বেশ কিছুদিন আগের কথা। আমার ভাইপোর জন্মদিন। ওকে আমি বলেছিলাম, কী নিবি বলতো? ও যা চেয়েছিল তাতে কিছুক্ষণের জন্য হকচকিয়ে গিয়েছিলাম। ও বলেছিল, “কাকা, আমাকে একটা মাঠ দাও। যেখানে বন্ধুদের নিয়ে ছুটে বেড়াতে পারব।” বলাই বাহুল্য, ওর আবদার তখন রাখতে পারিনি। ছোটরা কোনও পার্কের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিংবা বিকেলবেলা কখনও ছোট্ট কাউকে কোনও ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ কিংবা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা হয়ে যায়। মনে পড়ে ভাইপোর আবদারের কথা। বিষাদে অবসন্ন হয়ে পড়ে মন। সে জন্য শিলিগুড়ির পাশে দাগাপুরে একটা আস্ত মাঠ পেয়ে তা হাতছাড়া করিনি। নানা বাণিজ্যিক প্রস্তাব এলেও এখনও তা ধরে রাখতে পেরেছি। ছোট্ট সেই ‘বসুন্ধরা’ নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। সেখানে ‘আমার শিলিগুড়ি’র সব ছোটদের ছোটাছুটির নিঃশর্ত আমন্ত্রণ রইল। ‘বসুন্ধরা’র কথা থাকুক। শিলিগুড়ি নিয়ে আমার আশা-আকাঙ্খা-হতাশা জানানোর কথা বলা যাক। আমার বসতবাড়ি বিধান রোডে। পাড়া বলতে ক্ষুদিরামপল্লি, হিলকার্ট ঘেঁষে এপাড়াতেই অবস্থান শতাব্দী প্রাচীন সাংস্কৃতিক সংস্থা যা পুরনো শিলিগুড়ির জনজীবনের প্রায় সমান্তরাল এক প্রবাহ ‘মিত্র সম্মিলনী’। যার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল এ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানগুলি বরাবর ছুঁয়ে থেকেছে আমাদের বেড়ে ওঠাকে। একই সাথে বাড়ির প্রায় উল্টোদিকে শহরের আর এক প্রাণকেন্দ্র তিলক ময়দান (কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম) ছেলেবেলা থেকে যা ছিল আমাদের কাছে এক উন্মুক্ত ক্রীড়াঙ্গণ। নতুন সাজে স্টেডিয়াম গড়ে ওঠার পর খুবই আনন্দ ও গর্ব অনুভব হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই খেয়াল করলাম মাঠ ও খেলা নিয়ে তিলক ময়দানকে ঘিরে প্রায় সমস্ত পাড়ার ক্লাবগুলোর বা শিলিগুড়ির সাধারণ মানুষের যে উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল। তার স্বতঃস্ফূর্ততায় কোথায় যেন ভাটা পড়তে থাকল। আমরা বহু বহিরাগত বড় বড় খেলোয়াড়দের খেলা দেখার সুযোগ পেলাম। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে স্থানীয় টিমগুলির খেলোয়াড় তৈরির যে ধারাবাহিকতা, কম বয়সী সকলেরই যেখানে কমবেশি ভাগ নেওয়া ছিল প্রায় আবশ্যিক। নগর জীবন থেকে তা একেবারেই উধাও হয়ে গেল। তা হলে সাধারণ শিশুরা আর স্বাভাবিক ছুটোছুটি খেলাধূলোর মধ্যে দিয়ে বড় হয়ে উঠতে পারবে না। কেবলমাত্র পেশাদারি ভাবে যে শিশুকে খেলাধূলোর অঙ্গণে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হবে, মুষ্টিময় তারাই প্রশিক্ষণের অধীনে খেলাধূলো শিখবে? মনে রাখতে হবে, প্রশিক্ষণ আর অনাবিল আনন্দে খেলাধূলো করবার মধ্যে স্বাভাবিকতার অনেক পার্থক্য। ছোটদের ছুটোছুটি করে খেলাধূলো শুধু অধিকার নয়। প্রকৃতির নিয়ম। সুস্থ মন ও শারীরিক সক্ষমতার জন্য এটা আবশ্যিক। খুব কষ্ট হয় যখন দেখি এই প্রজন্মের ছোটরা সকালে ঘুম থেকে উঠেই দ্রুত প্রস্তুতি নিয়ে স্কুলে যায় আর বিকেলে স্কুল