|
|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
একটি বিশেষ সময়কে ফিরে দেখা |
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় |
প্রসঙ্গ সত্যজিৎ, আমানুল হক। সাহিত্য প্রকাশ (ঢাকা), ১৫০০ টাকা |
গ্রন্থ-সমালোচনা কি ‘ইম্প্রেশনিস্টিক’ হয়? তাত্ত্বিকেরা বলবেন সে কথা, আমি অন্তত এইটুকু বলতে পারি যে আমানুল হক-এর প্রসঙ্গ সত্যজিৎ গ্রন্থের এই ছোট্ট আলোচনাটি ‘ইম্প্রেশনিস্টিক’ হবে। এই বইটির কিছু পাতায়, সামান্য ভাবে, আমিও আছি একটি অ-সামান্য মানুষের সহচর হিসাবে। সুতরাং, সম্পূর্ণ ভাবে নিজেকে বিযুক্ত করে সমালোচকের চোখে এই গ্রন্থকে দেখা আমার পক্ষে কঠিন। বইটি বহু দুর্লভ ছবি এবং অজস্র তথ্যে-ভরা। সেই বিন্যাসে কোথাও কোনও চ্যুতি আছে কি না, তা খুঁটিয়ে দেখার জন্য এই আলোচনা নয়। সেই প্রয়াসও করিনি। এই গ্রন্থটি পাঠ (এবং দর্শন) আমার কাছে, আক্ষরিক অর্থেই, ‘রি-ভিউ’। ফিরে দেখা। ফিরে দেখা কিংবদন্তি সত্যজিৎ রায়কে, ফিরে দেখা একটি বিশেষ সময়কে, আর সেই সূত্রে নিজের দিকেও যে দুয়েক বার চোখ পড়ে না, তা নয়। মানিকদাকে নিয়ে বই হয়েছে একাধিক। অনেকেই তুলেছেন তাঁর ছবি। খুবই মূল্যবান ছবি সে সব। অত্যন্ত শিল্প-সমন্বিতও বটে। কিন্তু, আমার মনে হয়েছে, আমানুলের তোলা যে ছবিগুলি এই গ্রন্থে স্থান পেয়েছে, তার সঙ্গে সেই ছবিগুলির একটি বিশেষ তফাত আছে। এই বইটির ছবিগুলি সত্যজিৎ রায়কে ধরতে চেয়েছে শুধুই এক-বচনে নয়, বহু-বচনে। ‘বহু’ অর্থে সত্যজিতের পরিকর যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে। বিভিন্ন স্থান এবং কালের মাত্রায় দেখা দিয়েছে পাত্র। |
|
‘দেবী’ ছবির শুটিং-এ শর্মিলাকে প্রণাম করতে যাচ্ছেন ছবি বিশ্বাস, শর্মিলার মুখে বিব্রত হাসি। |
একটু ভেঙে বলি। ধরা যাক, শুট চলছে, মানিকদা আছেন, সঙ্গে আগে-পিছে আরও অনেকে। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তো আছেনই, তাঁদের অনেকেই চেনেন। আছেন বেশ কিছু কলাকুশলী, যাঁদের অধিকাংশই জনদরবারে তুলনায় স্বল্প-পরিচিত, অনেকে অপরিচিত বললেও আপত্তি উঠবে না। অথচ, মানিকদার সঙ্গে যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা জানেন যে সত্যজিৎ রায় বললে এই কলাকুশলীদের বাদ দিয়ে ভাবা অসম্ভব। আলোকচিত্রে সুব্রত মিত্র, পরে সৌমেন্দু রায়, শিল্প-নির্দেশনায় বংশী চন্দ্রগুপ্ত, সম্পাদনায় দুলাল দত্ত... আরও অনেকেই ছিলেন সেই তালিকায়। তাঁদের সঙ্গে মানিকদাকে দেখা মানে সত্যিই একটি সময়কে ফিরে পাওয়া। সেই প্রাপ্তির জন্য এই বইটির কাছে আমরা ঋণী থাকব।
কত বিচিত্র সব মুহূর্ত! কিশোরী জয়া ভাদুড়ি (অধুনা বচ্চন) বন্ধু শর্মিলা ঠাকুরের ছবিতে গোঁফ এঁকে দিয়েছেন। ‘দেবী’ ছবিতে শর্মিলার সামনে প্রণামরত ছবি বিশ্বাস, আর শুটিংয়ের ফাঁকে শর্মিলার মুখে সামান্য বিব্রত, কিশোরীসুলভ হাসি। ‘মহানগর’-এর সেট-এ মানিকদার হাত থেকে স্যান্ডউইচ-এর টুকরো খাওয়ার জন্য থাবা তুলেছে একটি বিড়ালছানা। ‘সমাপ্তি’-র শুট-এ ‘অমূল্য’র বেশে আমি, ট্রলিতে বসানো