|
|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ২... |
|
মজ্জাগত আচরণের মূল ধরে নাড়া দেয় |
বর্ণালী পাইন |
দিনময়ী সারদাসুন্দরী /কিছু বুজে যাওয়া স্বর, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ৫০.০০ |
প্রকাণ্ড বহির্জগতের পাশে মর্যাদার বিচারে ঘর-গেরস্থালি তাৎপর্যহীন, এমনতর ভাবনা যুগান্তব্যাপী অনড় কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে সমাজের সর্বত্র। দীপঙ্কর ভট্টাচার্যের একাত্তর পৃষ্ঠার প্রয়াস উপলব্ধি ও তথ্যানুসন্ধানের সুফল। মজ্জাগত আচরণের মূল ধরে নাড়া দেয় সোজাসাপটা প্রশ্নের আকূতি।
প্রথমেই আলোচিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের স্ত্রী দিনময়ী। ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগর হয়ে ওঠার সদাব্যস্ত প্রক্রিয়ায় তাঁর থেকে বহু দূরে বীরসিংহ গ্রামে শাশুড়ি ভগবতী দেবীর কর্তৃত্বাধীনে নিরক্ষর দিনময়ী ছিলেন আজীবন ব্রাত্য। তাঁর একাকিত্ব অনুভব করার অবকাশ কখনও পাননি ঈশ্বরচন্দ্র। পুত্র নারায়ণচন্দ্রের প্রতি দিনময়ীর অতিরিক্ত স্নেহ দূরত্ব বাড়িয়েছে। ‘‘প্রায় রিক্ত দিনময়ী সে যুগের বিচারে ‘অধিক’ বয়সের প্রথম সন্তানকে আঁকড়ে ধরেছিলেন আপ্রাণ।” বস্তুত বিয়ের পনেরো বছর পর মা হয়েছিলেন তিনি। এই দীর্ঘ সময় তাঁর কপালে জুটেছে শ্বশুরবাড়ির গঞ্জনা, শুরু হয়েছে তুকতাক, জড়িবুটি। একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরচন্দ্র তখন কলকাতায় একের পর এক সাফল্য অর্জন করেছেনদিনময়ীর ক্লিষ্ট প্রহর কেটেছে ঈশ্বরের অলক্ষে“বিষণ্ণ একলা দিনময়ী কাউকে বোঝাতে পারছেন নাকী করে মা হবেন তিনি। তাঁর রাত-যাপনে কোথাও যে ঈশ্বর নেই!” ‘বাল্যবিবাহের দোষ’ রচনায় বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, ‘অস্মদ্দেশীয় বালদম্পতিরা পরস্পরের আশয় জানিতে পারিল না... সেই বিধিই বিধিনিয়োগবৎ সুখ দুঃখের অনুল্লঙ্ঘনীয় সীমা হইয়া রহিল।’ এই ‘অনুল্লঙ্ঘনীয় সীমা’ দিনময়ী ও বিদ্যাসাগরের সম্পর্ককে মধুর হতে দিল না। নারায়ণচন্দ্রের জন্মের পরের পঁচিশ বছর বিদ্যাসাগরের ব্যস্ততম সময়অধ্যাপনা, স্ত্রীশিক্ষার বিকাশ, বাংলা গদ্যকে শিল্পে উত্তরণ, বিধবা বিবাহের প্রচলন। ১৮৭০-এ কলকাতায় পুত্র নারায়ণচন্দ্র ও বিধবা ভবসুন্দরীর বিয়ে হল। একমাত্র পুত্রের বিবাহসংবাদ জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত রইলেন দিনময়ী। তিন দিন পর ভাই শম্ভুচন্দ্রকে বিদ্যাসাগর লিখলেন, ‘২৭শে শ্রাবণ বৃহস্পতিবার নারায়ণ ভবসুন্দরীর পাণিগ্রহণ করিয়াছেন, এই সংবাদ মাতৃদেবী প্রভৃতিকে জানাইবে।’ বিধবা বিবাহ প্রবর্তকের পুত্র বিধবা বিবাহ করায় বিদ্যাসাগরের মুখোজ্জ্বল হল, বলা বাহুল্য। দিনময়ীর সঙ্গে বসবাসের সাধ যে তাঁর ছিল না, তা স্পষ্ট বিয়ের পঁয়ত্রিশ বছর পর স্ত্রীকে লেখা চিঠিতে, ‘আমার সাংসারিক সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হইয়াছে... এক্ষণে তোমার নিকটে এ জন্মের মত বিদায় লইতেছি... দয়া করিয়া আমাকে ক্ষমা করিবে।... তোমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহের যে ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছি, বিবেচনাপূর্ব্বক চলিলে, তদ্দ্বারা স্বচ্ছন্দরূপে যাবতীয় আবশ্যক বিষয় সম্পন্ন হইতে পারিবেক।’ যেন ‘নিত্যনৈমিত্তিক ব্যয় নির্ব্বাহ’র বেশি কিছু প্রাপ্যই ছিল না দিনময়ীর। একই দিনে মা ভগবতী দেবীকে লেখা চিঠিতে সংসার ছেড়ে দূরে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এও জানিয়েছেন, ‘যদি আমার নিকট থাকা অভিমত হয় তাহা হইলে আমি কৃতার্থবোধ করিব...।’ ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে রক্তাতিসার রোগে দিনময়ীর মৃত্যুর সময় অবশ্য বাদুড়বাগানের বাড়িতে স্ত্রীর পাশেই থেকেছেন বিদ্যাসাগর।
বিদ্যাসাগর-দিনময়ীর মতো ১২৪০ বঙ্গাব্দের ফাল্গুনেই বিয়ে হয় দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদাসুন্দরীর। কন্যা সৌদামিনী ‘পিতৃস্মৃতি’-তে লিখেছেন, ‘পিতা সর্বদাই বিদেশে কাটাইতেন এই কারণে তিনি (সারদাদেবী) সর্বদাই চিন্তিত হইয়া থাকিতেন।... গ্রহাচার্যরা স্বস্ত্যয়নাদির দ্বারা পিতার সর্বপ্রকার আপদ দূর করিবার প্রলোভন দেখাইয়া তাঁহার কাছ হইতে সর্বদাই কত যে অর্থ লইয়া যাইত তাহার সীমা নাই।’ পরম ব্রহ্মের সন্ধানে দেবেন্দ্রনাথ পাড়ি দেন হিমালয়ে অথবা গঙ্গাবক্ষে। ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলে তাঁর স্ত্রীর মনোজগৎটি তাঁর অসীম সাধনার বৃত্তের বাইরেই থাকে আজীবন। দিনময়ীর মতো বিয়ের সময় সারদার বয়সও আট। মাত্র বারো বছর বয়সে মা হতে হল তাঁকে, ধারাবাহিক ভাবে পনেরোটি সন্তানের জন্ম দিলেন সারদা। জ্ঞানালোকপিপাসু মহর্ষি ‘কার্যত সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানিয়ে তুলেছিলেন সারদাকে।’ অথচ তিনিই ‘পিতা হিসেবে সন্তানদের মধ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছেন অনেক অনেক নতুন আলো। কেন এই বৈপরীত্য?’ এই প্রসঙ্গে লেখক আমাদের মনোযোগী করেছেন আরও একটি রূঢ় বাস্তবের দিকেসারদা দেবীর সম্পর্কে ঠাকুরবাড়ির যাঁরাই কিছু বলেছেন, তাঁর অসুস্থতার বিষয়টিই তাঁদের কাছে সব থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। অথচ স্ত্রীর রোগজীর্ণ শরীর দেবেন্দ্রনাথ দেখেও দেখেননি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘কর্তাদাদামশায় মহর্ষি হলে কী হবেএদিকে শৌখিন ছিলেন খুব।... এই বৃদ্ধকালেও তোয়ালে দিয়ে গা রগড়াতেন না, চামড়ায় লাগবে। সেজন্য মসলিনের থান আসত... তারই টুকরো দিয়ে তিনি গা রগড়াতেন, চোখ পরিষ্কার করতেন।’ চার মাস আগের টেলিগ্রামে স্ত্রীর শয্যাক্ষতে দগ্ধ ব্যাধিক্লিষ্ট অবস্থার কথা জেনেও খোঁজ নিয়েছেন বলে তথ্যপ্রমাণ নেই। মুমূর্ষু স্ত্রীকে ফেলে রেখে ব্রাহ্ম সম্মিলন ও মাঘোৎসবে যোগদান ও তার পর জমিদারি সামলাতে শিলাইদহে যাত্রা। ফিরে এলেন মৃত্যুর ঠিক আগের দিন। তখন উপাসনায় বসবেন মহর্ষি, তেরো বছরের বালক রবি ঘুমন্ত অবস্থায় চমকে জেগে ওঠেন দাসীর চিৎকারে, ‘ওরে তোদের কী সর্বনাশ হল রে!’ রবীন্দ্রনাথের মনে মায়ের চলে যাওয়া কী প্রভাব ফেলেছিল, সেই স্মৃতিময়তায় লেখক বইটিতে আর এক মাত্রা যোগ করলেন।
বইটি পড়া শেষ হলেও কী এক বেদনা গুমরোতে থাকে পাঠকের মনে। কীর্তিমান পুরুষের মহৎ কীর্তির প্রতি সশ্রদ্ধ থেকেও যে তথ্যনিষ্ঠায় লেখক তাঁদের স্বভাব-বৈপরীত্য স্পষ্ট করেছেন, তা সেই ডিসকোর্সের পথ খুলে দেয় যা জেনেবুঝে বন্ধ রাখাই শ্রেয় মনে করেছে সমাজ। |
|
|
|
|
|