারে চান করিয়ে নিয়ে আসব পুরুতমশায়।
মাধু মনে মনে ভাবতে বসল চান করিয়ে আনবে বলল, তার মানে ওর গা গরম হয়েছে। বাড়িতেই সকালে ওকে বালতির জল দিয়ে নাইয়ে দেওয়া যেত। সুবোধ বালিকাটির মতো পাল থেকে ফিরে এল মাধবী। ইচ্ছে করে সন্ধেবেলা ধুনো দেওয়ার সময় একটু বেশি করে দাঁড়িয়ে দেখে নিল মাধু, যদি কিছু দেখতে পায়, যদি কিছু বুঝতে পারে। গায়ে হাত দিল ভয়ে ভয়ে, জ্বর আছে কি না বুঝতে চাইল। মাধবী কিছু বলল না, ফোঁস করল না।
তোমার মাধবী আর ডাকছে না, দেখেছ?
জানি।
বড় হলে মা-মাসি-বউদিরা যে বিদ্যার পাঠ দিয়ে দেন, জীবনের সেই গোপন অংশটির বিশদ বিবরণ শুনতে শুনতে মাধু বারবার ভাবছিল তার বরটি কত জানে, কত খবর রাখে। ভাবতে ভাবতে দাশুর কাছটিতে সরে এসে নিজের অজান্তে একটি হাত রাখল ওর গায়ে পরম মমতায়।
মাধু মাধবী সংক্রান্ত সংবাদ এখানেই শেষ হওয়া দরকার, আর বেশি বাড়িয়ে কোনও বিশেষ লাভ নেই। কেবল একটি কথা বলে নেওয়া উচিত। এক দিন হিসেব করছিল মাধু, সে দাশুর চেয়ে অন্তত আট মাসের বড়। এই একটি জায়গায় ভয় আছে তার, এতে কোনও ক্ষতি হবে না তো? মেয়েদের ছোট হতে হয় বরের থেকে। মুশকিল হয়েছে যে, এ সব কথা আবার তার সঙ্গে আলোচনা করাও যায় না। মানুষের জীবনে কোনও গোপন ভয় থাকা মনে হয় ভাল। এবং বিশেষ প্রকারের এই ভয়টা নিয়েই সংসার করতে লাগল মাধু।
|
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী |
|
|
|
|
|