|
|
|
|
আলোচনায় রাজি আছে রাজ্যও |
সিঙ্গুর নিয়ে সংঘাতে যেতে চায় না টাটারা |
জয়ন্ত ঘোষাল • নয়াদিল্লি |
রাজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাত নয়, সিঙ্গুর নিয়ে আলোচনার পথেই হাঁটার কথা ভাবছে টাটা গোষ্ঠী।
সিঙ্গুর আন্দোলনে ভর করে ক্ষমতায় আসার পরে সেখানকার ‘অনিচ্ছুক’ চাষিদের জমি ফেরতের বিষয়টিকে পাখির চোখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার পর বিধানসভার আসন্ন অধিবেশনের গোড়াতেই ন্যানো প্রকল্পের পুরো জমির লিজ-চুক্তি বাতিল করতে বিল আনতে চলেছে রাজ্য সরকার। রাজ্যের এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও টাটা গোষ্ঠীর অন্দরের খবর, নতুন সরকারের সঙ্গে গোড়া থেকেই সংঘাতে যাওয়ার পক্ষপাতী নয় তারা। বরং জমি হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনায় বসতে টাটাদের যে আপত্তি নেই, সেই ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই মিলেছে।
সিঙ্গুরের বিষয়টি দেখার জন্য শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এর পরেই পার্থবাবু পশ্চিমবঙ্গ শিল্পোন্নয়ন নিগমের কর্তাদের টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নিগমের কর্তাদের টাটা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজ্য সরকার তার প্রস্তাব লিখিত ভাবে জানালে তারাও আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। এর থেকে একটা জিনিস স্পষ্ট যে, সিঙ্গুর নিয়ে টাটা গোষ্ঠী খুব সাবধানে পা ফেলতে চাইছে। তারা এক দিকে যেমন সরকারি পদক্ষেপের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেনি, তেমনই অন্য দিকে এ-ও জানায়নি যে, বিলের বক্তব্য তারা মেনে নিচ্ছে। |
|
‘সিঙ্গুরের জমি উন্নয়ন ও পুনর্বাসন বিল’ বিধানসভায় পাশ হওয়ার পরে (১৪ জুন বিলটি পেশ হওয়ার কথা এবং তৃণমূলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার নিরিখে তা পাশ হওয়া স্রেফ সময়ের অপেক্ষা) কী করা হবে, তা নিয়ে টাটা গোষ্ঠীর অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছে। সংস্থার একটি অংশের বক্তব্য, বিলটিকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাওয়া উচিত এবং সামগ্রিক ভাবে ৯৯৭.১১ একর জমির জন্যই ক্ষতিপূরণ দাবি করা উচিত। আবার এর উল্টো মতও রয়েছে। সংস্থার ওই অংশটির বক্তব্য, আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করে ফেলাই শ্রেয়। সে ক্ষেত্রে ‘অনিচ্ছুকদের’ ৪০০ একর বাদ দিয়ে বাকি জমিতে কারখানা করার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তাঁরা। এ কথা বলতে গিয়ে তাঁরা ২০০৯ সালে মুম্বইয়ে সংস্থার বার্ষিক সভায় রতন টাটার বক্তব্য তুলে ধরছেন। টাটা সে দিন বলেছিলেন, গুজরাতে ন্যানো গাড়ির উৎপাদন শুরু হয়ে গেলেও সিঙ্গুরে ফিরে যাওয়ার বিষয়টি তাঁরা খোলা রাখছেন। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা রয়েছে। টাটা মোটরসের অধিকাংশ কর্তাই মনে করেন, কারখানা গড়ার জন্য ৯৯৭.১১ একর জমিই জরুরি। ফলে ‘অনিচ্ছুকদের’ দাবি মিটিয়ে বাকি জমিতে কারখানা গড়ার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
