|
|
|
|
শনিবারের নিবন্ধ |
নজরুল-বিভ্রাট |
কথা ও সুরবিকৃতি নজরুলগীতির বড় সমস্যা। জনপ্রিয়তাও তাই বাড়ল না। কেন এমন হল? লিখছেন স্বপন সোম |
রবীন্দ্রসদন শুধু নয়, গোটা বাংলাজুড়েই চলছে নজরুল জন্মোৎসব। অথচ এই শতকের শুরু থেকেই যেন নজরুলের গানের নতুন ক্যাসেট-সিডি বেশ অমিল। সিডি-ভিসিডির বিপণিগুলির একই বক্তব্য, “নজরুলগীতির চাহিদা এখন আর সে রকম নেই।” নজরুলের গানের নতুন সিডি প্রায় বেরোয় না বললেই চলে। কারণ একটাই, সে রকম নাকি বিক্রি নেই।
বহু দিন বাদে আমেরিকা থেকে কলকাতায় এসেছেন রাহুল সেন। তিনি হতাশ হলেন শুধু নয়, তাঁর মনে পড়ল এক সময়ে গ্রামোফোন কোম্পানিও তখন নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে প্রকাশ করত বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া নজরুলগীতির নতুন রেকর্ড ও ক্যাসেট। দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ত সেই সব গান।
রাহুলের মনে তাই প্রশ্ন, কেন এমন হল? কী ভাবে হল? ভাবতে ভাবতে রাহুলের হঠাৎ মনে হল, সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে একটা অনুসন্ধান চালালে কেমন হয়। একটু চেষ্টা করতেই জোগাড় হয়ে গেল দু’-একটি রেকর্ড কোম্পানির কর্তাব্যক্তি আর নজরুলের গানের কয়েক জন সুপরিচিত শিল্পীর ফোন নম্বর। একে একে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগও করলেন রাহুল। প্রথমে ‘সা-রে-গা-মা-পা’র এস এফ করিম। করিম তো স্পষ্টই জানালেন, ‘‘নজরুলের ক্যাসেট-সিডির তেমন কোনও বিক্রি নেই, নতুন সিডি বার করব কী করে? পুরনো নামী শিল্পীদের গাওয়া নজরুলগীতির সংকলন বার করেছিতার বিক্রিও আশানুরূপ নয়। আসলে শ্রোতারা আর নজরুলগীতি শুনতে চাইছেন না।’’
প্রায় একই সুরে প্রাইম মিউজিকের দেবরাজ দত্ত জানালেন, “আমরা নজরুলগীতির সিডি বের করে কেন ক্ষতির সম্মুখীন হব? আফটার অল এটা তো ব্যবসা।’’ সত্যিই তো! ব্যবসা না হলে কে-ই বা ঝুঁকি নেবে। আর একটা সিডি তৈরির পিছনে যত পরিশ্রম ও খরচের বহর আছে তা বাজার থেকে ফেরত না এলে কোম্পানিগুলো এগোবে কেন? |
কিন্তু না। এ সব মানতে নারাজ হৈমন্তী শুক্ল। বরং কোম্পানিগুলোর দিকে ছুড়ে দিলেন বেশ কিছু প্রশ্ন। ‘‘নজরুলগীতির ক্যাসেট-সিডি বিক্রির জন্য কোম্পানি কি সে ভাবে চেষ্টা করেছে? কোনও প্রচার করেছে? লোকে তো জানতেই পারে না কী ক্যাসেট-সিডি বেরোল।’’ বেশ উত্তেজিত তিনি। হৈমন্তীর ধারণা, নজরুলের ভাল ভাল গানগুলি শোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রোতারা। শিল্পীরা একটু সহযোগিতা পেলেই তা আরও জনপ্রিয় হত।
রাখঢাক না করে ইন্দ্রাণী সেন তো বলেই ফেললেন,‘‘আমরা নজরুলের গানের রেকর্ড করতে চাইলেও কোম্পানি করে না।’’ ক্ষোভ বা অভিমানও প্রকট। মানসী মুখোপাধ্যায় মেলাতে পারেন না তাঁর বাবা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সময়কার নজরুলগীতির সেই জনপ্রিয়তার সঙ্গে এখনকার পরিস্থিতির। নজরুলের গান নিয়ে প্রচারের অপ্রতুলতার কথা স্বীকার করলেন মানসীও। গানকে জনপ্রিয় করতে প্রচারেরও বড় ভূমিকা থাকে। কয়েক দশক আগেও যা ফলাও করে ছাপা হোত, এখন তা নেই। কেন?
