|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
ত্রিকোণ দাম্পত্য |
এক স্বামী। দুই স্ত্রী। এ বার তাঁদের দুই সন্তান। পুপাই আর মুনাই। উপন্যাসকে হার
মানানো জীবন। দুই সন্তানের অন্নপ্রাশনে উপস্থিত ছিলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
ত্রিকোণ প্রেম হয়, কিন্তু ত্রিকোণ দাম্পত্য? সে আবার হয় নাকি?
হয় এবং দুর্দান্ত সফল ভাবে হয়। সে প্রমাণ রাখছেন গড়িয়ার কৌশিক, ঝুমা এবং সোমা দত্ত। ২০০৮-এর ২১ সেপ্টেম্বর যে বিয়ে মিডিয়ায় তোলপাড় তুলেছিল, তার সুখী ঘরকন্নার প্রমাণ আরেক বার রাখলেন তাঁরা গত সোমবার। দুই ছেলের অন্নপ্রাশন হল পরিবারিক উষ্ণতায়। ধুমধাম হল, লোক খেল, ঠিক যেমন বাকি মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে হয়।
তবুএত সুখী হয় ত্রিকোণ দাম্পত্য?
একই লোককে বিয়ে করা না হয় হজম করা গেল, কিন্তু বাচ্চাও প্রায় একই সঙ্গে! রহস্যটা কী? প্ল্যান করে নাকি কাকতালীয়? ঝুমা-সোমা বলেন, ‘ডেস্টিনি।’ গড়িয়ার কামডহরির মধ্যবিত্ত পাড়ায় পড়শিরা বলেন, ‘ম্যাজিক!’ আপাত সাধারণ তিন তলা বাড়ির এ হেন অসাধারণ পরিবারকে নিয়ে স্বাভাবিক কৌতূহল “এই যুগে দুই সতিন এক বাড়িতে এত ভাল থাকে কী করে!”
‘সতিন’ শব্দটাতেই ভয়ানক আপত্তি ঝুমাদের। ওটা নাকি শরৎচন্দ্রের বই অবধি চলত। এখন ব্যাকডেটেড। শুনলেই মনে হয় দু’টো ষাঁড় শিং ঠোকাঠুকি করছে। “হয়তো অনেকের শুনলে ন্যাকামি মনে হবে, কিন্তু আমরা দুই বোন দু’টো শরীর, এক সত্তা, এটাই আমাদের জীবনের সত্য। তা ছাড়া আমাদের তিনজনের রিলেশনশিপে বন্ধুত্বই ফার্স্ট, বন্ধুত্বই লাস্ট। এটাই বোধহয় আমাদের সুখে থাকার গুপ্তমন্ত্র।”
আর কৌশিক? পরিচিত কত জন যে তাঁকে একান্তে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলেছেন, “তুই বাঘের বাচ্চা! যা চেয়েছিলি করে দেখিয়েছিস। আর আমাদের দ্যাখ, ভ্যাদভ্যাদে জেলিফিশের মতো! সাধ আছে, সাহস নেই।” কৌশিক হাসেন, “সাহসের দরকারও নেই। সবার কম্মো নয়। সামলাতে পারবে না। লঙ্কাকাণ্ড বেধে যাবে। আমি বিন্দুমাত্র এনকারেজ করব না।” পরিচিত-অপরিচিতের ঈর্ষা, ব্যঙ্গ, প্রশ্রয়, প্রশংসা, বিস্ময় উপভোগ করে তিনি তোফা আছেন এক ছাদের তলায় দুই স্ত্রী এবং দুই ছেলেকে নিয়ে! |
|
দুই ছেলেকে নিয়ে কৌশিক, ঝুমা আর সোমা। ছবি: কৌশিক সরকার |
ঝুমা এখন ৪০, সোমা ৩৭ আর কৌশিক ৪১। কৌশিকের সঙ্গে আলাপ সেই ১৯৮৮ সাল থেকে। তার পর ২০ বছর ত্রিকোণ প্রেম। অতঃপর দু’বছর আগে ছয় হাতের মিলন এবং একসঙ্গে হানিমুন। অদৃষ্ট সেখানেই চমক না থামিয়ে মুচকি হেসে বলেছিল, ‘পিকচর অভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।’ অতএব, দু’বছর পরে প্রায় একই সঙ্গে দুই স্ত্রী গর্ভবতী। সন্তানের জন্ম মাত্র তিন মাস আগে-পরে। একটি আট মাসের, একটি পাঁচ। দু’টিই ছেলে। স্বপ্নিল (পুপাই) আর উজান (মুনাই)।