টাটারা অবশিষ্ট জমিতে কারখানা গড়লে রাজ্য সরকারের অবশ্য আপত্তি নেই। মমতার কথায়, “আমরা কোনও শিল্প গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আমরা অনিচ্ছুক চাষিদের পক্ষে। অনিচ্ছুক চাষিদের ৪০০ একর ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে নির্বাচনের আগে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমরা এখন সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে চাই।” কিন্তু সেই ‘প্রতিশ্রুতি’ রাখার পরে সিঙ্গুরে টাটাদের আসার সম্ভাবনা অন্তত এই মুহূর্তে যে ক্ষীণ, তা বুঝতে পারছে রাজ্য সরকার। সেই কারণেই তাদের লক্ষ্য, পুরো জমিটাই টাটাদের হাত থেকে ছাড়িয়ে এনে তার পর বাকি জমিতে রেল বা অন্য কোনও সংস্থাকে শিল্প করতে ডাকা। এ জন্য টাটাদের ক্ষতিপূরণ দিতেও যে সরকার রাজি, তা জানিয়ে দিয়েছেন মমতা নিজেই। তবে একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, “ক্ষতিপূরণ ঠিক হবে নিরপেক্ষ আরবিট্রেটরের মাধ্যমে।”
টাটা গোষ্ঠী আগের বামফ্রন্ট সরকারকে জানিয়েছিল, সিঙ্গুরে কারখানা তৈরি করতে গিয়ে তাদের ৬১০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তবে সিঙ্গুর থেকে কিছু যন্ত্রাংশ সানন্দে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ৫৫৮ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পেলে জমির স্বত্ব ছেড়ে দিতে যে তারা প্রস্তুত, তা জানিয়ে দিয়েছিল টাটা গোষ্ঠী। এই বিষয়টি নিয়ে টাটাদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে আপত্তি নেই রাজ্য সরকারের। টাটারাও যে গররাজি নয়, সেই ইঙ্গিত মিলেছে।
তবে আলোচনার দরজা খোলা রেখেও আইনি পথে আটঘাট বেঁধেই এগোতে চায় রাজ্য। সিঙ্গুর নিয়ে ২০০৭-এর মার্চে শিল্পোন্নয়ন নিগমের সঙ্গে টাটাদের যে চুক্তি হয়েছিল, তাতে বলা হয়েছে, তিন বছরের মধ্যে প্রকল্পের জন্য জমি ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু মাঝপথে ২০০৮-এর ৩ অক্টোবর প্রকল্প বাতিল ঘোষণা করে চলে যায় টাটারা। এর পরে ২০১০-এর জুনে সিঙ্গুরের জমি নিয়ে তাদের অবস্থান জানতে চেয়ে নোটিশ পাঠায় নিগম। টাটাদের বক্তব্য, তারা সিঙ্গুরে প্রকল্পের কাজ ৮০ শতাংশের বেশি করে ফেলেছিল। সুতরাং এ ক্ষেত্রে চুক্তির ওই ধারা বলবৎ হতে পারে না। টাটাদের এই যুক্তির কথা মাথায় রেখেই প্রস্তাবিত সিঙ্গুর-বিলে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্থান রাখা হচ্ছে বলে রাজ্য সরকারি সূত্রের খবর। যাতে জমি ফেরানোর পথে টাটারা বাধা হয়ে দাঁড়াতে না-পারে।
সিঙ্গুরের জমিতে যে সব যন্ত্রাংশ নির্মাতা কারখানা গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, জমি ফেরতের সিদ্ধান্তে তাদের অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। টাটারা আসবে ধরে নিয়ে এক্সাইড ব্যাটারি, সোনাকো, রিকো অটো ইত্যাদি সংস্থা সহযোগী শিল্প গঠনের জন্য রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগমকে অগ্রিম অর্থ দিয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা নিগমের কাজ থেকে ওই টাকা ফেরত পাবে বলে আশা করছে।
এখন টাটা ও এই সব সহযোগী সংস্থাকে ক্ষতিপূরণ দিতে গেলে বিপুল পরিমাণ টাকার প্রয়োজন। সেই টাকা কোথা থেকে আসবে, তা নিয়েও রাজ্য সরকারের অন্দরে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। ভাবা হচ্ছে, নতুন কোনও সংস্থা সিঙ্গুরে আসতে চাইলে ক্ষতিপূরণের একাংশ দেওয়ার শর্ত তাদের সামনে রাখা যায় কি না। পাশাপাশি ক্ষতিপূরণের অর্থ কিস্তিতে দেওয়ার জন্যও আরবিট্রেটরের কাছে আবেদন জানাতে পারে রাজ্য। কিন্তু এই সবটাই বাস্তবায়িত করা অনেক সহজ হবে যদি টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে রাজ্য সরকারের শীর্ষ স্তরে আলাপ-আলোচনা হয়। |
|
|
|
|
|