|
|
|
|
নিখোঁজ স্রোত/ ২ |
একশো দিনের কাজে জলঙ্গি সংস্কারে উদ্যোগ |
গৌরব বিশ্বাস • করিমপুর |
গ্রীষ্মের শুরুতে কয়েকবার বৃষ্টি হলেও তারপর গরমকাল ফিরে এসেছে চেনা চেহারাতেই।
ছোট নদী, খাল, বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। সেই পরিস্থিতির কথাই এই প্রতিবেদনে। |
যে নদীর জলের উপরে এক সময়ে কৃষিকাজ নির্ভর করত বিস্তীর্ণ এলাকার, এখন সেই নদীরই বুকের উপরে শুরু হয়েছে চাষ। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ওই নদী নিজেই এখন জলের অভাবে ধুঁকছে।
অথচ কয়েক বছর আগেও জলঙ্গির চেহারা ছিল অন্যরকম। তখন যোগাযোগ ব্যবস্থারও অন্যতম মাধ্যম ছিল এই নদীই। পাশের এলাকা থেকে পাট, মাটির তৈরি জিনিসপত্র বোঝাই হয়ে যেমন করিমপুর বাজারে আসত, তেমনই অন্য জিনিসপত্র বোঝাই হয়ে যেত নদী পথ ধরে কলকাতা। এক নদী থেকে অন্য নদী হয়ে তখন কলকাতার সঙ্গে সত্যিই যে যোগাযোগ রাখা যেত, তা এখন অস্বাভাবিক মনে হয়। এখন সামনেই আষাঢ় মাস, মাঝ নদীতে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করছেন মানুষ। কোথাও পাট চাষ হচ্ছে। কোথাও হাঁটু জলে ঘুরছে হাঁস। বিক্ষিপ্ত ভাবে জলঙ্গির কিছু কিছু জায়গায় জল থাকলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। |
|
ছবি: কল্লোল প্রামাণিক। |
মাথাভাঙার মতো জলঙ্গিও পদ্মার শাখানদী। ১৯৫০-৬০ সাল নাগাদ পদ্মার শাখা জলঙ্গির উৎস ছিল মুর্শিদাবাদের জলঙ্গিতে। তারপরে পদ্মা বারবার গতিপথ পাল্টানোয় সেই উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এখন ভৈরব থেকে সামান্য জল জলঙ্গিতে আসলেও পদ্মার সঙ্গে তার আর কোনও সম্পর্ক নেই। করিমপুরের বাসিন্দা মিলন সাহা বলেন, “বছর কুড়ি আগেও করিমপুর এলাকায় জলঙ্গিতে বিজয়া দশমীর দিনে শতাধিক নৌকা ঘুরে বেড়াত। দু’পাড়ের লোকজন সেই নৌকাবিহার দেখতেন। এখন সে সব শুধুই স্মৃতি।” করিমপুর ১ পঞ্চায়েতের উপপ্রধান কংগ্রেসের তারক সরখেল বলেন, “জলঙ্গির উৎসমুখ বন্ধ হয়ে গেলেও বছর কয়েক আগে পর্যন্ত নদী এমন জলশূন্য ছিল না। নদীতে বাঁধ দিয়ে স্রোতের গতি রুদ্ধ করে করে দেওয়া হয়েছে।” কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা সঞ্জিত দত্তের বক্তব্য, “মাটি মাফিয়ারা নদীর পাড় থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এখানে কলকারখানা নেই যে নদী দূষিত হবে। আসলে মানুষকে সচেতন হতে হবে।”
তবে নদী সংস্কারের কাজ শুরু করতে উদ্যোগী হচ্ছেন তাঁরা। তারকবাবু বলেন, “১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে নদী সংস্কারের কাজ করা হবে। তা হলে বর্ষার জল কিছুটা হলেও ধরে রাখা যাবে। সেই জলে মাছ চাষ করা যাবে। কৃষি কাজেও সেই জল কাজে লাগবে।” তবে তার জন্য দরকার জলঙ্গি নদীর চারপাশের সব গ্রাম পঞ্চায়েতেরই উদ্যোগী হওয়া।” হাঁসপুকুরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তৃণমূলের দেবাশিস বিশ্বাস বলেন, “নদীতে আগের মতো জল না থাকায় রিভার পাম্পগুলি অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। এখন নদীর সংস্কার হলে তা খুবই ভাল উদ্যোগ হবে।” তারকবাবু বলেন, “ওই বিষয়ে আমরা মহকুমাশাসকের সঙ্গে কথা বলব।” তেহট্টের মহকুমাশাসক অচিন্ত্যকুমার মণ্ডল বলেন, “বিষয়টি নিয়ে শীঘ্রই সেচ দফতর, পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি নিয়ে বৈঠক ডাকা হবে।” নদিয়া জেলা সেচ দফতরের নির্বাহী বাস্তুকার যিশু দত্ত বলেন, “জলঙ্গির উৎসমুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে নদীতে জল কমে গিয়েছে। তবে নদীগুলো থেকে যে সব খাল বেরিয়েছে, সেগুলো সংস্কার করা যেতে পারে।” তিনি বলেন, “এই বিষয়ে জেলা পরিষদ ও পঞ্চায়েত সমিতিগুলোর সঙ্গে কথা বলব।”
তেহট্টের এক চিকিৎসক প্রলয় ভট্টাচার্য বলেন, “আমরা ‘জলঙ্গি নদী বাঁচাও’ বলে একটি কমিটি তৈরি করেছি। সরকারকে সব কথা জানান হবে। এলাকার বাসিন্দাদেরও সচেতন করা দরকার।”
|
গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে দুই ব্যতিক্রমী শাখানদী হল মাথাভাঙা এবং জলঙ্গি। সমস্ত শাখা নদী যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব বাহিনী, সেখানে এই দুই নদী উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গিয়েছে। ১৯১৫ সালে এক ব্রিটিশ বাস্তুকার মেজর হার্স্ট বলেছিলেন যে, নদিয়াতে কোনএক সময় ভূমির অবনমন হয়েছিল, সেই কারণেই জলঙ্গি এবং মাথাভাঙা এমন ব্যতিক্রমী ভাবে বইছে। তবে নদীতে জল কমে গেল বলে নদীর গুরুত্ব কমে গেল, তা কিন্তু ভাবা উচিত নয়।
কল্যাণ রুদ্র
নদী বিশেষজ্ঞ |
|
|
|
|
|
|
|