কিন্তু আত্মীয়-স্বজন, পাড়া, কর্মক্ষেত্র, বন্ধুবান্ধব? তিন জনেরই ব্যাখ্যা, “আসলে আমাদের সব সময় একসঙ্গে দেখতেই সবাই এত অভ্যস্ত ছিল যে বিয়ের কথা শুনে কারও অদ্ভুত ঠেকেনি। মনে হয়নি কোনও অসম্ভব বস্তু হতে চলেছে। এটা যেন হওয়ারই ছিল। আর তার থেকেও বড় কথা, পৃথিবীতে খুব ভাল কোনও কাজ করেও সবাইকে খুশি করা যায় না। কেউ না কেউ সেই ভাল কাজেও অসন্তুষ্ট হবে। তাই অত ভাবিনি। আমাদের মন যা চেয়েছে করেছি।” আইনি জটিলতা? আসেনি, যেহেতু দুই স্ত্রী-র কারও এ ব্যাপারে আপত্তি ছিল না। বিয়ে তো হল, কিন্তু ফুলশয্যা? সেটাও কি একসঙ্গে, এক খাটে? “হয়নি তো। ওই রকম গতে বাঁধা কোনও কিছুই হয়নি। পরে যে কাজই হয়েছে আলাদা আলাদা হয়েছে। আমরা একে অপরের প্রাইভেসিকে অসম্ভব সন্মান করি। কেউ-কারও স্পেসে ঢুকি না। দু’টো বছর সুন্দর ভাবে কাটিয়ে দিলাম।” তবু, এমন ব্যতিক্রমী জায়াযুগল ও পতির যৌনজীবন নিয়ে কৌতূহল স্বাভাবিক। কেউ সেটা ঠারেঠোরে জিজ্ঞাসা করেন, কেউ সোজাসুজি। কেউ আবার জিজ্ঞাসা না করে নিজেদের মধ্যে নিজেদের মতো করে ভেবে নেন।
কৌশিকের নাকি আলাদা ঘর আছে। আর দুই বোন শোন অন্য একটা ঘরে পাশাপাশি এক খাটে, এক সঙ্গে। তা হলে সহবাস? আপনারা কি আলাদা-আলাদা ভাবে কৌশিকের ঘরে যান? কৌশিক ডেকে নেন, না কে যাবে সেটা সোমা-ঝুমা সিদ্ধান্ত নেন? নাকি একসঙ্গেই, মানে......। “না, না। তালিবানদের মতো এক খাটে একাধিক স্ত্রীকে নিয়ে শোওয়ার মতো কাণ্ড একেবারেই নয়। পুরোটাই আন্ডারস্ট্যান্ডিং, প্রত্যেকের প্রাইভেসিকে গুরুত্ব দিয়ে। সেক্সটা তো আসলে খুব স্বাভাবিক একটা বিষয়। জীবনের অংশ, বাথরুমে যাওয়ার মতো। অত হিসেবনিকেশ করে কিছু হয় না,” দুই বোন আর তাঁদের বর মোটামুটি একসঙ্গেই বলে ওঠেন।
কিন্তু প্রশ্নও তো থেকে যায়। কৌশিক এক বোনের সামনে অন্য বোনকে নিয়ে দরজা বন্ধ করলে কেমন লাগে? কেমন লাগে অফিস থেকে ফিরে কোনও এক বোনের নাম ধরে যদি কৌশিক আগে ডাকেন? এক জনের সঙ্গে একান্তে গল্প করেন, জড়িয়ে ধরে টিভি দেখেন বা কোনও এক মুহূর্তে আদর করেন? অন্য জন নিতে পারেন সেটা? কখনও খারাপ লাগা, ঈর্ষা, নিরাপত্তাহীনতা আসে না! |
এক জন হিন্দু ব্যক্তির একসঙ্গে দুই স্ত্রী সম্পর্কে আইন কী বলে? |
এমন কোনও আইন নেই যার মাধ্যমে এক জন স্ত্রী থাকতে কোনও হিন্দু ব্যক্তি আরেক বার বিয়ে করতে পারেন। আইনের চোখে এটা সব সময়েই বে-আইনি। তবে যদি প্রথম স্ত্রী-র কোনও আপত্তি না থাকে এবং তিনি কোনও অভিযোগ দায়ের না-করেন তা হলে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে ওই ব্যক্তি দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারেন এবং দুই স্ত্রী এক সঙ্গে থাকতে পারেন। অনেক সময় ধর্ম পরিবর্তন করে মুসলিম হয়ে অনেকে বিয়ে করেন। যেমন ভাবে ধর্মেন্দ্র বিয়ে করেছিলেন হেমা মালিনীকে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, এই ভাবে বিয়ে করার জন্য ধর্ম পরিবর্তন বে-আইনি। দুই স্ত্রী থাকলে দু’জনের সন্তানই বাবার সম্পত্তির সমান অংশের দাবিদার। তবে প্রথম স্ত্রী বাধা দিলে দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পত্তির কোনও অংশ
