বাক্যের আধারে ধরা যায় না যে অভিব্যক্তি, এমনকী কবিতাও যেখানে সম্পূর্ণ পৌঁছয় না, চিত্রশিল্পী সেখানে সফল বলে মনে হয়। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর আঁকা ছবি রাখলে এই অনুভব অনেক সময় মনে হয়। সেই রবীন্দ্র-চিত্রকে বাঙালি ও ভারতীয় সমাজ সহজে গ্রহণ করতে পারেনি। স্বাভাবিক ভাবেই রবীন্দ্রনাথ স্বদেশের এই নিস্পৃহতায় আঘাত পেয়েছেন, কিন্তু দেশের বাইরের শিক্ষারসিকদের আগ্রহ ও প্রশংসা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে। যতদূর জানা যায়, বাংলায় শিল্পী যামিনী রায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে যথার্থ আলোচনা করেছিলেন। পরবর্তী কালে একাধিক শিল্প-সমালোচক রবীন্দ্র-চিত্রের মূল্যায়ন করেছেন; এগুলি নিয়ে নির্বাচিত একটি সংকলন কয়েক মাস আগে সুশোভন অধিকারী করেছেন রবি ঠাকুরের ছবি/ ছবি আঁকিয়ের চোখে গ্রন্থে। এর পর তিনি এমন একটি বিষয়কে বেছে নিলেন যা প্রায় অভাবিতই বলা যায়। আমাদের আলোচ্য বিষয় ওই বইটির হারিয়ে-যাওয়া রবীন্দ্র-চিত্রাবলির কয়েকখানি সম্পর্কে। তাঁর এই অনুসন্ধান সমাপ্ত এ দাবি কখনওই করেননি। হয়তো ভবিষ্যতে অনুরূপ উপাদানে এই বই আরও সমৃদ্ধ হবে। পাঠক ও দর্শকের জিজ্ঞাসার প্রদীপটিকে তিনি যে প্রজ্বলিত করেছেন, এটিই তাঁর কৃতিত্ব।
বইটি দ্বি-ভাষিক, বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষা থাকায় সকল শ্রেণির পাঠকের সুবিধা হবে। ভূমিকাটিও অনুরূপ এবং বহু জ্ঞাতব্য তথ্যে পরিপূর্ণ। একাধারে বই ও অ্যালবাম বইয়ের অংশটি পড়ে অ্যালবামের ছবিগুলির পৃষ্ঠা ওল্টালে দুঃখ ঘনিয়ে আসে। এই হারানিধি জাতির সম্পদ, সব ফেরানোর পথ হয়তো আর নেই। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ছবি অকাতরে দান করেছেন। কিছু হারিয়েছে, কিছু অপসৃত হয়েছে। এ-সব মেনে নিয়ে সেগুলির প্রতিলিপি যতখানি সম্ভব একত্র করা যায়, তার মূল্যও কম নয়। কর্মসূত্রে শ্রী অধিকারী মহাশয় দেশবিদেশের বহু সংগ্রহশালা দেখেছেন, সেই সঙ্গে পড়ে চলেছেন রবীন্দ্র-চিত্রাবলি বিষয়ক আলোচনা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তাঁর হিসেবি মন অলক্ষে প্রস্তুত হচ্ছিল মূল ছবিগুলির প্রকৃত অবস্থান কোথায়, কোন সংগ্রহে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের দেয়ালে, না ব্যক্তিগত সংগ্রহের দুর্ভেদ্য সিন্দুকে। এর বাইরেও কখনও যদি কোনও সাময়িক পত্র ও সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়ে থাকে, তাও সযত্নে রক্ষা করে এই বইটির পৃষ্ঠায় বিন্যাস করেছেন। আর সন্দেহ থাকলে সে কথাও সংক্ষেপে ব্যক্ত করেছেন। ১৩১ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত দু’খানি ছবি দেখামাত্রই মনে হয় রবীন্দ্রনাথের অক্ষম নকল। ৫৯ পৃষ্ঠার হেঁয়ালি চিত্র বিষয়ে সতর্ক মন্তব্য ‘রবীন্দ্রনাথের আঁকা বলে চিহ্নিত’। আমরা যতদূর জানি, ক্ষিতীশ রায় মহাশয় ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর সহায়তায় যতখানি সম্ভব চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছিলেন। নব পর্যায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ‘বাণীকান্ত’ ছদ্মনামে প্রকাশিত একটি রচনা এই প্রচেষ্টার ইতিহাস রক্ষা করছে। হেঁয়ালিটি অত্যন্ত জটিল এবং অঙ্কিত মূর্তি রবীন্দ্রনাথের কি না সন্দেহ।
রবীন্দ্র-চিত্রের নকল-সমস্যাটি সাম্প্রতিক কালের। এই সমস্যায় রবীন্দ্রনাথ-সহ বর্তমান কালের কয়েকজন খ্যাতিমান শিল্পীও আক্রান্ত হয়েছেন দেখতে পাচ্ছি। আলোচ্য গ্রন্থের একটি পৃষ্ঠায় পেয়ে যাচ্ছি, ডার্টিংটন হলের সেই পাঁচটি চিত্রের প্রতিলিপি যেগুলি চেষ্টা করেও দেশে ফেরত আনা গেল না। প্রসঙ্গক্রমে আর একটি ছবির কথা জানাই, যা হারায়নি, সম্ভবত ফিরিয়ে আনারও চেষ্টা হয়নি। রথীন্দ্রনাথ ছবিটি দিল্লির কোনও সরকারি দফতরে পাঠিয়েছিলেন। হয়তো ফেরত পাওয়া যাবে না, কিন্তু প্রতিলিপি চেষ্টা করলে পাওয়া যেতে পারে।
১৯৩০ সালে প্যারিসের গ্যালারি পিগাশে কতগুলি ছবি প্রদর্শিত হয় তার স্পষ্ট হিসেব পাচ্ছি না, আর ক্যাটালগটি সম্পূর্ণত কোথায়, তাও স্পষ্ট নয়। বাঙালি একটু রক্ষণশীল হলে ভাল হত, আত্মবিস্মৃতি কোনও কোনও ক্ষেত্রে আত্ম-অবমাননা হয়ে দাঁড়ায়।
সুশোভনবাবুর প্রয়াসটি ‘কারিগর’ যে ভাবে শিল্পমণ্ডিত করেছেন, প্রকাশনা জগতে তা অবশ্যই আশাপ্রদ ঘটনা। |