|
|
|
|
চিকিৎসক, কর্মীর অভাবে হাসপাতালের পরিষেবা বেহাল |
পীযূষ নন্দী • আরামবাগ |
চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীর অভাবে আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালের অবস্থা বেহাল। তার উপরে ‘ডিটেলমেন্ট পোস্টিং’ বা প্রতিনিধিস্বরূপ প্রেরিত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের তুলে নেওয়ায় হাসপাতালটি কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে।
আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালে খাতায়-কলমে আড়াইশো শয্যা থাকলেও মেঝেয় শতরঞ্চি পেতে কিংবা বারান্দায় বাতিল খাটে থাকা রোগীর হিসেব ধরলে প্রায় সাড়ে ৩শো রোগী ভর্তি থাকেন। হাসাপাতল সূত্রের খবর, এখানে চিকিৎসকের পদ আছে ৩৬টি। কিন্তু আছেন মাত্র ২৫ জন। স্বাস্থ্যকর্মী থাকার কথা ৮০ জন। বাস্তবে সংখ্যাটা হল মাত্র ৪২ জন। সুইপার ২৭ জনের জায়গায় আছেন ২০ জন। এঁদের অধিকাংশের আবার বেতনের দিন ছাড়া সারা মাস দেখে মেলে না। তাঁরা ঠিকায় লোক রোখে কাজ করান বলে অভিযোগ। ওয়ার্ড মাস্টারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদেও ৪ জনের বদলে এক জন মাত্র আছেন। ল্যাবরেটরি টেকনিসিয়ানের ক্ষেত্রে ৫ জনের জায়গায় কাজ সামাল দেন মাত্র ২ জন। ইসিজি টেকনিসিয়ান ২ জনের কাজ করতে হয় এক জনকে। এই পরিস্থিতির তালিকাটি সুদীর্ঘ।
এ দিকে, গত ৩ জুন রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের কাছ থেকে নির্দেশ গিয়েছে হুগলি জেলা স্বাস্থ্য দফতরের কাছে। সেখানে বলা হয়েছে, ডিটেলমেন্ট পোস্টিংয়ে থাকা দুই চিকিৎসক-সহ দু’জন ল্যাবরেটরি টেকনিসিয়ান, এক জন এক্স-রে টেকনিসিয়ান, এক জন ইসিজি টেকনিসিয়ান এবং এক জন অপথ্যালমিক অ্যাসিস্ট্যান্টকে ছেড়ে দিতে হবে। শল্য চিকিৎসক শান্তিনাথ চোঙদার বাদে সকলকে ইতিমধ্যে ছেড়েও দেওয়া হয়েছে। পরিকাঠামো একেবারে বেহাল হয়ে পড়ার আশঙ্কায় এক জন শল্য চিকিৎসককে অন্তত যাতে রেখে দেওয়া যায়, সে জন্য রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরকে বিষয়টি পুনর্বিবেচনার কথা জানানো হয়েছে। হাসপাতাল সুপার নারায়ণ চট্টোপাধ্যায় জানান, আমরা এখন অথৈ জলে। চিকিৎসক নেই, কর্মী নেই। কিন্তু মানুষ তো এ সব বুঝছে না। তাঁদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সামলানো দায় হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তার অভাব এবং অমানুষিক চাপে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা ভুগছেন।”
ডিটেলমেন্ট পোস্টিং তুলে নেওয়ায় ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে সংকট গভীর আকার নিয়েছে। দু’জন মাত্র ল্যাবরেটরি টেকনিসিয়ানের পক্ষে কাজ সামলানো দায় হয়ে উঠেছে। পরীক্ষার ক্ষেত্রে বেশ কিছু দিন পরে রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে। না হলে দায়সারা ভাবে কাজ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ। একই পরীক্ষা বাইরে থেকে করিয়ে ভিন্ন ফল মেলায় ক্ষোভ ছড়াচ্ছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, প্রতি দিন গড়ে সব রকম রোগী মিলিয়ে ৫৫-৬০টি পরীক্ষা করানো হয়। কর্মীর অভাবে এক্স-রে বিভাগেও সমস্যা হচ্ছে। ব্যাপক অসুবিধা হচ্ছে ইসিজি-র ক্ষেত্রেও। এক জন মাত্র টেকনিসিয়ান থাকায় তিনি ছুটিতে গেলেই সমস্যা আরও তীব্র হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাইরে থেকে অনেক টাকা খরচ করে এই পরীক্ষা করাতে হচ্ছে। অসুবিধা হচ্ছে চক্ষু বহির্বিভাগেও।
সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এখন চান মুখ্যমন্ত্রী নিজে এসে ঘুরে দেখুন হাসপাতাল। যেখানে একেই কর্মী কম, সেখানে হঠাৎ কেন ডিটেলমেন্ট পোস্টিং তুলে নেওয়া হল, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কর্মীরা। শুধু চিকিৎসাই নয়, পরিকাঠামোগত সমস্যা দেখা দিয়েছে এই পরিস্থিতিতে। হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলি অধিকাংশ সময়ে অপরিষ্কার ভাবে পড়ে থাকছে। হাসপাতালে বিদ্যুৎ কিংবা পানীয় জল সংক্রান্ত সমস্যা দেখা দিলে কী ভাবে তার মোকাবিলা করা হবে, জানেন না কেউ। গ্রুপ-ডি কর্মীদের অভাবে রোগীর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রায়ই মনোমালিন্য হচ্ছে। হাসাপাতালের মূল অংশ বাদ দিয়ে বাদ বাকি জায়গায় সাফাই প্রায় বন্ধ।
রোগীদের খাবার-দাবার নিয়েও অশান্তি রোজকার চিত্র। খাবারের মান খুবই খারাপ বলে রোগী ও তাঁদের পরিবারের অভিযোগ। গত ৩১ মে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে চূড়ান্ত সতর্ক করে চিঠি ধরিয়েছেন সুপার। তিনি বলেন, “রোগীদের নির্দিষ্ট পরিমাণ এবং গুণমানের খাবার দেওয়া নিয়ে ঠিকাদারকে চূড়ান্ত নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” আয়া এবং নার্সদের ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। ইদানীং সে সব অভিযোগ কমার কোনও লক্ষ্মণ নেই। দালাল এবং অবাঞ্ছিত বহিরাগতের ভিড়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলি সরগরম।
আরামবাগ মহকুমা হাসপাতাল চত্বরে অসামাজিক কাজকর্মের অভিযোগও বহু দিনের। চোলাই মদ বিক্রি, মাদক খাইয়ে ছিনতাইয়ের ঘটনা আগে ঘটেছে। জুয়ার আড্ডা বসার নজিরও অভিনব নয়। শ্লীলতাহানীর ঘটনা ঘটেছে। ইদানীং হাসপাতালে পুলিশি ব্যবস্থা থাকলেও তাঁরা হাসপাতালের ভবনগুলিতে নজরদারি করা ছাড়া গোটা চত্বরে সার্বিক ভাবে নজরদারি করেন না। হাসপাতালের নানা অসুবিধা নিয়ে রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠক হয়। এ ব্যাপারে রোগী কল্যাণসমিতির সভাপতি তথা আরামবাগের মহকুমাশাসক অরিন্দম নিয়োগী বলেন, “চিকিৎসক এবং কর্মীর ঘাটতির বিষয়টি আমরা জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়েছি। দালাল-সহ অবাঞ্ছিতদের ভিড় আটকাতে কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে।” সুপারের কথায়, “হাসপাতাল চত্বর নিয়মিত পরিষ্কার করার জন্য চুক্তিভিত্তিক সুইপারদের কাজে লাগানো হচ্ছে। চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীর অভাবে রোগীদের পরিষেবার দিকটি নিয়ে আমরা গভীর দুশ্চিন্তায় আছি। যাবতীয় পরিকাঠামো থাকা সত্ত্বেও সঠিক পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না। সিএমওএইচ উন্মেষ বসু বলেন, “সমস্ত বিষয়টি নিয়ে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া চলছে।” |
|
|
|
|
|