|
|
|
|
|
|
|
|
মুখোমুখি ১... |
|
দার্জিলিংয়ের বৃষ্টি, পাহাড় আর অঞ্জন |
গ্লেনারিজ, কেভেন্টার্স। স্মৃতি আর আবেগের মিশ্রণ। তার মধ্যেই তিনি শৈলশহরে আগামী
ছবি ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না’র সঙ্গে। রেস্তোরাঁয় মুখোমুখি ইন্দ্রনীল রায় |
ফেলে আসা দিনের হাজারো স্মৃতির সাক্ষী তিনি। গ্লেনারিজে বসেছিলেন। গ্লেনারিজ আজও একই রকম তাঁর প্রিয় জায়গা। গরম চিকেন স্টেকের ধোঁয়ার মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল তাঁর মুখ, সেই সব স্মৃতির ভিড়ে। গ্লেনারিজের প্রিয় ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিলেন ফিশ অ্যান্ড চিপ্স আর ভদকা।
পরনে একেবারে নিজস্ব কায়দার নীল জ্যাকেট। আচার-আচরণে এমন একটা রাজকীয় ভাব যেন সব কিছু খুঁটিয়ে মেপে নিচ্ছেন তিনি। তাঁর শরীরী ভাষায় এমন একটা কেতা যে, না বললেও ধরে নেওয়া যায় এই পাহাড়ি শহরের অঘোষিত ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডারও তিনি। শহরটা যে দার্জিলিং। আর মানুষটির নাম যে অঞ্জন দত্ত।
উডি অ্যালেন যেমন নিউ ইয়র্ক ছাড়া কিছু ভাবতে পারেন না, সুইৎজারল্যান্ড যেমন যশ চোপড়ার হৃৎস্পন্দন, ঠিক তেমনই অঞ্জনের কাছে এই দার্জিলিং শহরটা। তাঁর আগামী ছবি ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না’র মিউজিক লঞ্চের জন্য দার্জিলিংয়ে নামার সময় থেকেই তিনিই আমাদের ‘অফিসিয়াল গাইড’।
কোন রেস্তোরাঁয় পাওয়া যায় সেরা স্টেক, কোন হোটেলে খাবার- দাবারের দামে সব চেয়ে সেরা ‘ডিল’ পাওয়া যায়, তাঁর মতো করে কেউ জানে না।
গ্লেনারিজে গুছিয়ে বসার পর একে একে খুলল তাঁর গল্পের ঝাঁপি। এই পাহাড়ি শহর ঘিরে তাঁর ঝাঁপিতে কত না গল্প। সবই তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতিতে মেপে নেওয়া। |
|
গ্লেনারিজে অঞ্জন। |
মানিকবাবুকে গ্লেনারিজে দেখতাম বিয়ার নিয়ে বসে আছেন “এই জায়গাটা তো আসলে একটা ম্যাজিক,” গ্লেনারিজের মাছ ভাজার টুকরো মুখে পুরতে পুরতে বললেন অঞ্জন, “আমি এখানে আট বছর থেকে পড়াশোনা করেছি। প্রত্যেকটা ফুটপাথ, প্রত্যেকটা দোকানপাট, প্রত্যেক জায়গা ঘিরে আমার মনে কত কত স্মৃতি।”
স্মৃতির পর্দা সরিয়ে বলতে থাকেন তিনি, “গ্লেনারিজের এই জায়গাটা, যেখানে আমরা বসে আছি, সেখানে একটা সময় দিনের পর দিন মানিকবাবুকে বসে থাকতে দেখেছি। পাবের একটা কোণ বেছে নিয়ে বসে বিয়ার অর্ডার করতেন। তার পর নোটবুক খুলে লেখালেখিতে ডুবে যেতেন। সে দৃশ্য ক্যামেরায় তুলে রাখার মতো,” হাসিমুখে বলে চলেছেন অঞ্জন।
কথা বললে বোঝা যায় তাঁর কাছে ছবি করিয়ে হিসেবে দার্জিলিংয়ের গুরুত্ব কতটা। “সব চিত্রনাট্যই আমি দার্জিলিংয়ে বসে লিখেছি। ‘বড়াদিন’ থেকে ‘বং কানেকশন’ থেকে হালের এই ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না’। শুধু আমি নই। মানিকবাবু ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র চিত্রনাট্য লিখেছিলেন দার্জিলিংয়ে। এমনকী গৌতম ঘোষ ‘কালবেলা’র চিত্রনাট্যও লেখেন এখানে এসেই,” আড্ডার মেজাজে বলছিলেন অঞ্জন। |
