|
|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি ২... |
|
জবাব দিলেন ঋতুপর্ণ |
গত রবিবার নন্দন। চিদানন্দ দাশগুপ্তের স্মরণসভা। মুখোমুখি ঋতুপর্ণ-বুদ্ধদেব। রীতিমতো অস্বস্তিকর পরিবেশ। উপস্থিত টালিগঞ্জের অনেকেও। দু’জনে অবশ্য একে অপরকে সযত্নে এড়িয়ে গেলেন। অনুষ্ঠান শেষে সৌজন্য বিনিময়ের প্রশ্নই ছিল না এমন শীতল আবহাওয়ায়। কোথাও যেন বাংলা আর্ট-ফিল্ম ঘরানার দু’দিকে মেরুকরণ। যা শুরু হয়েছে শনিবারের পত্রিকায়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাক্ষাৎকারে। যেখানে নাম না করে টালিগঞ্জের এক ‘পরিচালক-অভিনেতা’ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্যে ইন্ডাস্ট্রিতে ঝড়। এ বার পত্রিকার পাতায় বুদ্ধদেবের সেই সাক্ষাৎকারের বিরুদ্ধে কলম ধরলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ |
গত শনিবার পত্রিকায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের একটা সাক্ষাৎকার পড়লাম।
সাক্ষাৎকারটি মনোরম। সংলাপ রচনা বেশ চৌখশ। কল্পনা এবং ঘটনার যে আয়োজন ছড়ানো রয়েছে তাতে ওটিকে সাক্ষাৎকার না বলে অনায়াসে একটি চিত্রনাট্য বলা যায়।
অনেক সময় চিত্রনাট্যকার তাঁর চরিত্রের নামকরণ করেন বটে। কিন্তু চলচ্চিত্রায়িত হওয়ার পর অনেক চরিত্রের নামই আমরা শুনতে পাই না। অতএব তাঁরা অভিনেতা নামেই পরিচিত হন। যেমন “উত্তমকুমার তার পর গাড়ি করে সুচিত্রা সেনের বাড়ি গেলেন।”
এই চিত্রনাট্যটির ক্ষেত্রে অবশ্য দেখলাম যে বুদ্ধদেব কতকগুলি চরিত্রের নাম ধোঁয়াশায় রেখেছেন। সেটা চিত্রনাট্যের একটি বিশেষ আঙ্গিকও হতে পারে।
কিন্তু ভুল করে বুদ্ধদেবের সেই নামহীন, বর্ণনাসমৃদ্ধ চরিত্র দু’টোর কাস্টিংটা এত জোরালো এবং জনপ্রিয় যে, বুদ্ধদেব পরিকল্পিত চিত্রনাট্যটি এ বার অন্তত তাঁর বিভিন্ন ব্যর্থ ছবির পর দর্শকদের মন কেড়েছে।
গত শনিবার থেকে আজ অবধি কত যে অসংখ্য এসএমএস পেয়েছি, বলবার নয়।
তবে, বুদ্ধদেব যে অকপট সত্যবাদকের ভঙ্গিতে সংলাপগুলি সৃষ্টি করেছিলেন, সেখানে চরিত্রগুলির নাম না করলে সত্য সম্পূর্ণ হয় না। বুদ্ধদেব থ্রিলার লেখার হাত মকশো করছিলেন কি না জানি না, তবে চেষ্টাটা দুর্বল নিঃসন্দেহে। কারণ নামহীন মানুষ দু’টো অতি সহজে লোকমানসে অবয়ব পেয়ে গেল, অতএব ‘ খুনি কে?’ তার রহস্যটা পুরোটাই মাঠে মারা।
বুদ্ধদেব বরাবরই পরিমিতিতে বিশ্বাস করেন। তাই চিত্রনাট্যের সাধারণ রীতি অনুযায়ী স্থান-কালের বর্ণনাগুলি এড়িয়ে গেছেন।
এত ক্ষণে যেহেতু যে কোনও শিশুই বুঝে গেছে যে নাম-না-করা পাত্রদের মধ্যে এক জন, যিনি পরিচালক-কাম-অভিনেতা আসলে আমি, ঋ
