চোরাস্রোতটা প্রকাশ্য না হলেও আছে |
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় |
এ
সবের রেশ আমাকে যে সরাসরি স্পর্শ করে এমন নয়। বরঞ্চ আজ পর্যন্ত আমি ব্যক্তিগত ভাবে কোনও চোরাস্রোতের সম্মুখীন হইনি। কেউ কোথাও কখনও অসম্মান করেনি। তবে চোরাস্রোত যে একটা বুদ্ধিজীবী সমাজে আছে সেটা টের পেয়েছি। নন্দীগ্রাম-পরবর্তী সময়ে এই বিভাজনের কথাটা শুনেওছি বারবার। যাঁরা পরিবর্তনকামী ছিলেন, আজ নির্বাচনের পর তাঁদের সংখ্যাটা প্রচুর বেড়ে গেছে। কোথাও গিয়ে আপাত ভাবে মনে হচ্ছে, সব বোধহয় মিলেমিশে গেছে। অথচ আমার কেন জানি না মনে হয়, চোরাস্রোতটা আজও আছে। হয়ত প্রকাশ্য নয়, কিন্তু আছে। আগে ছিল, আজও আছে। |
আস্ফালনকারী সেই বামপন্থীদের শিরদাঁড়াগুলো যেন বেঁকে গেছে
|
দীপঙ্কর দে |
বুদ্ধদেববাবু যখন ‘আমরা-ওরা’ কটাক্ষটা করেছিলেন, তখন আমার ওঁকে মেগালোম্যানিয়াক মনে হয়েছিল। বিরোধী পক্ষকে উনি যথেষ্ট সম্মান দেননি তার ফল ওঁকে আজ ভুগতে হচ্ছে। আমি ওঁদের কাছে ‘ওরা’-ভুক্ত না হলেও কোথাও একটা অপসংস্কৃতির ব্র্যাকেটভুক্ত নিশ্চয়ই ছিলাম। এই যে নন্দনের ফেস্টিভ্যাল ওখানে নিশ্চয়ই মুখ্যমন্ত্রীর কিছু পছন্দসই মানুষ ছিলেন যাঁরা নিমন্ত্রিত হতেন। আমি আর পাঁচ জনের মতোই খুচখাচ কার্ড-টার্ড পেয়েছি। সম্মান পাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। সেই সময় টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিতে কিছু কিছু বামপন্থী শিল্পী-সমর্থক নিয়মিত আস্ফালন করতেন। কথায় কথায় এঁরা রাইটার্সে নাকি প্রতিনিধিদল নিয়ে যেতে পারতেন। এ বার ভোটের পর দেখছি আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে প্রচুর লোক পোশাক পাল্টেছেন। মহাকরণে পৌঁছনোর ফোন নম্বর জোগাড় করার জন্যও ফোন আসছে। আর আমাদের ইন্ডাস্ট্রির সেই আস্ফালনকারী বামপন্থীরা? এঁদের দেখছি ভয়ঙ্কর ম্রিয়মান। যেন শিরদাঁড়াটাই বেঁকে গেছে। |
সময় বলে দেবে এরা কত আন্তরিক |
শতাব্দী রায় |
এখন ‘আমরা’ বলে আর কিছু নেই। ‘আমরা’ উধাও। সবাই মিশে গেছে ‘ওরা’তে। ওরা হল তৃণমূল। এমন অবস্থা যে আগের লোকসভা নির্বাচনের সময়ও টালিগঞ্জের যারা রীতিমতো বামফ্রন্টের হয়ে ক্যাম্পেন করেছে তারাও এখন দিব্যি ‘ওরা’ হয়ে গেছে। এখানে একটা কথা বলি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায়ের মতো ইন্ডাস্ট্রিতে
কেউ কেউ আছেন যাঁরা বহু দিন ঘোষিত বামপন্থী। এঁদের লোকে সম্মান করে যে, একটাই নীতি প্রকাশ্যে নিয়ে চলছেন। কিন্তু গত দু’-তিন বছর ধরে যারা গলা ফাটাচ্ছিল আর আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করছিল তারা অবশ্যই
এক লেভেলের নয়। এরা
যতই ‘ওরা’ হয়ে যাক, আজ এদের লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কিছুই
করার নেই। সময়ই বলে দেবে
এরা কতটা আন্তরিক ভাবে ‘ওরা’ হয়ে থাকবে। |
একই প্রতিষ্ঠানে তো মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা কাজ করে |
প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় |
একটা প্রতিষ্ঠানে কি মোহনবাগান আর ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা একসঙ্গে কাজ করেন না? অফিস ক্যান্টিনে তাই নিয়ে লাঠালাঠি হতেই পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কাজ তাতে কোনও দিন ব্যাহত হয় না। টালিগঞ্জও তেমনই। আর্টিস্টস ফোরামের মিটিং-এ তাপস (পাল) আর বিপ্লবদা (চট্টোপাধ্যায়) পাশাপাশি বসেই আলোচনা করে। ফোরামের চেয়ারম্যান এখনও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ই। রাজনৈতিক মতবাদ যা-ই হোক, তিনি তো ইন্ডাস্ট্রির ‘ফাদার-ফিগার’। কোনও বিভাজন আমার চোখে পড়েনি। ইন্ডাস্ট্রির বিপদে বিপ্লবদা, তাপস, দীপকদা (চিরঞ্জিৎ চট্টোপাধ্যায়) আগেও একসঙ্গে এসেছে, আবারও আসবে। কর্পোরেট কালচার তো এমনই হওয়া উচিত। হ্যাঁ, পরিবর্তনের পর যেটা ভাল লাগছে, সেটা হল ইন্ডাস্ট্রির মানুষদের গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নতির জন্য কমিটিতে আমাদের রাখা হচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে। আগে যেটা করা হত না। |
