রবিবাসরীয় প্রবন্ধ
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়
হিন্দুকুশ পাহাড়ের চূড়া এই নিদাঘ গ্রীষ্ম দুপুরেও রুপোলি হয়ে আছে! যদিও সূর্য খেলছে মাঝ-আকাশে। আর তারই জেরে ঝলসাচ্ছে তিরতির করে বয়ে চলা পাহাড়ি নদী সোয়াট।
প্রায় মিনিট কুড়ি হতে চলল এই অলৌকিক নিসর্গের দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে রয়েছে যোলো বছরের মিনাজ বানু। পলকহীন, কিন্তু শূন্যদৃষ্টি। তাতে কোনও ভাষা নেই। থাকার কথাও নয় অবশ্য। যে ভয়ংকর রাত মিনাজের ভাষা কেড়ে নিয়েছে তার বৃত্তান্ত আজও এই কাজাঘেলা গ্রামে কিংবদন্তি।
সাল ২০০৯। সোয়াট উপত্যকায় তখন পুরোদস্তুর তালিবানি নৈরাজ্য চলছে। গোল্লায় গিয়েছে পাকিস্তানের প্রশাসন। এই ছবির মতো সুন্দর গ্রামটি তখন ছিল তালিবানদের অন্যতম সামরিক ঘাঁটি। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল সমস্ত স্কুল-কলেজ। মধুচন্দ্রিমার জন্য দেশ-বিদেশে প্রখ্যাত এই সুন্দরী সোয়াট বদলে গিয়েছিল মৃত্যু উপত্যকায়।
উচ্ছল ষোড়শী মিনাজ ছিল মহাজনের জমিতে ভাগচাষ করা দরিদ্র পরিবারটির প্রাণবিন্দু। সে চাইত পড়াশুনো করে শহরে গিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে। স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতেই আটকে থাকতে বাধ্য হয়েছিল মিনাজ। মন খারাপ কাটাতে গুনগুন করে পাহাড়ি গান গাওয়া, বাড়ির মানুষদের দেখভাল করা আর বন্ধ জানলা ফাঁক করে বাইরের বিভীষিকা দেখাটাই ধরে নিয়েছিল ভবিতব্য। কিন্তু আল্লাতালা আরও কিছু লিখে রেখেছিলেন মিনাজের জন্য। এক দিন হঠাৎই অমোঘ ফরমান আসে এক তালিবান নেতার কাছ থেকে। বার্তা সংক্ষিপ্ত মিনাজকে চাই। বিপদ বুঝে সেই রাতেই পিছনের দরজা দিয়ে তালিবানদের চোখ এড়িয়ে মিনাজকে নিয়ে পালিয়ে যান আম্মা। প্রাণ হাতে করে।

ল্যাম্পপোস্টে ভাইয়ের লাশ
পরিণাম? সে-দিন গভীর রাতে মিনাজকে না পেয়ে বিছানা থেকে তার তিন ঘুমন্ত ভাইকে টেনে বের করে বাপের সামনে প্রত্যেকের কান কেটে দেওয়া হয় (কান কাটা নাকি আফগানি-পাকিস্তানি তালিবানদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রমোদ!)। তার পর ওই রক্তাক্ত অবস্থায় বাকি রাত উল্টো করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় বাড়ির সামনের তিনটি ল্যাম্প পোস্টের সঙ্গে। একটু পরে একে একে তিন জনের মুণ্ডচ্ছেদ করা হয় গ্রামবাসীদের ডেকে এনে। মুণ্ডু নিয়ে চলে রাস্তার মোড়ে উন্মত্ত উল্লাস।
প্রতিটি ক্লাসে ঢুকতেই নীল শৈশব বলছে, সেলামালেকুম।
আতঙ্কের হিমশীতলতা কাটছে, কাটছে...