তুপর্ণ ঘোষ, এবং ‘বিখ্যাত অভিনেতা’টি প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ছাড়া আর কেউ নন। তাই নিজেও এক জন চিত্রনাট্যকার ও সাংবাদিক হিসেবে সেই অসম্পূর্ণ ডিটেলগুলি সরবরাহ করলাম। তাতে তাঁর চিত্রনাট্যটিও কনটেক্সট পাবে এবং এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যটা পাঠকের বুঝতে সুবিধে হবে।
শুরু করছি।
|
|
‘মেমরিজ ইন মার্চ’ মুক্তি পাওয়ার পর ‘দ্য টেলিগ্রাফ’-এ ছবিটির সমালোচনার সঙ্গে বুদ্ধদেবের একটি ভূয়সী প্রশংসাসূচক লেখা বেরিয়েছিল। ফলে ছবির নির্দেশক সঞ্জয় নাগ তাঁর প্রথম ছবির এমন অপ্রত্যাশিত প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে বুদ্ধদেবের সঙ্গে দেখা করে মুগ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাতে চেয়েছিল। আমি যেহেতু বুদ্ধদেবের পূর্বপরিচিত (এখন আক্ষেপ হয়) এবং সঞ্জয়ের তাঁর সঙ্গে পূর্বে কোনও সাক্ষাৎ পরিচয় ছিল না, আমি ওর সঙ্গে বুদ্ধদেবের কাছে যেতে রাজি হয়েছিলাম।
আমাদের সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় তাঁর কাঁকুলিয়ার অফিসে যেতে বলা হল। যখন পৌঁছলাম দু’জনে তখন অফিস খালি, কেবল এক জন পরিচারক রয়েছেন, আর রয়েছেন বুদ্ধদেব ও সোহিনী দাশগুপ্ত।
সঞ্জয়ের প্রধান উৎসাহ ছিল বিদেশের কোন কোন চলচ্চিত্র উৎসবে ‘মেমরিজ ইন মার্চ’ পাঠানো যায় সে প্রসঙ্গে পরামর্শ, এবং সম্ভব হলে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রকার হিসেবে বুদ্ধদেবের কতকগুলি সুপারিশপত্র বা ব্যক্তিগত ফোন-অনুরোধ উৎসব কর্তৃপক্ষকে। তা নিয়ে ‘কথাবার্তা’ হল। বুদ্ধদেব অনেক বরাভয় দিলেন।
সেই ‘কথাবার্তা’গুলো আনন্দবাজারের সাক্ষাৎকারে (থুড়ি চিত্রনাট্যে) দেখলাম জাতীয় পুরস্কার কমিটিতে ওঁর পরিচিতদের আমার শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কারের জন্য ফোন করবার আবদারে পর্যবসিত হয়েছে। বুঝলাম, বুদ্ধদেবের থ্রিলারে ‘ম্যাজিক-রিয়্যালিজম’-এর ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে।
তার পর চা-শিঙাড়া সহযোগে কথায় কথায় শুরু হল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রসঙ্গ। বুদ্ধদেব স্মৃতিচারণ করছিলেন। ক’বছর আগে উনি যখন জাতীয় পুরস্কার কমিটির চেয়ারপার্সন ছিলেন, তখন প্রসেনজিৎ যে কত রকম ভাবে উপর্যুপরি অনুরোধ করেছিল, নিয়মিত সোহিনী দাশগুপ্ত এবং স্বপনকুমার ঘোষের মাধ্যমে, তখন উনি নিতান্তই দয়াপরবশ হয়ে বিশেষ জুরি সার্টিফিকেটটির ব্যবস্থা করেন। |
এ সব কথা বুদ্ধদেব অকপটে তাঁর স্বঘোষিত সত্যবাদিতার ভঙ্গিতে বলে গেলেন। কেবল আমার সামনে নয়, সদ্য পরিচিত সঞ্জয় নাগও সেখানে বসে।
যে প্রসেনজিৎ তাঁর দু’-দু’টো ছবিতে অভিনয় করেছে, যদি ধরেও নেওয়া যায় কোনও স্নেহশীল অভিভাবকস্থানীয় ভেবে সে বুদ্ধদেবের কাছে প্রশ্রয়পূর্ণ একটা আবদার পাঠিয়েছিল, সেটা সবিস্তারে আমাকে, সদ্যপরিচিত সঞ্জয়ের সামনে তারিয়ে তারিয়ে বলা এবং পরে কাগজে ফলাও করে লিখে দেওয়া যায় কি না, সেই ব্যক্তিগত ‘এথিক্স’-এর মধ্যে ঢুকছি না, কারণ তখনও জানি না যে উনি ইতিমধ্যে একটা ক্রাইম থ্রিলারের প্লট ভাবতে বসেছেন। অবলীলায় বললেন, “গৌতম ‘পার’-এর পর পাতে দেওয়ার মতো ছবি করেনি,” বললেন, ‘‘‘মনের মানুষ’-এর জন্য প্রসেনজিৎ যদি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার পায় সেটা হবে চরম দুর্ভাগ্যজনক,” এবং আমাকে বললেন, “এ বার তোমায় যদি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার না দেওয়া হয়, সেটা ঘোর ‘ইনজাস্টিস’ হবে।” আমি হেসে বলেছিলাম, “তা হলে তুমি দেখো না, যাতে ‘জাস্টিস’টাই হয়।” আমার সেই উক্তিটির চিত্রনাট্য-অনুবাদ কাগজে পড়লাম “আমি পাই বা না পাই, বুম্বা যেন না পায়।” চমৎকার সংলাপ রচনা! |
আমি এত দিনে হাড়ে হাড়ে বুঝে গিয়েছি যে এই বাংলায় আমাকে আক্রমণ করাটা সব থেকে নিরাপদ। যে দর্শক-পাঠকেরা বুদ্ধদেবের এই অভিনব সংলাপ রচনা পড়ে আমাকে লোভী এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ ভাবছেন (তাঁদের দোষ নেই, কারণ প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণ এখন যুযুধান, এই ‘মিথ’টা সম্প্রতি বাজারে চলছে) তাঁরা আশা করি, এটুকু অন্তত জানেন যে উপরোক্ত দোষগুলি যদিও বা আমার থাকে, তাঁর সঙ্গে আমার একটা গুণও আছেসেটা আমার বাস্তববুদ্ধি।
সেই বাস্তববুদ্ধিই আমায় বলে দেয় যে আর যে-ই হোন, অন্তত বুদ্ধদেব আমার মঙ্গলাকাঙ্ক্ষী, বিশ্বাসভাজন হতে পারেন না। যে বছর জাতীয় পুরস্কারের চেয়ারপার্সন উনি ছিলেন, সে বছর পুরস্কারের তালিকা থেকে কী ভাবে জোর করে ‘দোসর’কে বাদ রাখা হয়েছিল, কেবল প্রসেনজিতের ‘সান্ত্বনা পুরস্কার’টুকু ছাড়া, আমার অজানা নয়।
অতএব, আজ সেই বুদ্ধদেবের শরণাপন্ন হয়ে এক জন শত্রুরও অমঙ্গল চাইবার মতো আমার বিশ্বাসের জায়গা যেখানে নেই, আর প্রসেনজিৎ তো সেখানে আমার ষোলো বছরের বন্ধু ও সহকর্মী। তার বিরুদ্ধে কোনও প্ররোচনা করতে যদি আমার সাময়িক সাধও যায়, তার জন্য আমি অন্তত বুদ্ধদেবকে বেছে নেব না। প্রথমত তিনি বরাবর কেবল আমার নয়, অজাতীয় পুরস্কার ঘোষণা করার পর সঞ্জয় বুদ্ধদেবকে ফোন করে সৌজন্যমূলক ভাবে জানাতে চেয়েছিল যে ‘মেমরিজ ইন মার্চ’ শ্রেষ্ঠ ইংরেজি ছবির পুরস্কার পেয়েছে। বুদ্ধদেব তখন কেরলে। ফোনে একটাই কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “গৌতমের ছবি কোনও বড় পুরস্কার পায়নি তো?”
|
একটা মিথ্যেকে ঢাকতে গিয়ে হাজারো হাস্যকর মিথ্যে বেরিয়ে আসবেই: বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
আমার সাক্ষাৎকারটির পর অজস্র মানুষের সমর্থন জানানো ফোন ও এসএমএস পেয়েছি। তাঁরা অনেকেই বিশিষ্ট জন। সংখ্যাটা এতই বিশাল যে, আলাদা করে সবার নাম করার জায়গা হবে না। আবারও বলতে চাই, কাউকে হেয় করার কোনও উদ্দেশ্যই আমার ছিল না। যে চিত্রপরিচালক-অভিনেতার কথা সাক্ষাৎকারে বলেছিলাম, তাঁর অভিনয় যখন আমার ভাল লেগেছিল, সেটাও যেমন নির্দ্বিধায় লিখিত ভাবে জানিয়েছিলাম, তেমনই তাঁর যে কাজ অন্যায় ও অনৈতিক মনে হয়েছে সেটাও স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছি। যাঁর কথা বলেছিলাম, সেই চিত্রপরিচালক-অভিনেতা নিজেই তো সব চেয়ে ভাল জানেন, তিনি কী বলেছিলেন। কেন না, পুরস্কার-টুরস্কারের চেয়ে অনেক বড় কাজটা। তাই পুরস্কার পাওয়ার জন্য নোংরামির পর্যায় নেমে গেলে নিজেকেই অপমান করা হয়। এই লেখার পরিপ্রেক্ষিতে বলতে পারি, একটা মিথ্যেকে ঢাকতে গিয়ে আরও হাজারো হাস্যকর মিথ্যে কথা তো বেরিয়ে আসবেই। কিছু লোককে এটা করতেই হয়। এটুকুই বলার যে, এ বছর জাতীয় পুরস্কার ঘোষিত হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমি বিস্তারিত খবর পাই। তখন আমি কেরল চলচ্চিত্র রাজ্য পুরস্কারের জুরি চেয়ারম্যান হিসেবে ব্যস্ত। অতএব, অন্য কারও কাছ থেকে সে সম্বন্ধে জানার আমার কোনও প্রয়োজন ছিল না।
ঠাকুরঘরে গুটি গুটি পায়ে ঢুকে কলা-টলা খেয়ে হাত মুছলেই কি গন্ধ যায়! |
পুরস্কারের জন্য ‘অনুরোধ’ আসে যে পথে ব্যাপারটা শুরু হয় বাছাইয়ের আগে থেকেই। জাতীয় পুরস্কারের সঙ্গে জড়িত কয়েক জনের মতে আঞ্চলিক স্তর থেকেই ‘কথাবার্তা’ শুরু হয়ে যায়। কী ভাবে? ধরা যাক ‘ক’-এর ছবি পুরস্কারের জন্য আবেদন করল। আঞ্চলিক জুরি কমিটিতে ‘খ’ আছেন। ‘ক’ যদি ‘খ’কে চেনেন, তা হলে তাঁকেই সোজাসুজি ফোন করে ‘একটু দেখে’ নেওয়ার আবেদন জানানো হয়। যদি না চেনেন, তা হলে এমন কাউকে ধরার চেষ্টা করেন, যিনি ‘খ’কে যথেষ্ট ভাল চেনেন, এবং যাঁর কথা ‘খ’ রাখবেন। আঞ্চলিক কমিটি দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার পর, প্রধান জুরি বোর্ডের কাছে ছবি পৌঁছলে, এই একই ভাবে ‘অনুরোধ, তদ্বির, তাগাদা’ চলতে থাকে। তবে এ সবই বেসরকারি মত। সরকারি মতে জুরির কোনও সদস্যই কোনও ‘অনুরোধ’-এই নাকি কান দেন না। |
|
|
|
|
|
|