পুস্তক পরিচয় ১...
অবিরত চেনামুখ পরিসর পেল না
নারীবিশ্ব, পুলক চন্দ সম্পা.। গাঙচিল, ৫০০.০০
র্ধমানের শ্যামসুন্দর মহাবিদ্যালয় বিয়াল্লিশজন জ্ঞানীগুণীর প্রবন্ধ নিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁদের হীরকজয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ। সংকলনটির কেন্দ্রীয় বিষয় নারী। সুকুমারী ভট্টাচার্য, রমাকান্ত চক্রবর্তী, সুধীর চক্রবর্তী, যশোধরা বাগচী, কেতকী কুশারী ডাইসন, স্বপন বসু, মালেকা বেগম প্রমুখ স্বনামধন্য প্রবীণ লেখকদের পাশাপাশি আছে একেবারে নবীনদের চিন্তাভাবনার নথি; যেমন সুমনা দাস সুরের ‘অবরোধবাসিনী থেকে সবলা: নারী ঔপন্যাসিকের চোখে নারীর আত্মপরিচয় সন্ধান’, অংশুমান করের ‘বিংশ শতাব্দীর নারীবাদী সাহিত্য সমালোচনা: একটি রূপরেখা’, কিংবা রুক্মিণী সেনের ‘আত্মকথার নীরবতা: বাঙালি মহিলাদের আত্মজীবনী’।
সংকলনের প্রথম তিনটি অংশে প্রাচীন এবং মধ্যযুগের ভারতীয় সমাজে নারীর অবস্থান থেকে উনিশ-বিশ শতকের বাংলা পর্যন্ত ছড়িয়েছে প্রবন্ধের ভরকেন্দ্র। চতুর্থ-পঞ্চম অংশের তেরোটি প্রবন্ধের বেশ কয়েকটিতে ভারতীয় বা বঙ্গনারী এসে পড়েছেন প্রবন্ধের মূল তাত্ত্বিক কাঠামোটিকে পোক্ত করতে। সম্পাদকের ‘শুরুর কথা’ স্বচ্ছন্দে ঢুকে পড়তে পারত গ্রন্থের পঞ্চম অংশে। তা হলে সম্ভবত ওই পঞ্চম অংশেই কাটা হত সংকলনের সূচনার পথ। সে-পথে দু’টি বাধা আছে। সুকুমারী ভট্টাচার্যের সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটুকু এমন সংকলনের সূচনাতে থাকাই যেন বিধিসম্মত। যথেষ্ট জরুরি তথ্যের উল্লেখের সঙ্গে হীরকজয়ন্তীর শুভেচ্ছাবার্তার আমেজও যেন মিলে যায় ওই স্বল্পদৈর্ঘ্যের বয়ানে। দ্বিতীয়ত, ‘অবিশেষজ্ঞ সাধারণ পাঠকসমাজের কাছে পৌঁছনো’-ই সম্পাদকের অভীষ্ট (পৃ: ১৩)। সবিনয়ে বলি, কোনও প্রবন্ধের শিরোনাম যদি হয় ‘বর্গীয় পুরুষতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের আলোকে বঙ্গীয় আদর্শ নারী’, সাধারণ পাঠক ভরসা পাবেন তো সে-প্রবন্ধ পড়তে? বাংলা সংকলনে প্রবন্ধগুলিকে সকলের আগে তো বাংলা হতে হবে!