আমি এই বিষয়ে কোনও কথা বলতে চাই না: রূপা গঙ্গোপাধ্যায়
|
অন্তহীন রানিং |
তাপস পাল |
‘আমরা-ওরা’ বলে এখন আর কিছু নেই। সবাই ‘ওরা’ হয়ে গেছে। এ বার প্রশ্ন হল, আমাদের ইন্ডাস্ট্রির জেনুইন ‘ওরা’ ক’জন? অন্তত ১৩ বছর আগের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দু’-এক জনের বেশি ইন্ডাস্ট্রিতে তখন তৃণমূল সমর্থক দেখিনি। সে বারই দিদির সঙ্গে আমি যোগ দিই। তখন কার্যত ইন্ডাস্ট্রি আমায় একঘরে করে দিয়েছিল। প্রচুর ছবি হাত থেকে চলে যায়। মজাও লাগে। এবার ভোটের দিন এক বিখ্যাত অভিনেতাকে স্টার আনন্দ জিজ্ঞেস করল, পরিবর্তন না প্রত্যাবর্তন? উনি হাত-টাত ঝাঁকিয়ে বললেন, “এ কী কথা, এ কী কথা!” ভোটের পর দেখছি ইনি দিদির পিছনে ছুটছেন, ছবি তুলছেন। আরেক বিখ্যাত পরিচালক, এঁকে দেখা যেত সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে। ইনিও ছুটছেন দিদির পাশে। তৃণমূলের সৈনিক হিসেবে তাতে আমার কোনও সমস্যা নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যিই এ রাজ্যের উন্নতি করতে চান। এঁরা যদি সেই উদ্যোগে সামিল হতে চান, খারাপ কী? শুধু ভয় হয়, এঁরা এমন অন্তহীন ‘রানার’, যে সিপিএম আমলে মুখ্যমন্ত্রীর পিছনে ছুটেছেন। সুবিধেবাদী হিসেবে গা-বাঁচাতে ছুটেছেন। এ বারও ছুটছেন।
আশা করব এ বারের ‘ছুটটা’ যেন উন্নতির ‘ছুট’ হয়। |
কোনও ভাল কাজে বর্তমান সরকার উদ্যোগী
হলে কি সৌমিত্রবাবুকে বাদ দেওয়া হবে? |
ইন্দ্রাণী হালদার |
একটা তুমুল রাজনৈতিক পরিবর্তন আমাদের রাজ্যে এসেছে সেটা মেনে নিয়ে এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে শিল্পীর কোনও জাত, দল হয় না। ব্যক্তিগত জীবনে কে কোন দলকে সমর্থন করেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সবাই মিলে টালিগঞ্জের ভালর জন্য কাজ করা। কালীঘাটে মমতাদির বাড়িতে ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তাতে কেউ যদি আমায় ওঁর ঘনিষ্ঠ বলে মনে করতে চান, তা হলে সেটা করতেই পারেন। সেই কারণে টালিগঞ্জের কেউ কেউ আমাকে একঘরে করে দেবেন কী না সেটা অবশ্য এখনও জানি না। আসলে কার গায়ে কী রাজনৈতিক রং লেগে আছে শুধু সেটা দিয়ে মানুষটাকে বিচার করাটা বোধহয় ঠিক নয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যেমন, উনি যে বামপন্থী মানুষ, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর বন্ধু এটা তো সবাই জানেন। তাই বলে কি এখন ইন্ডাস্ট্রির কোনও ভাল কাজে বর্তমান সরকার উদ্যোগী হলে সৌমিত্রবাবুকে সেই কাজ থেকে বাদ দেওয়া হবে? সেটা কি আদৌ সম্ভব? |
রাজনৈতিক বিশ্বাস কোনও দিনই কাজকে ছাপিয়ে মাথা চাড়া দেয়নি |
রঞ্জিত মল্লিক |
সাতের দশক থেকে বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে আছি। দেখেছি বারবার নানা
রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী শিল্পী একই ছবিতে এসে মনপ্রাণ দিয়ে কাজ করেছেন।
তাঁদের রাজনৈতিক বিশ্বাস কোনও দিনই কাজকে ছাপিয়ে মাথা চাড়া দেয়নি।
কে কোন রাজনৈতিক দলে মতবাদে বিশ্বাস করে এ কথাটা ছবি করার
সময় শু্যটিং ফ্লোরে এসে মনে থাকেনি। |
বিভাজন একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই |
কৌশিক সেন |
পরিবর্তনের পর বিভাজন যে একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। ঘোরটা কাটতে সময় লাগবে। বিভাজনে যে কোনও রাজনৈতিক দলেরই সুবিধা হয়। প্রশ্নটা হল,
সেই সুবিধেটা কি আমরা তাদের পেতে দেব? ধীরে ধীরে বোধহয় আমরা বুঝতে শুরু করেছি
ব্যাপারটা। এটুকু বলতে পারি,
একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
আমাদের নাট্যোৎসবটা তার
একটা ছোট্ট উদাহরণ। ব্রাত্য বসুর সাম্প্রতিক নাটক নিয়ে একটা ফেস্টিভাল। একই মঞ্চে
চন্দন সেনকেও সম্মাননা
জানানো হল। চন্দন-ব্রাত্য কিন্তু
সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুর রাজনীতিতে বিশ্বাস করে। এমন প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই আরও অনেক হচ্ছে। |