|
|
|
|
|
|
দৃষ্টান্ত |
ব্যতিক্রমী লড়াই |
জয়তী রাহা |
সিনেমার পর্দায় ভেসে ওঠা কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়। বরং, কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে মৃত্যুর চোখে চোখ রেখে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কাহিনির নায়ক। খাদ্যনালীর দুরারোগ্য ক্যানসার যাঁকে এই আটাত্তর বছর বয়সেও দমাতে পারেনি।
ক্যানসার তো আরও অনেকেরই হয়। কিন্তু, রমাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে ব্যতিক্রমী কেন? কারণ, জীবনযুদ্ধে লড়াই চালানোর পাশাপাশি তিনি তৈরি করেছেন আর এক কীর্তি। এ বছরেই দিল্লির তালকাটোরা ইন্ডোর স্টেডিয়ামে আয়োজিত বয়স্কদের ১৮তম জাতীয় টেবল টেনিসের আসর থেকে তাঁর বিভাগে ছিনিয়ে এনেছেন ব্রোঞ্জ পদক।
বয়সের কারণে চিকিৎসকেরাও দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন অস্ত্রোপচারে। রমাপ্রসাদবাবুর স্ত্রী অনুরাধা দেবীর কথায়: “খবরটা শুনে প্রথমে ভীষণ ভেঙে পড়ি। ওঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘আমি কি সুস্থ হতে পারব, ডাক্তারবাবু? এর জন্য আমাকে কী করতে হবে?” বাকিটা অক্ষরে অক্ষরে চিকিৎসকের নির্দেশ পালন। শরীর-মনের অহোরাত্র সংগ্রাম। মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত স্ত্রীকে সাহস জোগানোর কাহিনি। |
|
তিনটি কেমোথেরাপির পর অপারেশন হয়েছিল। খাদ্যনালী ও পাকস্থলীর সংযোগস্থলে বাসা বেঁধেছিল ক্যানসার। ফলে ওই অংশের ১০ সেন্টিমিটার বাদ দিতে হয়। পাকস্থলী ছোট হওয়ার কারণে আমৃত্যু কিছু সমস্যা তৈরি হয়।
মাত্র দু’মাসের চর্চা আর মনোবলকে সঙ্গী করে হাসিমুখে পেরিয়েছেন সেই বাধা। যা শুনে উচ্ছ্বসিত ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিমত: “বার্ধক্যকে জয় করে যে কোনও সাফল্যই বড় প্রাপ্তি। তার ওপর ক্যানসার? যেখানে মৃত্যুভয় প্রতি মুহূর্তে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। আমরাও অনেক সময় ওঁদের বাতিলের দলে ফেলি। ঠিকমতো চিকিৎসা হলেও শারীরিক সক্ষমতা অনেকটা কমে যায়। এ সব সত্ত্বেও ইতিবাচক চিন্তার প্রভাবে লড়াই করার ক্ষমতা যে অনেক বেড়ে যায় তা প্রমাণিত হল আবার।”
বর্তমানে দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা রৌরকেলার স্টিল প্ল্যান্টের অবসরপ্রাপ্ত কর্মী রমাপ্রসাদবাবুর প্রথম পছন্দ রোয়িং। ১৯৫৬ থেকে পর পর তিন বছর আশুতোষ কলেজ রোয়িং-এ বিশ্ববিদ্যালয় সেরা নির্বাচিত হয়। সেই দলে ছিলেন তিনি। পেয়েছেন আরও পুরস্কার। কর্মসূত্রে জার্মানিতে থাকার সময় থেকেই ছেদ পড়ে খেলাধুলোর চর্চায়। ফের ’৯৭ থেকে নিয়মিত টেবল টেনিস খেলার সূচনা। ২০০০ সালে ধানবাদের সিন্ধ্রিতে বয়স্ক জাতীয় টেবল টেনিসের ব্যক্তিগত ও দলগত বিভাগে রুপো পান। ওই বছরই কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে বিশ্ব টেবল টেনিসের আসরে জার্মানির কাছে দ্বিতীয় রাউন্ডে হেরে যান। এর পর ২০০৩, ’০৪ এবং ০৬-এ চণ্ডীগড়, মুম্বই ও অন্ধ্রপ্রদেশে আয়োজিত জাতীয় টেবল টেনিস প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পদক অর্জন করেন।
বর্তমানে কী ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাঁকে? রমাপ্রসাদবাবুর কথায়: “পাকস্থলী ছোট হওয়ায় অল্প করে খাবার খেতে হয়। সোজা হয়ে শোয়া যায় না। সব সময় ৩০ ডিগ্রি কোণে শুতে হয়। সেই সঙ্গে দুর্বলতা তো আছেই।” |
|
তাