|
|
|
|
|
|
|
এ বার বেছে নেওয়া |
এক-একটা বিষয় নিয়ে পড়তে শুরু করা যেন এক-একটা নতুন দেশে বসবাস শুরু করার মতো, তাই না?
কিন্তু, থাকতে শুরুর আগে দেশটাকে তো একটু জেনে নিতে হবে! তোমরা যে যা বিষয় বেছে নিচ্ছ, সেগুলো
কী ও কেন, তিনটি সংখ্যা জুড়ে আলোচনা করছে প্রস্তুতি। প্রথম পর্বে রইল চারটি বিষয়।
|
বাংলা
বিশ্বজিৎ রায়, শিক্ষক, বিশ্বভারতী
|
বাংলা ভাষা সাহিত্য নিয়ে পড়ে পরবর্তী কালে কী করবে? কেন, পড়ার পর গবেষণা করার নানা সুযোগ রয়েছে! এম এ পাশ করার পর নেট পরীক্ষা দেওয়া যেতে পারে। নেট-এর ফল ভাল হলে জি আর এফ (জুনিয়র রিসার্চ ফেলো) হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, কোনও স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অধীনে গবেষণার জন্য নথিভুক্ত হলে গবেষণাপর্বে ছাত্র/ ছাত্রীরা ফেলোশিপের টাকা পাবেন। প্রথমে জুনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং তার পরে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো। নেট বা সেট দিয়ে যাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন অথচ ফেলোশিপ পাননি, তাঁদের জন্য নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব স্বল্প কিছু স্কলারশিপের ব্যবস্থা আছে। সেই স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য বিজ্ঞাপিত হলে আবেদন করতে হয় ও আবেদন গ্রাহ্য হলে ইন্টারভিউ; তাতে পাশ করলে তবে অর্থপ্রাপ্তি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশে এখন নানা বিশ্ববিদ্যালয়ও গবেষণার যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষা গ্রহণ করেন। যেমন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার যোগ্যতা নির্ণায়ক পরীক্ষার নাম রেট। রেট পরীক্ষায় পাশ করলে কোর্স-ওয়ার্ক করার অনুমতি মেলে। কোর্স-ওয়ার্কে পাশ করলে তবে পিএইচ ডি-র জন্য রেজিস্ট্রেশন পাওয়া যায়। নেট বা সেট পরীক্ষায় যাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাঁদেরও পিএইচ ডি করতে গেলে কোর্স-ওয়ার্ক করতে হবে। কোর্স-ওয়ার্কে পিএইচ ডি সংক্রান্ত নানা বিষয় পড়ানো হয়। যেমন, পিএইচ ডি প্রপোসাল কী করে লিখতে হয়, গবেষণা অভিসন্দর্ভে কেমন করে তথ্য বিন্যস্ত করতে হয়, কী ভাবে তথ্যসূত্র নির্দেশ করতে হয়, এই সব। এ ছাড়াও শিক্ষকেরা নানা কোর্স অফার করেন। যেমন, কেউ হয়তো রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে গবেষণা করবেন বলে ভাবছেন। কোর্স-ওয়ার্কে কোনও শিক্ষক হয়তো রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যদর্শনের ওপর কোর্স অফার করছেন। ওই গবেষক এই কোর্সটি করলে উপকৃত হবেন। মনে রাখতে হবে, ইদানীং বাংলা ভাষা-সাহিত্যের নানা বিষয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা বিভূতিভূষণের প্রকৃতি চেতনা, জীবনানন্দের কবিতায় মৃত্যুচিন্তা জাতীয় বিষয় নিয়ে খুব একটা কাজ করেন না। এ জাতীয় নিবিড় পাঠমূলক কাজ তো অনেক হয়েছে। বাংলা ভাষার পাশাপাশি আর একটা-দুটো ভারতীয় ভাষা জানা থাকলে খুব ভাল হয়। বিশেষ করে ওড়িয়া আর অহমিয়া জানা থাকলে খুব সুবিধে। বাংলা ভাষার সঙ্গে এই দুই ভাষার আদান-প্রদানের সম্পর্ক ছিল। কাজ চালানোর মতো হিন্দি পড়তে জানা চাই। এ ছাড়া ইতিহাসবোধ থাকা জরুরি। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব সম্বন্ধে প্রাথমিক ধারণা ও আগ্রহ থাকলে কাজের সুবিধে হবে।