|
দার্জিলিংয়ের টয় ট্রেনে যাত্রা। |
দার্জিলিং নিয়ে রকমারি জমাটি গল্প যেমন রয়েছে তাঁর ঝুলিতে, তেমনি রয়েছে একান্ত ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও। “যখন আমরা একেবারে ছোট, তখন আমাদের মতো ছাত্রদের এই রাস্তায় আসার অনুমতি ছিল না। কেভেন্টার্স থেকে দাশ স্টুডিও হয়ে মলের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত আমাদের যাওয়া মানা ছিল। কারণ শিক্ষকেরা তখন এই রাস্তার নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকতেন। আমরা বেড়াতাম বাজারের দিকটায়। ওখানে বেড়াতে বেড়াতে জোয়ি’স পাবের প্রেমে পড়ি,” গভীর আবেগ ভরা স্বরে বলেন অঞ্জন।
মুনমুন সেন, কেবল একটা হাঁটু পর্যন্ত শার্টে প্ল্যান্টার্স ক্লাবে একদিন হঠাৎ যত অঞ্জনের সঙ্গে কথা বলবেন, ততই বুঝবেন বিষয়টি যদি দার্জিলিং হয় মানুষটির গল্পের ঝুলি টইটুম্বুর। তিনি বলে চলেন তাঁর ছাত্রাবস্থায় শুধু যে সত্যজিৎ রায়কে দেখেছেন তা নয়, প্রায়ই দেখতেন সুচিত্রা সেনকে ঘুরে বেড়াতে। মুনমুন দার্জিলিংয়ে পড়তেন, তাই উনি আসতেন। সে সময় ওঁর জন্য ওবেরয় হোটেলের একটা ঘর সারা বছরই বুক করা থাকত। সেই ওবেরয় হোটেল এখন বন্ধ। সুচিত্রা গ্লেনারিজেও আসতেন। সেই সময় তাঁর মুখ কাপড়ে ঢাকা থাকত। শুধু চোখ দু’টি দেখা যেত।
‘‘আসল কথা কী জানেন, উনি ছিলেন স্টার,’’ বললেন অঞ্জন।
শুধু সুচিত্রা সেন নয়, তাঁর মেয়ে মুনমুন সেনকে নিয়েও মজার মজার গপ্পো আছে ‘অঞ্জনদা’র ঝাঁপিতে। “মুনমুন সেন হল মুনমুন সেন। প্ল্যানটার্স ক্লাবে একদিন হাঁটু পর্যন্ট শার্ট পরে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। কল্পনা করুন এক বার। ভাবতে পারেন মুমমুন সেনের মতো সুন্দরী কেবল একটা শার্ট পরে....। অথচ মুনমুন একেবারে কুল। কোনও তাপ-উত্তাপ নেই এমন ভাবে নিজেকে ক্যারি করছে। ওই অবস্থায় ওকে দেখে আমি চমকে উঠলাম। ইনফ্যাক্ট শুধু আমি নয়, কেভেন্টার্সের ছাদে আর যারা ছিল, তারা তো ওই দৃশ্য দেখে অজ্ঞান হয়ে যাবার জোগাড়। এক বার মাত্র ওই শার্ট পরা মুনমুনকে দেখার জন্য তারা তখন একে অপরের ঘাড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে,” হাসতে হাসতে বললেন অঞ্জন। |
|
‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না’র মিউজিক লঞ্চ। ছবি: সঞ্জয় পাঠক |