পাবেন না। পরামর্শ: আইনজীবী দীপনারায়ণ মিত্র ও
আইনজীবী জয়মাল্য বাগচি |
|
সোমা-ঝুমার দুনিয়া নাকি এটা নিতে পারে। তাঁরা দুই বোন নাকি এখনও এক থালায় ভাত খান, এক রকম জামাকাপড় পরেন, একসঙ্গে টিভি দেখেন, ব্যবসার কাজ করেন, বেড়াতে যান। কৌশিকের জন্য দু’জনে একসঙ্গে রান্না করেন, তাঁর অসুখ হলে একসঙ্গে সেবাও করেন আবার একসঙ্গে বরের সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করেন। সে নাকি কৌশিকের পক্ষে বড় ভয়ঙ্কর সময়। কোনও এক বৌয়ের সঙ্গে ঝগড়া হলেই অন্য জন তাঁর হয়ে ঝগড়া করবেনই। দুই বোন তখন এক দল। কাউকে বকার জো নেই, অন্য জন ফোঁস করে উঠবেন।
এক জন হয়তো গল্পের বই পড়ছেন বা বাচ্চা সামলাচ্ছেন, আরেক জনের সঙ্গে তখন কৌশিক গল্প করছেন। আবার কখনও তিন জনে বসেই আড্ডা হচ্ছে।
এর মধ্যেই পুপাই আর মুনাই এসে পড়ল। এক সঙ্গেই বাচ্চা চেয়েছিলেন ঝুমা-সোমা। তাতে বাচ্চা সামলানোর হ্যাপা একবারে মিটে যায়। এক চিকিৎসককেই দেখালেন। গর্ভবতীও হলেন কয়েক মাসের ব্যবধানে। ছোট বোন সোমার বাচ্চা হল তিন মাস আগে। স্বপ্নিল। ঝুমার তার পর। উজান। এক হাসপাতালেই হয়েছে। উজানের জন্মের দিন সোমা আর স্বপ্নিল সারা দিন-রাত ঝুমার সঙ্গে ছিল।
কিন্তু পুপাই-মুনাইয়ের সম্পর্কটা কী রকম হবে? তারা যে আপন ভাই আবার মাসতুতো ভাইও। সম্পর্কটা কি একটু জটিল নয়? দুই মা উড়িয়ে দেন। “ওরা আমাদের ছেলে, আমরা ওদের মা। বড় হলে একজনকে ডাকবে মামণি আর এক জনকে মাম্মাম। এক স্কুলে এক ক্লাশে পড়বে। খুব ইচ্ছা এক দিনে বিয়েও করবে।” কিন্তু সেখানেও কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি হতে পারে। একটু বড় হলে স্কুলে বন্ধুরা যদি বলে, তোদের একটা বাবা দু’টো মা কেন? তখন সামাজিক অসুবিধা যদি হয়?
কৌশিক আর সোমা চুপ করে যান। এ বার শুধু ঝুমা বলেন, “কিছু জিনিস ভবিষ্যতের উপর ছেড়ে দেওয়া ভাল। যারা সিঙ্গল মাদারের সন্তান, যাদের বাবার পরিচয় নেই, যারা অনাথ, অন্তত তাদের থেকে তো ওদের কম যুদ্ধ করতে হবে। বাকি যা বাধা আসবে ওদেরকেই সেটা টপকাতে হবে। শক্ত হতে হবে। বাস্তবকে ফেস করতে হবে।”
হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যাওয়া পরিবেশটা দুম করে কেটে গেল স্বপ্নিলের খিলখিল হাসিতে। দুই মায়ের কোলে হইহই করে বেড়াচ্ছে দুই বিচ্ছু। সে দিকে তৃপ্ত মুখে তাকিয়ে থাকা কৌশিককে একটা শেষ প্রশ্ন করার লোভ সামলানো গেল না। আচ্ছা আপনি তো বিশ্বাস করেন এক সঙ্গে একাধিক জনকে ভালবাসা যায়। যদি আরও কোনও নারী আসে জীবনে? ঝুমা-সোমার পাশে তাঁরও জায়গা হবে তো?
কৌশিক কথা বলার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন তাঁর জীবনের দুই নারী। “দু’জনই যথেষ্ট। অন্য কারও সঙ্গে একটু বেশি মেলামেশা হচ্ছে বুঝতে পারলেই আমরা টাইট করে দিই। চতুর্থ কারও জন্য আর কোনও স্পেস নেই আমাদের কাছে। ঝেঁটিয়ে বিদায় করব।” |
|
|
|
|
|