বাংলা পড়ে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষকতা করাই যায়। কিন্তু সেটাই একমাত্র পথ নয়, একটু বড় করেও ভাবা যেতে পারে। বিদেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যচর্চা বিদ্যা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভাষা-সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র আছে। বাংলা পড়ুয়ারা সেই বিভাগগুলিতে গবেষণার জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে আবেদন করার আগে নিজেদের যোগ্যতায় যেন কোনও ফাঁক না থাকে। শুধু মাতৃভাষায় দক্ষ হলেই হবে না, ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা থাকা চাই। বাংলা ভাষা নিয়ে যাঁরা পড়েন, অনেক সময়েই ইংরেজি ভাষা নিয়ে কুণ্ঠিত। সেই ভয় আর কুণ্ঠা না থাকলে বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাইটে ঢুকে পড়ুয়ারা দেখতে পারেন বাংলা নিয়ে কাজ করার নানা সুযোগ আছে। বিশেষ করে এখন ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যের দাপট থেকে বাইরে আসতে অনেকেই সচেষ্ট। ফলে অন্য ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে ইংরেজিতে কাজ করার সুযোগ ও অবকাশ তৈরি হয়েছে।
চাকরির বাজারে আর একটা ক্ষেত্র তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় সাহিত্য অকাদেমির পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তার সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, বাংলায় কপি এডিটিং, প্রুফ রিডিং-এর কাজ জানা মানুষ গণ্ডায় গণ্ডায় নেই। বাংলা ভাষা আর বই নির্মাণের আধুনিক কলাকৌশল জানলে বাংলার ছাত্রদের কাজের সুযোগ আছে। সাহিত্য অকাদেমি এ সব কাজে ভাল পারিশ্রমিক দেন। তা ছাড়া অনুবাদের কাজে যোগ দিতে পারেন পড়ুয়ারা। আসলে, বাংলা ভাষা ভাল করে জানা চাই, নোট মুখস্থ না করে চিন্তা করতে শিখতে হবে। শুধু এক ভাষায় আটকে থাকলে চলবে না, অন্য ভাষার প্রতি মন দিতে হবে। তা হলে বাংলা পড়ে কোনও অর্থেই আর প্রলেতারিয়েত হয়ে থাকতে হবে না। |
|
ইতিহাস
রুদ্রাংশু মুখোপাধ্যায়,
ভূতপূর্ব শিক্ষক, ইতিহাস বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়;
সম্পাদক, সম্পাদকীয় পৃষ্ঠা, দ্য টেলিগ্রাফ
|
একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, উচ্চ মাধ্যমিকের পর কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বা অন্য কোনও হিউম্যানিটিজ বিষয়ে নিয়ে পড়লে গবেষণা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই। এই ধারণা ভ্রান্ত। আমি ইতিহাস নিয়ে পড়েছি এবং পড়িয়েছি। তাই ইতিহাস নিয়েই কথা বলতে পারি। কিন্তু এই বিষয়ে আমার বক্তব্য হিউম্যানিটিজ-এর অন্য বিষয়গুলির ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। ইতিহাস নিয়ে পড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও বিভিন্ন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে গবেষণা করা যায়। কিছু কিছু ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করার সুযোগও আছে। তবে সেটা সম্পূর্ণ ভাবেই ইনস্টিটিউটগুলোর সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। অনেকে এম ফিল করার দিকে ঝোঁকে। কিন্তু ভবিষ্যতে যারা গবেষণা বা শিক্ষকতা করতে চায় না, তাদের এম ফিল করার কোনও যুক্তি নেই। শিক্ষকতা বা গবেষণার ক্ষেত্রে এখন নেট ও সেট বাধ্যতামূলক। তাই এম ফিল করা না থাকলেও ছাত্র-ছাত্রীদের অসুবিধা হয় না। গবেষণা ছাড়াও ইতিহাসের পড়ুয়াদের জন্য কেরিয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ খোলা থাকে আই এ এস বা আই এফ এস-এর মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া। এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাঁরা ভারতবর্ষকে শাসন করেন, বা বিদেশে যাঁরা দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন, সেই আমলাবর্গের অঙ্গ হওয়া যায়। বেতন ও প্রতিষ্ঠা এই দুটি বিষয়কে যদি বিচার করা হয়, তা হলে দেখা যাবে এই চাকরি মোটেই অবহেলা করার মতো নয়। এই বিষয় নিয়ে পড়ে অপর যে ক্ষেত্রটিতে নিজের কেরিয়ার তৈরি করা যায়, তা হল সাংবাদিকতা। খবরের কাগজ এবং টেলিভিশন এই দুই মাধ্যমই এখন এমন লোক চায়, যাঁদের বৃহত্তর জগৎ সম্বন্ধে জ্ঞান আর আগ্রহ আছে এবং সেই জ্ঞান ও আগ্রহকে সহজ ভাষায় প্রকাশ করার ক্ষমতা আছে। আমি মনে করি ইতিহাস নিয়ে পড়লে সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করা সহজ। এ ছাড়াও অনেক সংস্থা আছে, যারা একই সঙ্গে বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন এবং ভাষার ওপর দখল থাকা ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়োগ করতে চায়। হিউম্যানিটিজ-এর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে এই দরজাগুলিও এখন খুলে গেছে। তাই মন দিয়ে ও মন খোলা রেখে বিষয়গুলি পড়লে ইতিহাসের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে চাকরির জগৎটা যত ছোট বলে মনে হয়, আদতে তা কিন্তু নয়।
|
ভূগোল
কল্যাণ রুদ্র, প্রাক্তন শিক্ষক, হাবড়া চৈতন্য মহাবিদ্যালয়
|
ভূগোল বিষয়টা হল প্রকৃতি এবং মানব সভ্যতার আন্তঃসম্পর্কের বিশ্লেষণ। বিষয়টা সমাজের সহযাত্রী বলেই গতিশীল, যত দিন যায় তত নতুন নতুন ভাবনাকে আত্মস্থ করে চলে। ভূগোলের তো নানা শাখা ভূমিরূপবিদ্যা, নদীবিজ্ঞান, জলবায়ুবিদ্যা, মৃত্তিকাবিজ্ঞান, মানবিক ভূগোল, অর্থনৈতিক ভূগোল আরও কত কী। ফলে ভূগোলের ছাত্রছাত্রীদের কাছে উচ্চশিক্ষা করার জন্য সুযোগ থাকে অনেক। তারা তাদের পছন্দমতো বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারে। তবে গবেষণা করার ক্ষেত্রে এখন নেট/ সেট পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে। নেট/সেট-এর সুবিধা হল যে কলেজে শিক্ষকতা করার যেমন সুযোগ রয়েছে তেমনই পরীক্ষার স্কোর ভাল থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবেও কাজ করা যায়। সাধারণত রাজ্যের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ভূগোল ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে গবেষণা করা যায়। এ ছাড়াও টাটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল সায়েন্সেস, জে এন ইউ, সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এর মতো দেশে আরও বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে গবেষণা করার ক্ষেত্রে। এই সমস্ত ইনস্টিটউটগুলির কিন্তু নিজস্ব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের গবেষণার সুযোগ দেয়। ফলে কেউ যদি সারা জীবন গবেষণাই করতে চায় তা হলে অবশ্যই করতে পারবে।