ড্রেসের ফাঁস আলগা করতে না করতেই প্রাইভেট কোচিংয়ের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে। ছুটির দিন বলে যেন কিছু নেই! আমাদের তাই ছোটদের সার্বিক বিকাশের বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ওরাই তো শিলিগুড়ির ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে আমাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করালে কোনও জবাব দিতে পারব না আমরা। সকলকেই ভাবতে হবে কী ভাবে আরও বেশি সংখ্যক ফাঁকা মাঠ ওদের ছোটাছুটির জন্য তৈরি করা যায়। শহরের মধ্যে তো বটেই, লাগোয়া এলাকাতেও। একটু বড় ফাঁকা জায়গা পেলেই উপনগরী, বাণিজ্যিক বহুতলের পরিকল্পনা করার মানসিকতা পাল্টাতে হবে। শহর লাগোয়া নদীর ধারের ফাঁকা জায়গাগুলিকে ছোটদের জন্যই নির্দিষ্ট করে সংরক্ষণ করতে হবে। ও সব জায়গায় বহুতলের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করার দাবিতে আওয়াজ তুলতে হবে আমার শিলিগুড়িকে। তা হলেই ছোটরা বড় হয়ে আমাদের দিকে সম্ভ্রমে তাকাবে। না হলে কী হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্যি কথা বলতে সব সময়েই পরিবেশের ব্যাপারটা আমার মাথায় ঘুরপাক খায়। নিজেকে একজন পরিবেশ কর্মী হিসেবে দেখতেই ভালবাসী। আচ্ছা শিলিগুড়ি শহরে আমরা যাঁরা থাকি, তাঁরা রোজ সকালে উঠে ভাবতে পারি না, যে আজ শহরের রাস্তায় থুতু ফেলব না। আজ, পানের পিক, পান মশলা চিবিয়ে তার পিক ফেলে রাস্তাকে নোংরা করব না। শহরের খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে শৌচকার্য করব না। শহরে প্রচুর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী রয়েছে। সবাইকে নিয়ে সরকারি ও বেসরকারিভাবে এগোলে পরিবেশ আরও ফিরবে। শিলিগুড়ি ‘শুধু বাণিজ্যিক শহর’ এই ধারনাও আরও বেশি করে ভুল প্রমাণিত হবে। আরে আমরা যদি প্লাস্টিক ক্যারিব্যাগ ত্যাগ করতে পারি তা হলে এটা পারব না কেন? নিশ্চয়ই পারব। এক এক করে এগোতে হবে। তিল তিল করেই তাল হয়। আমার শিলিগুড়ির জন্য আমরা এ কাজগুলো অনায়াসে শুরু করে দিতে পারি। আজ থেকেই তার চেষ্টা হোক না কেন। সভা-সমিতিও কম হয়নি। এবার কাজের কাজ হোক। শহরের বিধি-আইন দেখার কথা যাঁদের, তাঁরাও পরিবেশ ঠিক রাখতে নিয়মিত প্রচার করুন। বড় বড় বিজ্ঞাপন দিয়ে শহরের রাস্তায় থুতু, পানের পিক, সিগারেটের টুকরো ফেলা বন্ধ করার অনুরোধ জানানো হোক। শহরে আরও সুলভ শৌচালয় তৈরি হোক। নিকাশির খোলনলচে পাল্টাতে হবে। নিকাশির নোংরা জল কিছুটা পরিস্রুত করে নদীতে ফেলার ব্যবস্থা হোক। উন্নত করা হোক ‘ট্রাফিক কনট্রোল সিসটেম’। তা হলে এত হর্ন বাজবে না। বন্ধ হোক রাস্তা আটকে মিছিল। মনে রাখতে হবে মিছিলের কারণে যানবাহন আটকে থাকলে শহরের বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। আরেকটি বিষয়ে এখনই প্রশাসনকে উদ্যোগী হতে হবে। তা হল, বৈদ্যুতিক সংযোগের যাবতীয় ব্যবস্থা মাটির নীচে দিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তার বিদ্যুৎ স্তম্ভ সরলে তা চওড়া হবে। ফুটপাতও বাড়বে। শিলিগুড়িতে হাঁটারও জায়গা দরকার। কারণ, ‘আমার শিলিগুড়ি’র জন্য অনেক পথ আমাদের একসঙ্গে হাঁটতেই হবে। |