যথেচ্ছ প্লাস্টিক
আইন ক্যারিব্যাগে
ইন আছে, আছে নিষেধাজ্ঞাও। কিন্তু তার জন্য নিষিদ্ধ প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহারে কোনও ব্যাঘাত ঘটছে না!
ভবানীপুরের চক্রবেড়িয়ার ফুটপাথ থেকে মাছ কিনছিলেন মধ্যবয়স্কা এক মহিলা। মাছবিক্রেতা একটি পাতলা প্লাস্টিকের ব্যাগে মাছ দিয়ে আর একটি পলিব্যাগে ভরে দিলেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা ওই বিক্রেতাকে আরও একটি প্লাস্টিকে মাছটি ভরে দিতে বললেন। তাঁর বক্তব্য, না হলে মাছের রক্ত অন্য সব্জিতে লেগে যাবে। শেষমেশ তিনটে প্লাস্টিক ব্যাগে মাছ ভরে হাঁটা দিলেন ভদ্রমহিলা।
কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ পুর এলাকার বিভিন্ন প্রান্তেই চলছে ৪০ মাইক্রনের কম ঘনত্বের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার। পুরসভার বাজার থেকে বিভিন্ন দোকানপাট সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে ক্রেতাদের হাতে ধরানো হচ্ছে প্লাস্টিকের পলিব্যাগ। অনেক ক্ষেত্রে এই ক্যারিব্যাগ ছাড়া ক্রেতারাও জিনিসপত্র নিতে চাইছেন না। আর তার পরিণাম ভয়ঙ্কর। রাস্তাঘাট, বিভিন্ন জলাশয়, নর্দমায় জমা হচ্ছে প্লাস্টিকের আবর্জনা। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জলনিকাশির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। অথচ রাজ্য পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ৪০ মাইক্রনের নীচে সমস্ত রকম প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ নিষিদ্ধ করে। আরও বলা হয়, ১২ ইঞ্চি বাই ১৬ ইঞ্চি মাপের থেকে ছোট কোনও প্লাস্টিক পলিব্যাগ তৈরি করা, বিক্রি করা, মজুত রাখা কিংবা ব্যবহার করা সম্পূর্ণ রূপে নিষিদ্ধ। এরই পাশাপাশি, রাজ্য জুড়ে ৪২টি জায়গাকে ‘প্লাস্টিক-মুক্ত’ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আইন অনুসারে, এ সব এলাকায় প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের বোতল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ।
কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, পরিবেশ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কলকাতার বিভিন্ন বাজার-দোকানে চলছে পলিব্যাগের নির্বিচার ব্যবহার। বাড়ছে পরিবেশ দূষণ সংক্রান্ত সমস্যা, তৈরি হচ্ছে জলনিকাশির সমস্যাও। অথচ সরকারি দফতর, পুরসভা কিংবা সাধারণ মানুষ, কারওরই ভয়ঙ্কর এই সমস্যা সম্পর্কে যেন কোনও মাথাব্যথাই নেই। কেবলমাত্র কয়েক বার অভিযান চালিয়েই ক্ষান্ত পুরসভা।
পুরসভার পক্ষ থেকে সম্প্রতি কোনও পর্যবেক্ষক দল বাজারগুলি পরিদর্শন করতে আসেননি? দক্ষিণ কলকাতার ল্যান্সডাউন বাজার কমিটির সম্পাদক সুনীলকুমার সরকার বললেন, “বছরখানেক আগে এক বার পুরসভার পক্ষ থেকে পর্যবেক্ষক দল এসে কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে নোটিস টাঙিয়ে দিয়ে যায়। তার পর কিছু দিন প্লাস্টিকের পলিব্যাগ ব্যবহার বন্ধ ছিল। কিন্তু এখন আবার যে-কে-সেই।” কিন্তু তাঁরা কেন ক্রেতাদের পলিব্যাগ দেন? সুনীলবাবুর মন্তব্য: “না দিলে কেউ জিনিস কিনতে চাইবেন না। বাইরে ফুটপাথের দোকান থেকে কিনবেন। বাজারের ভেতরের দোকানগুলি মার খাবে। সেই ভয়ে দোকানদাররাও প্লাস্টিকের ব্যাগ দেন। কিন্তু ৪০ মাইক্রনের উপরের একটি পলিব্যাগের দাম পড়ে প্রায় ১ টাকা। ফলে সামান্য জিনিস কিনলে যেখানে আমাদের লাভ ৫০ পয়সা কিংবা ১ টাকা, সেখানে ওই প্লাস্টিক ব্যাগ দিলে লোকসান হবে।”
একই বক্তব্য উত্তর কলকাতার মানিকতলা বাজার কমিটির সম্পাদক প্রভাতকুমার দাসেরও। পলিব্যাগ ব্যবহার প্রসঙ্গে তিনি অবশ্য পুরো দায়টাই চাপিয়ে দিয়েছেন ক্রেতা এবং পলিব্যাগ তৈরির কারখানাগুলির উপর। তিনি বলেন, “আগে খদ্দেররা হাতে ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে আসতেন। এখন খালি হাতে আসেন এবং যাই কেনেন পলিব্যাগ ছাড়া জিনিস নিতে চান না। আমরা না দিলে অন্য কেউ দেবে। বাজারের দোকানদারদের ব্যবসা মার খাবে।” তাঁর কথায়: “প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে গেলে যে কোম্পানি বা কারখানাগুলি প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি করে সেখানেই ৪০ মাইক্রনের নীচে পলিব্যাগ তৈরি বন্ধ করতে হবে। সরকারের উচিত সেই জায়গায় কঠোর ভাবে নজর দেওয়া।”
কলকাতার উত্তর থেকে দক্ষিণ, শুধুমাত্র পুরসভার বাজার নয়, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন বাজার, ফুটপাথের প্রতিটি দোকান থেকে শুরু করে খাবারের দোকান, মুদির দোকান, ফলের দোকান, সর্বত্র নিষিদ্ধ প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগের ব্যবহার চলছে। কিন্তু যথেচ্ছ ব্যবহারে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ ও জলাশয়। রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে শহরের জলনিকাশি ব্যবস্থা। কিন্তু তার পরেও পুরসভা নিশ্চুপ কেন? পুরসভার মেয়র পারিষদ (জলনিকাশি) রাজীব দেব বললেন, “যে আইন আছে তা কঠোর ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। না হলে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়।” প্লাস্টিক জমে জলনিকাশিতেও যে সমস্যা হচ্ছে তা স্বীকার করে তিনি বলেন, “সমস্যা তো হচ্ছেই। ফলে বর্ষার আগে পাম্পিং মেশিন ব্যবহার করে ম্যানহোল দিয়ে সমস্ত আবর্জনা টেনে এনে পরিষ্কার করতে আরও কষ্ট হচ্ছে।”
কিন্তু শুধু কি সাধারণ মানুষের সচেতনতাতেই কাজ হবে? না কি প্লাস্টিক তৈরির কারখানা থেকে এই ক্যারিব্যাগ তৈরি বা বিক্রি বন্ধ করতে হবে? রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বললেন, “আমরা নতুন ভাবে মাস্টারপ্ল্যান করছি যাতে কারখানাতেই এই প্লাস্টিক ব্যাগ তৈরি বন্ধ করা যায়। আমরা সমস্যার কথা জানি বলেই সরকারে এসে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং পরিকল্পনা করছি। এই ধরনের প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ তৈরি বন্ধ না করলে এর ব্যবহারও বন্ধ করা যাবে না।”
ছবি: পিন্টু মণ্ডল
Previous Story

Kolkata

Next Story

 



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.