দেখো, আমরা যে বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করি না কেন শেষমেষ কিন্তু আমাদের মাথায় একটা প্রশ্নই ঘুরপাক খায়। বিষয়টা পড়ে ভবিষ্যতে কী ধরনের চাকরি পাওয়া যায়? কলেজে শিক্ষকতার কথা তো আগেই বলেছি। তা ছাড়াও রয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে স্কুলে পড়ানোর সুযোগ। যারা সরকারি চাকরি করতে চায় তারা কেন্দ্রীয় সরকারের আই এ এস, স্টাফ সিলেকশন কমিশন কিংবা রাজ্য সরকারের ডব্লিউ বি সি এস, মিসলেনিয়াস সার্ভিস ইত্যাদি পরীক্ষা দিতে পারে। কারণ এই ধরনের কম্পিটিটিভ পরীক্ষার ভূগোল থেকে ছোট-বড়, কোনও না কোনও ধরনের প্রশ্নই থাকেই। এগুলো ছাড়াও নানান ধরনের চাকরির পথ খোলা থাকছে। সেগুলিও এক এক করে বলি। যেমন, প্রথমেই বলব জি আই এস ও রিমোর্ট সেন্সিং-এর কথা। উপগ্রহ থেকে ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলি কম্পিউটারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা হয়। আবহাওয়া পূর্বাভাসের পরিমাপ থেকে শুরু করে কৃষিজ উৎপাদনের পরিমাপ বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই তথ্য ব্যবহৃত হতে পারে। সরকারি সংস্থা থেকে বেসরকারি এজেন্সিতে জিআইএস স্পেশালিস্টরা কাজ পেতে পারেন। আর্বান প্ল্যানিং বা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট-এর সঙ্গে ভূগোলের একটা গভীর যোগ আছে। কোথায় জমি ভাল, কোথায় হাউসিং বা কারখানা গড়ে তোলা যাবে এমন নানা বিষয়ে ভূগোল জানা লোকেদের দরকার পড়ে। ফলে কাজ পাওয়া যায় প্রোমোটিং, হাউসিং কমপ্লেক্স ডেভেলপিং সংক্রান্ত সংস্থায়। রয়েছে ক্লাইমেটোলজিস্ট হিসেবে কাজের সুযোগ। চাকরি পাওয়া যায় সরকারি আবহাওয়া দফতর, নিউজ মিডিয়া কিংবা অন্যান্য সংস্থায়। ভূগোলের ছেলেমেয়েদের কাছে আর একটি আকর্ষণীয় পেশা হল কার্টোগ্রাফি। অর্থাৎ ম্যাপ তৈরি করা। সংবাদ মাধ্যম, বই প্রকাশনা, অ্যাটলাস প্রকাশনা, সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মতো সরকারি সংস্থা মানচিত্র তৈরির কাজে কার্টোগ্রাফিস্টদের চাহিদা রয়েছে। এগুলি ছাড়াও এনভায়রনমেন্ট, আর্কিয়োলজি, ডেমোগ্রাফি কিংবা মার্কেটিং-এও কাজও করতে পারে ভূগোলের ছাত্রছাত্রীরা।
|
দর্শন
শ্রাবন্তী ভৌমিক, শিক্ষক ও বিভাগীয় প্রধান, সুরেন্দ্রনাথ মহিলা কলেজ, কলকাতা
|
‘শূন্য শ্রেণি’, আর ‘শূন্য শ্রেণির শ্রেণি’ এই দুটির যে শ্রেণি, তার থেকে যদি ‘শূন্য শ্রেণি’কে বাদ দেওয়া যায়, তা হলে কী বাকি থাকে? অথবা, ‘বন্ধ্যাপুত্র’ এবং ‘শশশৃঙ্গ’ দু’টি শব্দই তো মনগড়া, অথচ কেন প্রথমটি স্ববিরোধী আর দ্বিতীয়টি নয়? কিংবা ধরো, ফ্রিজে পাঁউরুটি রেখেছি কাল সকালে উঠে খাব বলে। খাব, কারণ সকালে খিদে পায়, পাঁউরুটি খেলে আমার পেট ভরে। কিন্তু পাঁউরুটিতে যে আমার পেট ভরবে, সেটা কী করে জানি? ওই বস্তুটির মধ্যে কি দেখছি এই নিশ্চয়তা? নাকি এই নিশ্চিতির বোধটা কেবল আমার মনের মধ্যেই আছে?
এই রকম সব ভাবনা নিয়ে কারবার চলে দর্শনের ছাত্র-শিক্ষকদের। খুব অমূর্ত (abstract) আর খুব মৌলিক (fundamental)। মৌলিক বলেই দর্শন কিন্তু অনেক রকম বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ক্ষমতা রাখে সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ, বিজ্ঞান, অঙ্ক, পরিবেশ, ধর্ম, নৈতিকতা, গণজ্ঞাপন ইত্যাদি। অঙ্ক যেমন একটি মৌলিক বিষয়, ঠিক তেমনই। এমনি এমনি যিনি অঙ্কের সংখ্যা নিয়ে মশগুল থাকবেন, তাঁকে আমরা জীবনবিচ্ছিন্ন ভাবব, কারণ অঙ্ক যে ‘আকার’ (form) শেখায়, তার সঙ্গে ‘বিষয়’-এর (meterial object) যোগসূত্র দরকার। ঠিক তেমনই দর্শনে আমরা শিখি অনেক-অনেক মৌলিক প্রত্যয় (fundamental concepts), যা ব্যবহার করতে হয় জীবনের কোনও একটি মূর্ত (concrete) বিষয়ে। তাতেই দর্শন তার অমূর্ত রূপ ছেড়ে বেরিয়ে আসে, সংযুক্ত হয় জীবনের সঙ্গে। সহজ করে বললে, দর্শন আমাদের চার পাশের পৃথিবীটাকে দেখতে শেখায়, বুঝতে শেখায়, ব্যাখ্যা করতে শেখায়। দর্শন আমাদের দৃষ্টি স্বচ্ছ করে। |
