|
|
|
|
সম্পাদকীয় ১... |
উন্নয়নের পথ |
একটি অর্থনীতিতে উৎপাদন-শিল্পের (ম্যানুফ্যাকচারিং) গুরুত্ব কতখানি, তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ চিন। দেশটির অর্থনীতি মুখ্যত শিল্প-নির্ভর, এবং সেই শিল্পের এমনই মহিমা যে এখন কৌতুক করিয়া বলা হইয়া থাকে, ‘ঈশ্বর পৃথিবী সৃষ্টি করিয়াছিলেন, তাহার পর সমস্তই চিনে নির্মিত হইয়াছে!’ চিনের সহিত যে দেশটির নাম অধুনা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রায় একই নিশ্বাসে উচ্চারিত হয়, তাহার নাম ভারত। ভারতের আর্থিক বৃদ্ধিও চমকপ্রদ, কিন্তু তাহার গতিপথটি ভিন্ন। এই দেশে বৃদ্ধির হারের পিছনে বৃহত্তম চালিকাশক্তিটির নাম পরিষেবা ক্ষেত্র। জাতীয় আয়ে শিল্পের অবদান মাত্র ১৫ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে বৃদ্ধির হার আট শতাংশের ঊর্ধ্বে রাখিতে হইলে যে উৎপাদন-শিল্পের গুরুত্ব বৃদ্ধি করা প্রয়োজন, তাহা বুঝিতে অর্থশাস্ত্রী হইতে হয় না। প্রধানমন্ত্রী সেই গুরুত্ব বৃদ্ধিতে আগ্রহী হইয়াছেন। তিনি ভারতের নূতন শিল্প নীতি ঘোষণা করিয়াছেন। নীতি বহুমুখী শিল্পের জন্য ন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট জোন গঠন, এই অঞ্চলে নমনীয় শ্রমিক নীতি গ্রহণ ইত্যাদি। প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করিয়াছেন, আগামী দেড় দশকে ভারতের জাতীয় আয়ে উৎপাদন-শিল্পের অবদান ১৫ শতাংশ হইতে বাড়িয়া ২৫ শতাংশে পৌঁছাইবে। নীতি ঘোষণা এবং তাহার বাস্তবায়নের মধ্যে যে বিস্তর ফারাক, দেশবাসী তাহা অভিজ্ঞতায় জানেন। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকার শিল্পকে পৃথক গুরুত্ব দিতেছে, এই বার্তাটিও বাজারের নিকট গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত এখন, যখন শিল্প-উৎপাদনের সূচকের মান ফের নিম্নমুখী হইয়াছে।
উৎপাদন-শিল্পের উন্নতির জন্য যাহা সর্বপ্রথম প্রয়োজন, তাহার নাম পরিবেশ। বিনিয়োগের পরিবেশ। ভারতে এই বস্তুটির সবিশেষ অভাব। বিশেষত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য। এই দেশে খাতায় কলমে লাইসেন্স রাজের অবসান হইয়াছে, আসলে হয় নাই। ফলে, কোনও একটি শিল্প গড়িতে হইলে বিনিয়োগকারীকে সত্তরটির কাছাকাছি আইনের দাবি মিটাইতে হয়। তাহার অধিকাংশই উদ্ভট। কোনওটিতে ‘আর্দ্রতার নথি’ বজায় রাখিতে হয়, কোনওটির ক্ষেত্রে চুনের ব্যবহারের হিসাব দিতে হয়। শুধু হিসাব রাখিলেই চলে না, সেই হিসাব নিয়মিত সরকারের নিকট জমা করিতে হয়। ফলে, স্বল্প পুঁজির ব্যবসায়ীদের পক্ষে ইহা এক মহা বিড়ম্বনা। বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের সামর্থ্য আছে, তাঁহারা এই কাজ করিবার জন্য আলাদা লোক রাখিতে পারেন। মার খায় ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলি। স্মরণে রাখা প্রয়োজন, শুধুমাত্র বৃহৎ বিনিয়োগের ভরসায় থাকিলে এই নূতন শিল্পনীতিটির মুখ থুবড়াইয়া পড়িবার সম্ভাবনা প্রবল। ক্ষুদ্র, মাঝারি বিনিয়োগকেও সমান গুরুত্ব দিতে হইবে, এবং তাহাদের জন্য অধিক যত্নের ব্যবস্থা করিতে হইবে। পরিষেবা ক্ষেত্রের সহিত তুলনায় শিল্পের পক্ষে একটি যুক্তি এই শিল্পে কর্মসংস্থানের জন্য সচরাচর অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতা প্রয়োজন। অর্থাৎ, কারখানায় মেশিন চালাইবার কাজটি টেলিফোনে গ্রাহকের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার তুলনায় কম দক্ষতা দাবি করে, বা সেই দক্ষতা অর্জন করিয়া লওয়া তুলনায় সহজ। যুক্তিটিতে ভ্রান্তি নাই, কিন্তু ভারতে তাহার সরাসরি প্রয়োগে একটি ফাঁক রহিয়াছে। তাহার নাম যোগ্যতার ফাঁক। উৎপাদন-শিল্পে নিযুক্ত হইবার জন্য যতখানি যোগ্যতার প্রয়োজন, ভারতের তরুণ প্রজন্মের সিংহভাগ এখনও সেই স্তরের বহু নীচে। অর্থাৎ, শুধু শিল্প গড়িলেই কর্মসংস্থানের সমস্যাটি মিটিবে না। শিল্পে শ্রমিকেরও অভাব ঘটিবে। সমস্যাটি জটিল, কিন্তু সমাধান-অযোগ্য নহে। প্রশ্নটির উত্তর খুঁজিতে ভারত চিনের দিকে তাকাইতে পারে। সেই দেশে শিল্পের দ্রুত অগ্রগতির পিছনে শিক্ষার উন্নতির প্রভাব অনস্বীকার্য। প্রথমত, প্রাথমিক শিক্ষা যথার্থই সর্বজনীন হইয়াছে। তাহার পর মাধ্যমিক স্তরে বা পরবর্তী পর্যায়ে কারিগরি শিক্ষায় জোর দেওয়া হইয়াছে। তাহার ফলে চিনে প্রকৃত কর্মক্ষমের সংখ্যা ভারতের তুলনায় ঢের বেশি। ভারতের একটি সুবিধা আছে এই দেশের জনসংখ্যায় তরুণ-তরুণীর অনুপাত চিনের তুলনায় বেশি। ফলে, তাহাদের যথার্থ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করিতে পারিলে উৎপাদন-শিল্পে ভারতের আপেক্ষিক সুবিধা বাড়িবে। |
|
|
|
|
|