ক্যামেরায় চোখ দিয়ে মানিকদা। এমন আরও অজস্র। সঙ্গে মানিকদার একাধিক ‘সিঙ্গল পোর্ট্রেট’ তো আছেই। এ ছাড়া, আমি বলব, যথেষ্ট ঔদার্যের সঙ্গে আমানুল তাঁর এই গ্রন্থে অন্যের তোলা কিছু ছবিও রেখেছেন, ফলে ছবির ভাষায় অনেক মূল্যবান নথি থেকে গিয়েছে। ‘নথি’ শব্দটি এই প্রসঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আমানুল হক-এর তোলা ছবি এবং তাঁরই রচিত প্রসঙ্গ সত্যজিৎ বইটির একটি বড় মূল্য এই যে, তা আসলে একটি নথির মতো থেকে গিয়েছে। ছবি যে কী আশ্চর্য নথি হতে পারে, তার নজির এই বইয়ের বিভিন্ন পৃষ্ঠায়। ‘দেবী’ ছবির ওই দালান যে আসলে ‘সেট’, তার সাক্ষী এই বই। ‘তিন কন্যা’-র মুক্তির দিন কী ভাবে সাজানো হয়েছিল ‘ভারতী’ প্রেক্ষাগৃহ, তার ছবি আছে এই বইতে। ‘রবীন্দ্রনাথ’ তথ্যচিত্রের ‘প্রোডাকশন স্টিল’ দেখা যাবে। এই দ্রুতশ্চল জগতে এই সব হারিয়ে-যাওয়া মুহূর্ত ধরে রাখার একটি দায় ছিল। আমানুল হক তাঁর সাধ্যমতো সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁকে অভিনন্দন জানানো কর্তব্য। |
|
বোড়ালে ‘তিন কন্যা’র ‘সমাপ্তি’ ছবিটির লোকেশন-এ সত্যজিৎ রায় ও
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সত্যজিতের পিছনে সৌমেন্দু রায় ও বংশী চন্দ্রগুপ্ত। |
এই সূত্রে আমি একটি প্রতিতুলনার কথা বলতে চাই। কিংবদন্তি আলোকচিত্রী অঁরি কার্তিয়ে ব্রেসঁ একাধিক বার চিনে গিয়েছিলেন এবং বইতে ধরে রেখেছিলেন তাঁর তোলা অজস্র ছবি, সঙ্গে ভাষ্য। সেই গ্রন্থটির শিল্পমূল্য অতীব মহৎ, পাশাপাশি সেই সব ছবি দুর্লভ নথির মতো থেকে গিয়েছে উত্তরকালের কাছে। ব্রেসঁ-র গ্রন্থের সঙ্গে প্রসঙ্গ সত্যজিৎ-এর তুলনা করা আমার অভিপ্রায় নয়। প্রশ্নটা হল এই যে, আলোকচিত্র ঠিক কী কী কারণে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, অভিনিবেশ দাবি করতে পারে, ব্রেসঁ তাঁর বিভিন্ন বইতে তার দিশা দেখিয়েছিলেন, এবং শুধুই শিল্পমূল্যে যে ছবির বিচার হয় না, তার অন্য মাপকাঠিও থাকে, তা-ও দেখিয়েছিলেন। আমানুল হক-এর বইটি ওল্টাতে গিয়ে আমার সেই কথা মনে পড়ে গেল। আমানুল ছবির সঙ্গে কথাতেও নানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তারও স্মৃতিমূল্য কম নয়। তখন ‘দেবী’র শুট চলছে। সত্যজিৎ ফিল্মোৎসবের জুরির কাজে বিদেশে। মাসিমা, অর্থাৎ সত্যজিতের মা শ্রীমতী সুপ্রভা রায় বাড়িতে ছেলের ইউনিটের লোকজনদের সঙ্গে গল্প করছেন। হঠাৎই গান করতে বলায় তিনি ধরলেন ছেলেরই লেখা শ্যামাসঙ্গীত (‘দেবী’ ছবিতে ব্যবহৃত) ‘এ বার তোরে চিনেছি মা’! এমন নানা অন্তরঙ্গ ছবি আমানুলের লেখায় ধরা আছে। সে সবও এক-একটি ‘স্ন্যাপশট’-এরই মতো। পড়তে গিয়ে, মাঝে মাঝে মনে হয়, ভাষা যেন ঈষৎ আবেগপ্রবণ। পাশাপাশি, এ কথাও স্মরণে রাখা উচিত যে অন্তরে একটি মহৎ আবেগ ক্রিয়াশীল না থাকলে এই জাতীয় গ্রন্থের জন্ম হয় না। সুতরাং, বর্তমানে আশি-অতিক্রান্ত আমানুল হক-এর লেখনী যদি একটু বেশি আবেগদীপ্ত হয়, তাকে মেনে নেওয়া (এবং মনে নেওয়া)-র মধ্যে কোনও দোষ নেই। |
|
|
|
|
|