যে-সব প্রবন্ধ এক টুকরো খণ্ড-বিষয় নিয়ে যাত্রা শুরু করে পৌঁছতে যায় সমগ্রের বিন্যাসে, তাদের চলনে-বলনে বেশ একটা খোলামেলা ভাব থাকে। কোনও একটি প্রবন্ধে তো একটি বিষয় প্রসঙ্গে যা-কিছু কথা, তার সব সেরে ফেলা যায় না। তাই রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়ের ‘পদ্মিনীর আখ্যান: ইতিহাসের বিভিন্ন পাঠ’, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উনিশ শতকী টানাপোড়েন: এক অখ্যাত লেখিকার সামাজিক নাটক’, অভ্র ঘোষের ‘লিঙ্গ-অনপেক্ষ মনুষ্যত্বের চর্চা এবং রবীন্দ্রনাথ’ নারীবিশ্বের নিরিখে বিশেষ অর্থবহ কিছু প্রশ্ন তোলে। রাজনৈতিক আন্দোলনে কল্পনা-প্রীতিলতাদের ভূমিকা প্রসঙ্গে মালিনী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি শেষ হয়েও ফেলে রেখে যেতে পারে খানিকটা মুক্ত পরিসর। পদ্মিনীর আদর্শ থেকে কোনখানে কল্পনা-প্রীতিলতা-লীলা’রা ভিন্ন বিশ্বাসের মানুষ, অন্য প্রতিবাদের শরিক, সে-ইঙ্গিতে মালিনীর লেখাটির সমাপ্তি। পরাধীন এবং স্বাধীন দেশের স্তরে-স্তরান্তরে মেয়েদের রুখে দাঁড়ানোর কাহিনি মেলে জয়া মিত্র এবং রাজশ্রী বসুর লেখাতে।
সমগ্রের সাধনায় স্নাত প্রবন্ধে তথ্যের বা বিশ্লেষণের খামতি থাকাটাই স্বাভাবিক। সে-খামতি বড় হয়ে ওঠে না, যদি লেখার ভিতরে, এক নির্দিষ্ট পরিশিষ্টের অন্বেষণে বিকল্প পরিশিষ্টের সম্ভাবনা হারিয়ে না-যায়। কিন্তু সচরাচর পূর্বনির্ধারিত কোনও পরিশিষ্টকে প্রমাণ করাই হয়ে ওঠে আমাদের উদ্দেশ্য। ঈশিতা চক্রবর্তীর বাঙালি নারীর আত্মকথা বিষয়ক প্রবন্ধে লীলা মজুমদার, পুণ্যলতা চক্রবর্তী আর সাহানা দেবীর স্মৃতিচিত্রণকে বলা হয়েছে স্মৃতিতে নিশ্ছিদ্রসুখী ভারতীয় পরিবার নির্মাণের জাতীয়তাবাদী দায়বহন। সে-কথকতায় বাড়ির বড়রা সকলে স্নেহময়, মহৎ, উদার (পৃ: ৩৪৫)। পাকদণ্ডী-র পাঠক মনে করতে পারেন, লীলা মজুমদারের স্বনির্বাচিত বিবাহের মুখোমুখি লেখিকার বাবার অনমনীয় মনোভাবের প্রসঙ্গ, বাবার মৃত্যুর পর লেখিকার সেই মর্মান্তিক অনুভূতি যে এ-সম্পর্ক বহু দিন আগেই হারিয়ে গেছে তাঁর জীবন থেকে; অথবা তাঁর ভাগ্নি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাওয়ার পরে যে সেই মানুষটিকেই অস্বীকার করতে চায়, যিনি তাঁকে অসহায়তার দিনে সবচেয়ে বেশি জানতেন! স্মৃতিকথার অন্তর্গত বিচিত্র অর্থের বিভিন্ন টুকরো ঈশিতা বাদ দিয়ে যান একটি নিটোল পরিশিষ্ট বানানোর তাগিদে। আবার ‘যাত্রা-থিয়েটারে মেয়েরা’ শীর্ষক তথ্যবহুল প্রবন্ধে প্রভাতকুমার দাস বাদ দিয়ে যান মায়া ঘোষ, অনসূয়া মজুমদার বা দীপা দাশমুন্সীর মতো নাম। তাঁদের কথা ছাড়া যাত্রা-থিয়েটারে মেয়েদের আলোচনায় শিল্প কি মিলতে পারে ইতিহাসের সঙ্গে?
সাহিত্যে মেয়েদের অবস্থান যেটুকু এ সংকলনে আলোচিত, তাতে স্বল্পপঠিত কিন্তু প্রাসঙ্গিক কথাশিল্পীরা কয়েকজন অনুপস্থিত। এ অনুপস্থিতি ইচ্ছাকৃত নয়। এ ধরনের সংকলন সচরাচর বিষয়-কেন্দ্রিক না-হয়ে লেখক-কেন্দ্রিক হয়। যাঁরা আনুষঙ্গিক বিষয়টি নিয়ে চিন্তা বা গবেষণা করেছেন, তাঁদের গবেষণার একটু টুকরো চলে আসে সংকলনে। কিছু মূল্যবান লেখা একত্র হয়, কিন্তু কোনও বিষয় অনুপস্থিত থাকে, কিছুর বা ঘটে পুনরুক্তি। তবে তুলনায় কম-আলোচিত বিষয়ে আলোকপাত করেছেন প্রদীপ বসু তাঁর ‘নারী-উন্নতি ও বাঙালি পরিবারে নতুন স্বাস্থ্যবিধি’ প্রবন্ধে। মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত দৈনন্দিনের অবিচ্ছেদ্য যে বিজ্ঞাপন, তা নারীর সম্মানকে কতখানি হেয় করে, তাকে নতুন বোঝাপড়ার চেষ্টা আছে ঈপ্সিতা চন্দর লেখাটিতে। জানা তথ্যকেও যে নতুন ধরনে সাজিয়ে চিন্তার নতুন হদিশ খোঁজা যায় তার প্রমাণ সীমন্তী সেনের উনিশ শতকের বাংলায় নারীশিক্ষা বিষয় প্রবন্ধ। সুদেষ্ণা চক্রবর্তীর লেখায় চতুষ্পাঠীর বিদুষীদের কথা প্রক্ষেপের মতো এল। বাঙালির আলোকপর্বের পুনর্মূল্যায়নে হটি-দ্রবময়ী-রূপমঞ্জরীদের স্বল্পজ্ঞাত আখ্যানকে আরও বিস্তারে ফিরে দেখার প্রয়োজন আছে।