মিনাজের বাড়ির সামনের রাস্তার মোড়ে সেই ল্যাম্প পোস্টগুলির সামনেই হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি। পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে লাহৌর-ইসলামাবাদ-পিণ্ডি-আজাদ কাশ্মীর হয়ে এই সোয়াটে এসে পৌঁছনো গিয়েছে ঘণ্টা কয়েক হল। নয়নাভিরাম নিসর্গ দেখে বোঝা মুশকিল গত তিন বছরে ২৪০০ নিরীহ মানুষের লাশ পড়েছে এই তালিবানি কুরুক্ষেত্রে। এখানকার মোট ৩৫ লাখের মধ্যে প্রায় ২৮ লাখ মানুষ কোনও মতে প্রাণ হাতে পালিয়েছিলেন মিনাজদের মতোই। এখানকার প্রতিটি গ্রামই ছিল প্রকৃতপক্ষে ওসামা বিন লাদেন তৈরির কারখানা।
এক বিচিত্র কোলাজ তৈরি হচ্ছে মাথার ভিতরে। নয়াদিল্লির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্রিফিং রুমে বসে, একটি পাকিস্তানের মধ্যে বহু পাকিস্তানের তত্ত্ব বিভিন্ন কূটনীতিবিদদের মুখে বহু প্রসঙ্গে শুনেছি। মাটিতে দাঁড়িয়ে দেখা এই প্রথম। মাত্র দু’দিন আগেই লাহৌরের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যমণ্ডিত লাইব্রেরিতে বসে ভারত-পাকিস্তান বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ নিয়ে যে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, সোয়াট উপত্যকার এই মিনাজ নামের মেয়েটির থেকে তারা কত দূরে থাকে? কায়দ-ই-আজম ক্যাম্পাসে ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পাঠরত প্রতি দশটি ছেলে-মেয়ের মধ্যে পাঁচ জনেরই ভবিষ্যৎ নির্দিষ্ট হয়ে রয়েছে পশ্চিমের কোনও দেশে। উচ্চ পদস্থ অফিসার, রাজনীতিক বা ধনী ব্যবসায়ীর এই সন্তানদের মানস গঠনের সঙ্গে আপাত ভাবে কোনও তফাতই পাওয়া যাবে না দিল্লি বা মুম্বইয়ের কলেজ-ক্যান্টিনের প্রাণোচ্ছলতার।
মানচিত্র বলছে, ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ১৬০ কিলোমিটার দূরে পেশোয়ারের এই জেলা। কিন্তু অন্য হিসাবে মনে হচ্ছে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের এই থরহরি কম্পমান মিনাজেরা বাস করে বহু আলোকবর্ষ দূরে। খাতায় কলমে সোয়াটে যদিও তালিবানদের সঙ্গে পাক সেনার যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে বছরখানেক আগে। নিজের চোখে দেখতে হয়নি কিন্তু পরিবার আর গ্রামবাসীদের মুখে শোনা প্রিয় ভাইদের কাটামুণ্ডুর স্মৃতি এখনও অবশ এবং অপরাধী করে রেখেছে তার চেতনাকে।

আপাতত শান্তিকল্যাণ...
একই অবস্থা তার মতো অসংখ্য মানুষের। আপাতভাবে জীবনযাত্রা চলছে ঢিমে তালে। সেনার বজ্র-আঁটুনির মধ্যেই স্কুল-কলেজ, দোকান-হাট খুলেছে। সত্যিই কি তা হলে শান্তিকল্যাণ এখানে? দেখে মনে হচ্ছে, পুরোপুরি না হলেও খানিকটা তো বটেই। না হলে ভারতীয় সাংবাদিকদের এখানে নিয়ে আসার দুঃসাহস দেখাতে পারতেন না পাক কর্তৃপক্ষ। আগে-পিছে চারটি করে সশস্ত্র ভ্যান-সহযোগেও নয়। একটি সুর বার বার যতটা সম্ভব জোরালো করে ইদানীং বাজানো হচ্ছে জারদারি-সরকারের পক্ষ থেকে। সেটি হল, দক্ষিণ এশিয়ায় সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে বড় শিকার পাকিস্তান নিজে। আর তাই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইসলামাবাদই সবচেয়ে বেশি ঐকান্তিক। লাহৌরের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় ও সেখানকার কাফেটেরিয়ার নবীন প্রজন্ম, রাওয়ালপিণ্ডির সেনা হেডকোয়ার্টার, ইসলামাবাদের বিদেশ মন্ত্রক, ‘আজাদ’ কাশ্মীরের শেষ চেকপোস্ট চাকোটি (যার সামনেই নিয়ন্ত্রণরেখা এবং ওপারে দৃশ্যমান ভারতীয় পতাকা সমৃদ্ধ চেকপোস্ট), সোয়াট উপত্যকার কাজাঘেলা গ্রাম সর্বত্রই দেখছি এই সুর। যেন রয়েছে অসংখ্য ওসামা বিন লাদেনের অদৃশ্য স্বাক্ষর। কালাশনিকভের আতঙ্ক। সেনাবাহিনীর উদ্যত পাল্টা মারণাস্ত্র। ওই তিরতির করে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদীর মতনই সব সময়ই যেন চোরাস্রোত চলছে আতঙ্কের। আর তার মধ্যেই ঢালু মাঠে ব্যাট-বল নিয়ে আবার আফ্রিদি হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে বাচ্চারা!