|
এত কথা বলতে হল এইটে বোঝানোর জন্য যে, চিন্তার স্বচ্ছতা, অঙ্ক বোঝার কিছু ক্ষমতা আর ভাষার ওপর ভাল দখল যার আছে, সে-ই দর্শনের ভাল ছাত্র হতে পারে। আর ভাল ছাত্রের পক্ষে এখনও গবেষণার অনেক সুযোগ আমাদের দেশে এবং বিদেশে। ভাষার দর্শন, সমাজের দর্শন, মনের দর্শন, সংযোগের দর্শন, এমনকী ইতিহাস, সংস্কৃতি বা বিজ্ঞানের দর্শন নিয়ে কাজ করার জন্য আমাদের দেশে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে জওহরলাল নেহরু, যাদবপুর, কলকাতা, বিশ্বভারতী ইত্যাদি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সব ক’টি আই আই টি এবং সমাজবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় দর্শনের ছাত্র-শিক্ষকরা কাজ করতে পারেন। কিছু দিন হল, অঙ্কের সূত্র আর কম্পিউটার বিজ্ঞানের খুঁটিনাটির সঙ্গে মনোবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান আর দর্শনের নানা প্রত্যয়ের সংযোগ ঘটিয়ে তৈরি হয়েছে কগ্নিটিভ সায়েন্স-এর মতো আধুনিক জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র। পণ্ডিতেরা বলছেন, এর সম্ভাবনা অসীম। সব ক’টি আই আই টি এবং এলাহাবাদ আর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কগ্নিটিভ সায়েন্স নিয়ে নিয়মিত চর্চা হচ্ছে। বোঝার চেষ্টা হচ্ছে মানুষের চিন্তাপদ্ধতির খুঁটিনাটি।
আক্ষেপের বিষয়, বহু দিন ধরেই দর্শন পাঠকে মনে করা হয়েছে ধর্মতত্ত্বের চর্চা। আর আজকাল মেধাবী ছাত্র দর্শন পড়বে এই ব্যাপারটি তো উপহাসের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। উপহাসকারীরা হয়তো মনে করেন, প্রাচীন ভারতীয় দর্শনে কেবল ধর্মতত্ত্বই আলোচিত হয়েছে। কিন্তু আসলে প্রাচীন ভারতীয় দর্শন যে সমাজবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদির এক অফুরন্ত আকর, সেটা তো মনে রাখতে হবে। এ সব নিয়েই কত কাজ হচ্ছে এ দেশে, এমনকী বিদেশেও।
অবশ্য দর্শন নিয়ে নিন্দা-মন্দের আর একটা বড় কারণ: উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সবচেয়ে কম নম্বর পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীরাই উচ্চশিক্ষার জন্য বিষয়টিকে বেছে নেয়। তাই তুলনামূলক ভাবে দুর্বল ছাত্র-ছাত্রী দুর্বল ছাত্রছাত্রীরাই বিষয়টি পড়তে আসে। বিষয়টিকে হয়তো তারা ঠিকমতো আয়ত্তই করে না, জোর দেয় পরীক্ষা পাশের ওপর। তবে এ ভাবে উত্তীর্ণ ছাত্ররাও ভবিষ্যতে সেই সব বৃত্তিই নিতে পারে, যা অন্যান্য বিষয়ের অনার্স গ্র্যাজুয়েটরাও নিয়ে থাকে। স্কুল শিক্ষায় এখনও দর্শনের স্নাতকদের ভাল চাহিদা। আর দর্শন স্নাতকদের মধ্যে উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা অনায়াসেই আই এ এস বা ডব্লিউ বি সি এস পরীক্ষায় বসতে পারে, এম বি এ করতে পারে, যোগ দিতে পারে গণমাধ্যমের কাজে। এই সব কাজে অন্যান্য বিষয়ের স্নাতকদের থেকে দর্শনের স্নাতকদের সুবিধে বরং বেশি। কেননা, এই কঠিন বিষয়টি নিয়ে তিন বছর বুদ্ধিচর্চা করার ফলে ভাবার, লেখার, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দেওয়ার ক্ষমতা একটু বেশি বাড়ারই কথা। স্নাতক পর্যায়ে দর্শন বিষয়টির পাঠক্রমে যুক্তিবিজ্ঞান (logic) শিক্ষা বাধ্যতামূলক হওয়ার ফলে পরবর্তী কালে কম্পিটিটিভ পরীক্ষার লজিক্যাল অ্যাপ্টিটিউড টেস্টে তাদের কিছু সুবিধে তো নিশ্চয়ই হবে। আর ভাবার ক্ষমতা, যুক্তিবিস্তারের ক্ষমতা যার বেশি, জীবনের সাধারণ গতিপথও তার মসৃণ হয়, এইটেই মনে করি। |
|
|
|
|
|