রেকর্ড প্রকাশ-প্রচারের ব্যাপারে করিম বা দেবরাজের সাফ কথা “রেকর্ডিং-এর একটা খরচ আছে। তার পর সংবাদপত্রে, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বিজ্ঞাপন দেওয়া, সে-ও বিশাল ব্যয়সাপেক্ষ, এত খরচা উঠবে কী করে?’’ যুক্তি, পাল্টা যুক্তি। একটি রেকর্ড কোম্পানির কর্তা তো বলেই ফেললেন, “সাধারণ শ্রোতার কাছে নজরুলগীতির আকর্ষণ অনেকটাই কমে গেছে।” এ কথা কল্যাণী কাজি, রামানুজ দাশগুপ্ত, শ্রীকান্ত আচার্য মেনে নিলেও এই প্রজন্মের বেশ কয়েক জন শিল্পী জোরালো প্রতিবাদ জানালেন। তাঁদের বক্তব্য, “অনুষ্ঠানে শ্রোতারা নজরুলগীতি যথেষ্টই শুনতে চান। অনুরোধ করেন বিভিন্ন গানের জন্য। বহুল বিজ্ঞাপিত এবং নামী শিল্পী সমৃদ্ধ সাম্প্রতিক এক নজরুলগীতির আসরে শ্রোতাদের ভিড়ও উপছে পড়ছিল।” এমন কথা শুনেই পাল্টা যুক্তি দিলেন রামানুজ দাশগুপ্ত, ‘‘কিন্তু সেই অনুষ্ঠান তেমন কোনও ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে পারল কি?” শিল্পীরাই দ্বিধা বিভক্ত।
এক প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর খুবই ইচ্ছা ছিল নজরুলের গান রেকর্ডিং করার। তাঁর অভিজ্ঞতায়, ‘‘রেকর্ড কোম্পানিকে নজরুলের গানের কথা বললেই তাঁরা বলেন রবীন্দ্রনাথের গান করুন, কেন না রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা স্টেডি সেল রয়েছে।’’ কথাটা অবশ্য ফেলে দেওয়ার নয়। কারণ, নানা জনের সঙ্গে নজরুলগীতি নিয়ে কথাবার্তায় বারবার চলে আসছিল রবীন্দ্রনাথের গানের প্রসঙ্গ। তাঁদের মতে, নজরুলের গানের সুরে বৈচিত্র থাকলেও সেই প্রসারতা যেন কম। এই সূত্রেই এসে পড়ে সুর সংরক্ষণের প্রশ্ন। রামানুজ দাশগুপ্ত বলেন, “রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন যোগ্য ব্যক্তিকে দিয়ে তাঁর গানের স্বরলিপি করিয়ে দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু নজরুল সুর সংরক্ষণ নিয়ে মাথা ঘামাননি।” ১৯৪২-এর আগে নজরুল সুস্থ থাকাকালীন অবস্থাতেই অন্যেরা নজরুলের গানে সুরযোজনা করেছেন, তাঁর অসুস্থতার পর তো বটেই।
ফলে সুর নিয়ে একটা বিভ্রান্তি রয়েছে। একই
গান একাধিক সুরে শোনা যাচ্ছে। ইন্দুবালার ‘ভাঙা মন জোড়া নাহি যায়’এখন
অন্য সুরে গাওয়া হয়। এ রকম উদাহরণ
রয়েছে অসংখ্য।
নজরুলের গানের প্রামাণ্য স্বরলিপি কি আছে? এ প্রসঙ্গে কল্যাণী কাজি জানালেন, ‘সুরমুকুর’, ‘সুরলিপি’ এবং ‘নজরুল স্বরলিপি’র কথা। তা ছাড়া বাংলাদেশ থেকে বেরোচ্ছে নজরুল সুস্থ থাকা অবস্থায় প্রকাশিত নজরুলগীতির রেকর্ড নির্ভর প্রামাণ্য স্বরলিপি। কিন্তু এখন শুধু সুর নয়, কথাও বদলে ফেলা হচ্ছে বলে তাঁর ধারণা। যেমন ‘কুমকুমে আবীর ফাগে’ গানটিতে ‘হিমুল’ শব্দটিকে পাল্টে ‘শিমুল’ বলা হচ্ছে। সদ্যপ্রয়াত বিমান মুখোপাধ্যায় নজরুলের গানের শিক্ষণে-প্রচারে সর্বদাই সক্রিয় ছিলেন। তাঁর প্রশিক্ষণে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অনুপ ঘোষাল নজরুলগীতিকে এক সময়ে জনপ্রিয় করেছেন। কিন্তু তাঁদের দু’-একটি গানের সুর সন্দেহের ঊর্ধ্বে নয়। “নজরুলগীতি শুদ্ধরূপে প্রচারের যথেষ্ট প্রয়াস করেছিলেন প্রয়াত সুকুমার মিত্র,” বললেন কল্যাণী কাজি। কথা ও সুরবিকৃতি নজরুলগীতির বড় সমস্যা। তবুও প্রশ্ন থেকে যায়, “এখন বাংলা গানের সার্বিক অবক্ষয়ের যুগে নজরুলের গান বাঁচবে কী করে?” |
|
|
|
|
|