ভারত থেকে ‘পত্রকার’ এসেছে শুনে কাজাঘেলা গ্রামের মালাখন্ডি ডিভিশনের সেনা ছাউনিতে একটি দু’টি করে মানুষের ছায়া পড়ছে, অবশ্যই পাক সেনার তত্ত্বাবধানে। নীল পাঠান স্যুট পরা পক্বকেশ কিন্তু এখনও যথেষ্ট ঋজু হায়দর আলির ঠাকুরদা ছিলেন ইংরেজ আমলের খান বাহাদুর। বিরাট ভিক্টোরিয়ান বাংলো, প্রচুর প্রতাপ। ‘সমস্ত সম্পত্তি প্রথমে বাজেয়াপ্ত, পরে ছেড়ে যাওয়ার সময় কার্যত ধ্বংস করে গিয়ে গিয়েছে ওরা। আগুন লাগিয়ে দিয়েছে বাড়িতে।’ শীর্ণকায় বৃদ্ধের চোখ জ্বলছে। ‘পরিবারের সবাইকে বের করে কসাইয়ের মতো কুপিয়ে কুপিয়ে মেরেছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে গিয়েছে। আজও তাদের কোনও খোঁজ নেই। সামনে যে রাস্তা দেখছেন পাহাড়ে মিশে গিয়েছে, ওখান দিয়েই কাটা মুণ্ডু নিয়ে মিছিল করত ওরা!’
‘বছর দেড়েক আগে পর্যন্ত এখানে কোনও পুলিশি ব্যবস্থা, প্রশাসন, সংবিধান, স্কুল, কলেজ কিছুই চালু ছিল না’, জানাচ্ছেন লেফটেন্যান্ট জাভেদ ইকবাল। মালাখন্ড-এর গোল্ডেন ডিভিশন-এর সর্বময় কর্তা। ফাইভ ফিফটি ফাইভ সিগারেট জ্বলছে আঙ্গুলের ফাঁকে। একটি নেভার সময় পাচ্ছে না, তার থেকেই অন্য একটি ধরাচ্ছেন। তবে তাঁর স্নায়ু হিমশীতল। শরীর-ভাষাও। গত তিন বছর ধরে তালিবান জঙ্গিদের সঙ্গে যে যুদ্ধ চলছে তার নেতৃত্বে ছিলেন এই ইকবাল। তাঁর লড়াইটা ছিল মূলত মৌলনা ফয়জুল্লার সঙ্গে। ফয়জুল্লা পাকিস্তানের তেহরিক-ই-নাফাজ-ই-শরিয়ত-ই-মোহাম্মাদি নামের তালিবান গোষ্ঠীর সর্বময় কর্তা। ওই জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা সুফি মহম্মদের জামাই। রেডিয়ো কাজাঘেলা (এফ এম চ্যানেল)-র পুরো নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় সে। ওই রেডিয়ো চ্যানেলের মাধ্যমে তালিবানদের মতাদর্শ প্রচার করত ফয়জুল্লা। মতাদর্শের স্লোগান ছিল ‘নিজামে আতেহ্।’ পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক কাঠামোকে ভেঙে তারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল নিজস্ব ঢঙের শারিয়াতি কানুন। ইকবালের কথায়, ‘আফগানিস্তান থেকে আসা তালিবান নেতাদের সঙ্গে একসঙ্গে মিলেই সোয়াটে সন্ত্রাসের পত্তন ঘটানো হয়। সামরিক অপারেশনের পর এখন ফয়জুল্লা ডেরা বেঁধে রয়েছে আফগানিস্তানে।’
সোয়াটের উত্তরাংশের একমাত্র কলেজ, ‘ভোকেশনাল ট্রেনিং কলেজ ফর উইমেন’ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৯২ সালে। ২০০৮-এ তালিবান নেতারা এসে বেয়নেটের ডগায় দাঁড় করিয়ে প্রিন্সিপাল সালমা বেগমকে বলে, মহিলাদের লেখাপড়া শেখানো বন্ধ করতে হবে। তার পর চাকরি দেওয়ার তো কোনও প্রশ্নই ওঠে না। গৃহবন্দি হয়ে যায় প্রায় ৫০০ ছাত্রী। পরে বোমা মেরে কলেজ বিল্ডিংটিকেও ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়।


মেয়েরা পড়ায় ফিরছে
কয়েক মাস হল যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে আবার চালু হয়েছে সেই বৃত্তিমূলক কলেজ। নতুন বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। প্রিন্সিপাল সালমা বেগম জানাচ্ছেন, ‘আবার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। পুরনো ছাত্রী যারা তিন বছর গৃহবন্দি ছিল, তারা তো ফিরে আসছেই। আরও নতুন ভর্তির জন্য লাইন লেগে গিয়েছে।’ এই কলেজে আপাতত কম্পিউটারের পাঠক্রম নিচ্ছে ফরিদা খাতুন। গত দু’বছর বাড়ি থেকে বেরোতে পারেনি সে। এখনও ভয় আছে। তবে তার আশা, ‘সেনাপ্রহরা পুরোপুরি উঠে যাওয়ার আগে নিশ্চয়ই সরকার এমন ব্যবস্থা করে দেবে, যাতে ওরা আবার আমাদের গ্রামের দখল নিতে না পারে।’ পড়াশুনো শেষ করে ফ্যাশন ডিজাইনার হওয়ার ইচ্ছা এই মেয়েটির! ‘তবে যা-ই করি, দেশের জন্য করব’ আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে নামমাত্র দূরে বসে এমন সংকল্পবদ্ধ উচ্চারণ শুনতে বেশ অবাকই লাগল।
সোয়াটের মাট্টা গ্রামে পৌঁছনোর পর সঙ্গের কম্যান্ডার জানালেন, ‘এটি একটি এমন গ্রাম, যেখানে প্রত্যেক ঘরে ঘরে তালিবানি সমর্থন ছিল।’ ঘটনা এটাই যে স্থানীয় সমর্থন ছাড়া মাথাচাড়া দিতে পারে না কোনও ধরণের সন্ত্রাস কারখানাই। অ্যাবটাবাদে ওসামা বিন লাদেন বছরে পর বছর লুকিয়ে থাকতে পারতেন না, স্থানীয় সহায়তা ছাড়া। সেই সহায়তা আসতে পারে জিহাদি জনতার কাছ থেকে, অথবা খুব গোপনে আইএসআই-এর একাংশের থেকে। মাট্টা আপাতত তালিবান-মুক্ত। আর তাই যে প্রশ্নটা তৈরি হচ্ছে তা হল, সেই ভরপুর সমর্থন তা হলে এখন কোথায় গেল? তা কি পাক সেনার অস্ত্রের ভয়ে কিছুটা থিতিয়ে রয়েছে, সুযোগ পেলেই মাথাচাড়া দেবে আবার? সশস্ত্র তালিবানদের থেকে কৌশলগত ভাবে দূরে থেকে এটা কি সাময়িক কোনও বশ্যতা স্বীকার? অন্য এক সশস্ত্র বাহিনীর সামনে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অবশ্য এখন অবান্তর। পাকিস্তানের ভবিষ্যতে ঠিক কী অপেক্ষা করছে তার পূর্বাভাস করা এই জটিল সময়ে দাঁড়িয়ে খুবই শক্ত।
পাকিস্তান নেতৃত্বও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস দমনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদের পাশে নেওয়ার দিকেই জোর দিচ্ছে। পাক সেনাবাহিনীর মুখপাত্র তথা ইন্টার সার্ভিস পাবলিক রিলেশন (আই এস পি আর)-এর ডি জি আথার আব্বাস রাওয়ালপিণ্ডিতে আমাদের জানিয়েছিলেন, ‘এখানে যা চলছে তা নিছকই সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান নয়। এক পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধ। তাই সাধারণ মানুষকে বোঝানো, তাদের পাশে নেওয়াটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’ এই ‘যুদ্ধে’ ওসামা বাহিনী তথা আল কায়দা তালিবানদের থেকে বাড়তি সুবিধা পেয়েছে পাক সেনাবাহিনী এমনটাই দাবি করছেন আব্বাস। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদীদের দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে। তারা ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। আমরা সীমান্তের এ-পারে উন্নয়নের উপর ব্যাপক জোর দিচ্ছি। ওয়াজিরিস্তান থেকে কাবুল পর্যন্ত হাই স্পিড সড়ক তৈরির কাজ এই শেষ হল। যুবসমাজকে মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে এটাই রাস্তা।’
কিন্তু এই উন্নয়নের রাস্তা সাময়িক ভাবে খোলা সম্ভব হলেও, ভবিষ্যৎ কতটা সুগম তা সময়ই বলবে। একের পর এক হামলায় কাঁপছে করাচি, ইসলামাবাদ, আফ-পাক সীমান্ত। এই গ্রামেরই আবেদ শাহিদ প্রাইভেট স্কুলে নীল ইউনিফর্ম পরা একরাশ নিষ্পাপ বাচ্চার মুখোমুখি হয়ে এই কথাটাই বারবার মনে হচ্ছিল যে, এই শান্তি টিকবে তো? প্রত্যেকটি ক্লাসে ঢুকতেই, একরাশ নীল ফুলের মতোই উঠে দাঁড়িয়ে তারা সুর করে বলছে, সেলামালেকুম, থ্যাঙ্ক ইউ...! চিৎকার করে পুস্তু ভাষায় নামতাও পড়ে শোনাচ্ছে। না, ভয়ডরের লেশমাত্রও কিন্তু নেই তাদের কচি কন্ঠস্বরে। বরঞ্চ বয়সোচিত চাপল্য। আতঙ্কের হিমশীতলতাকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে ওই অমল ধবল (নাকি এখানে নীল!) শৈশব।
সোয়াট নামেই উপত্যকা। কিন্তু আগে পিছে সর্বত্র ছোট-বড় টিলা। এমনই এক টিলার মাথায় ওঠা গেল পাকদণ্ডি বেয়ে। তালিবান আগ্রাসনের আগে পর্যটনকেন্দ্র হিসাবে প্রসিদ্ধ ছিল সোয়াট। তার চিহ্ন এখনও বহন করছে বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেল, যার অনেকগুলিই এখন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে অস্থায়ী সেনা শিবিরে। এ রকমই একটি হোটেল পাইথন। অধুনা, তালিবানদের মগজধোলাই কেন্দ্র। পোশাকি নাম, ‘ডি র্যাডিকালাইজেশন সেন্টার’। সামরিক মনস্তত্ত্ববিদ, সাধারণ মনস্তত্ত্ববিদ, সমাজবিজ্ঞানী, বিভিন্ন পেশার মানুষ সব মিলিয়ে এক বিরাট আয়োজন। যে-সব তালিবান নেতা আত্মসমর্পণ করেছে বা গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদের মাথা থেকে সন্ত্রাসের, হিংসার ভূত তাড়ানোর কর্মসূচি। গোটা সোয়াট জুড়েই রয়েছে এমন বেশ কিছু সেন্টার। এখানকার কর্মসূচির নাম মিশাল। এক একটি মডিউল ৩ মাসের। তিন মাস পর যদি দেখা যায়, জিহাদের ভুত মাথা থেকে নেমেছে তা হলে রয়েছে পরের ধাপ অর্থাৎ, জীবিকার সুযোগ করে দেওয়ার চেষ্টা। টিউব লাইট তৈরি থেকে কম্পিউটার চালানো এক একটি ঘরে শেখানো হচ্ছে এক এক রকম কাজ। পুরোটাই অবশ্য সামরিক বাহিনীর প্রবল উপস্থিতিতে। ব্রিগেডিয়ার কামারন জলিল জানালেন, পুনর্বাসনের এই কর্মশালা থেকে এখনও পর্যন্ত ২৬১ জন তালিবান নেতাকে ‘সুস্থ’ করে পরিবারে ফেরত পাঠানো গিয়েছে। বাড়িতে পাঠানোর পরেও অবশ্যই নজরদারি বজায় রেখেছে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ।
তালিবানদের এই পাঠশালা দেখলে হঠাৎ করে মনে হবে যেন বয়স্ক শিক্ষার আসর! একটি কক্ষে মন দিয়ে জনা চল্লিশেক প্রাক্তন তালিবান গম্ভীর মুখে এক সমাজবিজ্ঞানীর বক্তৃতা শুনছে! অন্য একটি ঘরে মাউস ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কেউ দেখছে কী ভাবে কোরানের অপব্যাখ্যা করে সন্ত্রাসবাদের আমদানি করছে জিহাদিরা! কোথাও মন দিয়ে ইলেকট্রিক সার্কিট ঠিক করা হচ্ছে!