যে সংকলনের নামই নারীবিশ্ব, সেখানে গতর-খাটা মেয়েদের রুজির দুনিয়াটার আর একটু গুরুত্ব প্রাপ্য ছিল। গত শতকের সত্তর দশকে ফুলরেণু গুহ কমিটির রিপোর্ট টুওয়ার্ডস ইকুয়ালিটি-তে গ্রাম থেকে শহরে কাজ খুঁজতে আসা নারী-পুরুষের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাকি ভারতের পার্থক্যের কথা ছিল। আজ যে দক্ষিণবঙ্গ থেকে সূর্যোদয়ের আগে লোকাল ট্রেনে চেপে কলকাতায় বাবুবাড়ি সাফসুতরো করতে আসে কাতারে কাতারে মেয়ে, আবার সূর্যাস্তের পরে ফিরে যায় গ্রামে, এ প্রবণতা ওই রিপোর্টের পরবর্তী। সম্প্রতি আবার এই হাড়ভাঙা ছুটোছুটির একটা বড়সড় বিকল্প নাকি তৈরি হয়েছে ঘরে বসে সলমা-চুমকির কাজে। মেশিন বাইন্ডিং চালু হওয়ার পরে মহিলা বাঁধাইকর্মীদের চাহিদাও কমতির পথে। এ সবই কি নারীবিশ্বের অংশ নয়? অবশ্য বিয়াল্লিশটি প্রবন্ধের বইটির আলোচনায় যদি কেবল কী নেই তার ফিরিস্তি বানাই, তা হবে অত্যন্ত অসমীচীন। আসলে সম্পাদক যে শুরুতেই বলেছেন, ‘আপনার মুখ আপনি দেখবার প্রচলিত ঘরানার বাইরে ঈষৎ ব্যতিক্রমী চরিত্রের এক স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সে (শ্যামসুন্দর মহাবিদ্যালয়) চেয়েছে তার হীরকজয়ন্তী উদযাপন করতে এবং এই ভাবে বৃহত্তর সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কিছু স্বাক্ষর রাখতে (পৃ: ১৪)।’ এমন সম্পাদকীয় অন্বিষ্ট থেকেই প্রশ্নটি তোলা।
আপনার মুখ আপনি দেখার বিকল্প কি আপনার সঙ্গে নিরাপদ দূরত্ব নির্মাণ করা? দৈনন্দিন যাপন ও চিন্তনের যে আঙিনা শ্যামসুন্দর মহাবিদ্যালয়ের অনেক কাছাকাছি, তেমন শিক্ষা ও রুজির দুনিয়া, অন্দর-বাহিরের ঘাত-প্রতিঘাতের বিশ্ব এ সংকলনে এল না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান আর কলা বিভাগের ছাত্রছাত্রীর অনুপাতের তালিকা (যা আছে জবা গুহর মূল্যবান লেখা ‘বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও লিঙ্গসমতা’য়) কি শ্যামসুন্দর বা তার অনুরূপ মহাবিদ্যালয়গুলির প্রাসঙ্গিক চিত্র সম্বন্ধে কোনও স্পষ্ট ধারণা দেয়? কলেজ এমনকী বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা একটি নিতান্ত সাধারণ মেয়ের জীবন এবং জীবিকার সমস্যা আর সম্ভাবনা কতখানি জটিল হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকাল থেকে বিশ্বায়নের দিন-দুনিয়ায়? রুজির নানান বিকল্প যখন খুলছে মেয়েদের সামনে, তখন কি আসলে একটা দেশের বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক স্তরের নারীদের মধ্যে বাড়ছে অর্থনৈতিক দূরত্ব? সংকলনের চতুর্থ অংশের সব ক’টি প্রবন্ধই কিন্তু এই সব চিন্তাকে কোনও-না-কোনও ভাবে বহন করে। কিন্তু সেই বহনের সূত্রে আপনার মুখ আপনি না-দেখায় ব্রতী এই প্রকল্প অবিরত চেনামুখের জন্য প্রকৃত পরিসর, গুরুত্ব আর সম্মানের হদিশ দিল না।
First Page Alochona Next Item


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.