জয় আবেগের |
স্বপ্নের শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে |
শান্তনু ঘোষ |
কখনও প্রচণ্ড গতিতে বইছে ঝোড়ো হাওয়া। চোখে-মুখে ছিটকে লাগছে বরফের টুকরো। চোখের সামনে ধসে পড়ছে সামনে এগনোর রাস্তা। আবার কখনও ‘জ্যামে’ পড়ে টানা দেড় ঘণ্টা দড়ি ধরে ঝুলে থাকা। এ ছাড়াও পদে পদে ছিল প্রতিকূল পরিস্থিতি। কিন্তু তাতে কী-ই বা এসে যায়?
স্রেফ ইচ্ছাশক্তির জোরে সব বাধা অতিক্রম করে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ স্পর্শ করার অনুভূতিটাই যে আলাদা। এমনটাই মনে করেন বালি ও বরাহনগরের অবিবাহিত দুই পর্বতারোহী যুবক। ছোট থেকেই পাহাড়ে চড়ার নেশা। আর সেই নেশাই তাঁদের টেনে নিয়ে গিয়েছিল এভারেস্ট শৃঙ্গের পথে। ৫১ দিনের যুদ্ধের পর এভারেস্ট জয় করে রীতিমতো ‘হিরো’ বালির বেলানগরের ৪৫ বছরের দীপঙ্কর ঘোষ এবং বরাহনগরের ৩৮ বছরের রাজীব ভট্টাচার্য।
এভারেস্ট শৃঙ্গের উচ্চতা ৮৮৪৮ মিটার (২৯০২৯ ফুট)। বিশ্বের সর্বোচ্চ এই শিখরে আরোহণ করাটা পর্বতারোহীদের কাছে রীতিমতো স্বপ্নের। আর তাই বিভিন্ন পর্বতশৃঙ্গ জয়ের পরে এভারেস্ট জয়ের স্বপ্ন অনেক দিন ধরেই মনের ভিতর পুষে রেখেছিলেন ওই দুই যুবক। অবশ্য সেই কথা একে অপরকে কখনওই বলেননি। কিন্তু ২০১০-এর অক্টোবরে রাজীব জানতে পারেন, দীপঙ্করও তাঁরই মতো একই পথের পথিক। |
|
বাড়িতে আলাপচারিতায় দীপঙ্কর ঘোষ ও রাজীব ভট্টাচার্য। রণজিৎ নন্দী |
এ বছরের জানুয়ারিতে আচমকাই দীপঙ্করের বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পরের দিনই বাড়ি ভর্তি লোকের সামনে নিজের মনের কথা জানান ব্যবসায়ী দীপঙ্কর। প্রথমে তাঁর মা শ্রীলা দেবী ছেলের এই অভিযানে বাধ সাধলেও পরে মত দেন। এর পরেই শুরু হয় এভারেস্ট যাত্রার খরচ জোগাড়ের তোড়জোড়। কিন্তু বিপুল খরচের জোগান মিলবে কোথা থেকে? এই চিন্তাই ঘুরপাক খেতে থাকে দীপঙ্কর ও রাজীবের মাথায়। তাঁদের কথায়, “বন্ধুদের সঙ্গেই অনেক শুভানুধ্যায়ীও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। কিন্তু তাতেও কি আর প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা জোগাড় করা সম্ভব?”