কালাশনিকভ ছেড়ে মাস কয়েক হল কম্পিউটারের মাউস হাতে নেওয়া ফৈয়জ আলি খানের চোখ দুটো এখন নিভে এসেছে! বললেন, (পুস্তু ভাষায় যা অনুবাদ করে দেওয়া হল) ‘আমার বোনের বরের পাল্লায় পড়ে এই রাস্তায় এসেছিলাম। ও বলত যে আমার সঙ্গে থাকবে না তাকেই মেরে দেব। দিতও তাই। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা নিজামে আতেহ্ (শরিয়তি আইনের জন্য আন্দোলন)-এর দাবিতে আমিও নেমে গেলাম ওদের পথে। মিস্ত্রির কাজ ছেড়ে এই মানুষ মারার খেলায় নেমেছিলাম তখন...।’
পাশেই বসা রহমত আলি খান-এর গল্পটা পৃথক। সাঙ্কোটা গ্রামে বোন আর বাবা-মার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাত রহমত। উত্তরাধিকার সূত্রে রাজমিস্ত্রির কাজ শিখে নিয়েছিল। ২০০৯ সালে মৌলনা ফয়জুল্লার বাড়বাড়ন্তের সঙ্গে সঙ্গে তার গ্রাম এবং পরিবারেও পরিবর্তন আসে। ‘বন্দুক দেখালে সবাই বশ হয়ে যেত। এটা একটা নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল। অনেক লুঠপাট করেছি তখন।’ ‘মিশাল’-এর মনোবিজ্ঞানীদের দাওয়াই-এ অনেকটাই ‘স্বাভাবিক’ হয়েছেন, নিজেই কবুল করছেন রহমত।
পাক সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের চাকা দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে। একটু একটু করে উঠছি সোয়াট থেকে। চাকার ঘূর্ণনে তৈরি হওয়া প্রবল বাতাসের চাপ সামলাতে সামলাতে যারা হাত নাড়ছেন তাদের মধ্যে যেমন রয়েছেন সেখানকার সামরিক অফিসার-আমলা কর্তারা, তেমনই রয়েছেন মেশিনগান ছেড়ে মেশিন মেরামতির কাজে হাত দেওয়া তালিবানরা! হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে দলে দলে আসা শিশু। যারা মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মৃত্যুভয়হীন।
কাশ্মীরে যত বারই গিয়েছি, এক ধরনের মনখারাপ তৈরি হয়েছে ফেরার সময়। দিন কয়েক আগে পাক অধিকৃত কাশ্মীর গিয়ে বা আজ এই গোটা দিনের সোয়াট অভিযানের শেষে একটা সার কথা মনে হচ্ছে।
নিয়ন্ত্রণরেখার এ পারেই হোক বা ওপারে আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্র দেখার পরবর্তী বিষাদ বোধ হয় দু’ক্ষেত্রেই একই রকম!
First Page Rabibasariyo Golpo



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.