টুং, সোনাদা, ঘুম পেরিয়ে আমাদের মধ্যাহ্নভোজ প্রায় শেষ। এবং অঞ্জনদা মে ফেয়ার হোটেলের দিকে ছুটলেন। সেখানেই ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না’র মিউজিক লঞ্চ হল সে দিন। ছবি মুক্তি পাবে ২৪ জুন। এ ছবির প্রচণ্ড কর্মতৎপর প্রযোজক রানা সরকারের নিয়মনিষ্ঠ আয়োজনে কলকাতা থেকে ৫০ জন অতিথি এসেছিলেন সে দিন মিউজিক লঞ্চের অনুষ্ঠানে। অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে ছিলেন আবির, পার্ণ, উষশী। ছবির সুরকার নীল দত্ত থেকে সোমলতা, নন্দন বাগচী, অমিত দত্ত। ‘টিম অঞ্জন’ পুরোপুরি নিজেদের মেজাজে সে দিন হাজির ছিলেন। হাজির ছিলেন টেকনো ইন্ডিয়ার কর্ণধার এবং চলচ্চিত্র প্রযোজক সত্যম রায়চৌধুরী, পার্পল মুভি টাউনের কর্ণধার প্রীতিময় চক্রবর্তী এবং শিল্পপতি শিবাজী পাঁজা।
ওই অনুষ্ঠানকে নিছকই একটা সাদামাটা মিউজিক লঞ্চের অনুষ্ঠান বললে ভুল হবে। কারণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর অঞ্জন দত্ত ও তাঁর পুত্র নীল যুগ্ম ভাবে খুব সুন্দর সঙ্গীত পরিবেশন করলেন। পুরো অনুষ্ঠানটি ইংরেজি এবং বাংলায় নিপুণ ভাবে সঞ্চালনা করেন রায়া ভট্টাচার্য। নিজের লেখা ও সুর দেওয়া জনপ্রিয় গান থেকে ইংরেজি গান, অসাধারণ উষ্ণতা নিয়ে গাইলেন অঞ্জন। সম্ভবত দার্জিলিং তাঁর প্রিয় শিক্ষক মিস্টার হল-এর শহর বলেই এত দরদ ছিল সে দিনের গানে। অঞ্জন ছাড়াও বেশ কয়েকটি গান গাইলেন পূরণ গোংবা। অঞ্জনের বহু দিনের বন্ধু। পূরণ এক সময় কলকাতার ট্রিঙ্কাসে গাইতেন। এখন দার্জিলিংয়ের কিংবদন্তি জোয়ি’স পাবের মালিক।
পুরো আসরে অঞ্জনকে যদি স্টার পারফর্মার ধরা হয়, তা হলে তাঁর পাশাপাশি যাঁর নাম না বললে নয় তিনি হলেন সোমলতা। তাঁর গান বেশ আলোড়ন তুলেছিল সে দিন শ্রোতাদের মধ্যে। নীল দত্তের ‘আবিষ্কার’, সোমলতা ‘রঞ্জনা’ অ্যালবামে বেশ কয়েকটি গান গেয়েছেন। আশুতোষ কলেজের মনস্ত্বত্বের লেকচারারটি কিন্তু সে দিন তাঁর নিখুঁত কণ্ঠ আর সুরজ্ঞানে শ্রোতাদের মোহিত করে রাখলেন বেশ খানিকটা সময়। সব মিলিয়ে বলা যায় সোমলতা হয়তো আগামী দিনের সেই তারকা, যিনি এখন উইংসের পিছনে অপেক্ষা করছেন। তবে সমগ্র অনুষ্ঠানের সব থেকে মরমী মুহূর্ত তৈরি হল যখন অঞ্জন গেয়ে উঠলেন তাঁর বিখ্যাত ‘দার্জিলিং’ গানের সেই লাইন ‘খাদের ধারের রেলিংটা’।
শ্রোতারা তখন বিহ্বল, বাকরুদ্ধ, মোহিত। কারণ অঞ্জন তাঁর একান্ত ভালবাসার দার্জিলিংয়ে বসে আজ সে গান গাইছেন।
রঞ্জনা, আমি আর আসব না তিন দিনের মনমাতানো অনুষ্ঠান যখন শেষের মুখে তখন সব চেয়ে বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল যাঁকে, তিনি অঞ্জন। ওঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, অনেকটা সেই বালকের মতো যার হাত থেকে খেলনা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পাহাড়ি পাকদণ্ডী বেয়ে সমতলের দিকে আমাদের গাড়ি যখন নামছে তখন মনে হল অঞ্জনের যখন এত ভালবাসা, এত প্রেম এই শহরের প্রতি তাঁকে যেন কখনও গাইতে না হয় কোনও বিদায়ী গান।
অন্তত দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে কোনও দিন যেন তাঁকে গাইতে না হয় ‘রঞ্জনা, আমি আর আসব না।’ |
|
|
|
|
|