রাজীব বললেন, “বংশের পূর্বপুরুষের গয়না ও আমার নিজস্ব কিছু মূল্যবান পাথর মায়ের অনুমতি নিয়ে বিক্রি করে কিছু খরচ জোগাড় করেছিলাম।” আর দীপঙ্করও নিজের জমানো অর্থ ও আত্মীয়-পরিচিতদের থেকে টাকা জোগাড় করে পাড়ি দেন এভারেস্টের উদ্দেশে। দার্জিলিংয়ের একটি পর্বতারোহণ সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে শ্রীরামপুরের ‘অঙ্গণ ছাড়িয়ে’ ও ভদ্রকালীর ‘পদাতিক’ সংস্থার পক্ষে ১লা এপ্রিল দুই পর্বতারোহী পাড়ি দেন কাঠমান্ডুর উদ্দেশে। ৪ এপ্রিল লুকলার উদ্দেশে রওনা দেন দীপঙ্কর, রাজীব ও শেরপা পূর্বা। পরের দিন রাঁধুনি সন্তোষকে সঙ্গী করে চার জনে এগোতে থাকেন বেসক্যাম্পের দিকে। নামচে বাজার, দেবুচে, থুকলার মতো বিভিন্ন জায়গা পার করে ১২ এপ্রিল তাঁরা পৌঁছন ১৭৬০০ ফুট উচ্চতায় এভারেস্ট বেসক্যাম্পে। কয়েক দিন আগেই অবশ্য সেখানে চলে এসেছিলেন রাজীব-দীপঙ্করের আরও দুই সঙ্গী শেরপা কর্মা ও রাঁধুনি বুদ্ধি।
২২ এপ্রিল দুই যুবক বেস ক্যাম্প ছেড়ে এক নম্বর ক্যাম্পের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। দীপঙ্করের কথায়, “ওই পথেই রয়েছে এভারেস্ট জয়ের সব থেকে বড় বাধা খুম্বু আইস ফল। প্রায় ৪ কিলোমিটার এই রাস্তায় যখন-তখন হতে পারে তুষারপাত, যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে আইস পিলার।” রাজীবের কথায়: “পরের দিন সকালে ক্যাম্প ২-এ পৌঁছে ফের ফিরে এলাম বেসক্যাম্পে। আবহাওয়া ও প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্যই এই ফিরে আসা। চার দিন বিশ্রাম নিয়ে এ বার সরাসরি ক্যাম্প ২-এ পৌঁছলাম।” |
|
দীপঙ্কর জানালেন, এর পরে প্রায় ১০০ থেকে ২০০ ফুট উচ্চতার ও ৯০ ডিগ্রি খাড়া দু’টি বরফের দেওয়াল টপকে তাঁরা পৌঁছন ৩ নম্বর শিবিরে। এর পরে নীচে নেমে ফের উপরে উঠতে গিয়ে পথও হারিয়ে ফেলেন তাঁরা। ঘন কুয়াশা আর তুষারপাতের মধ্য দিয়ে এগোতে গিয়ে অন্য পথে চলে যান তাঁরা। ঘণ্টা দু’য়েক ঘুরপাক খেয়ে অবশেষে কোনওমতে নিজেদের ২ নম্বর শিবির খুঁজে পান। ফের বিপদ আসে ক্যাম্প ৩-এ যাওয়ার সময়। দীপঙ্করের কথায়: “সকাল থেকেই প্রচণ্ড গতিতে ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। সঙ্গে বরফের টুকরো উড়ে এসে চোখে-মুখে ছিটকে লাগছিল। কোনওমতে বরফের দেওয়ালে মুখ গুঁজে রাখলাম। কিছু ক্ষণ পরে দেখি, আমাদের গায়ের উপর সাদা বরফের আস্তরণ। হাওয়া থামতে ফের ওঠার শুরু।”
এর পরেও যে বাধা-বিপত্তি ছিল না তা নয়। কিন্তু সব কিছু অতিক্রম করে ১৯ মে দীপঙ্কর ও রাজীব জেনিভার স্পার, ইয়েলো বেন্ড পার করে পৌঁছে যান ৪ নম্বর শিবিরে। পরের দিন বেরিয়ে হিলারি স্টেপ পার করে ২১ মে সকালে দু’জনেই পৌঁছে যান বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে। ভারতীয় সময় সকাল ১০টা ৫ মিনিটে প্রথম এভারেস্টের শৃঙ্গ স্পর্শ করেন বরাহনগরের রাজীব। তার ঠিক ১৩ মিনিট পরে ১০টা ১৮ মিনিটে দীপঙ্কর। শীর্ষবিন্দুতে ভারতের জাতীয় পতাকা লাগিয়ে এলেন দুই যুবক। পূর্বা ওয়াকিটকিতে খবর পাঠাল বেসক্যাম্পে। সেখান থেকেই খবর পৌঁছল সর্বত্র।
কেমন লাগছিল তখন? অনেক ক্ষণ চুপ করে থাকার পরে দু’জনেই অস্ফুটে বললেন, “কিছু ক্ষণের জন্য সব ভুলে গিয়েছিলাম।”
|
কামেট অভিযানে |
১২ সদস্যের দল নিয়ে আজ, শনিবার কামেট শৃঙ্গ অভিযানে রওনা দিল সাঁতরাগাছির ‘শৈলসাথী’। গত বছরই সংস্থার ১৬তম অভিযান সফল হয়। মুলকিলা-১০ অভিযানে গিয়েছিল সংস্থার সদস্যরা। গাড়োয়াল হিমালয়ে অবস্থিত কামেট শৃঙ্গের উচ্চতা ২৫,৪৪৬ ফুট। ৪০ দিনের অভিযানের নেতৃত্ব দেবেন আশিস পাল। দলে থাকছেন আরও ৮ জন সদস্য। |
|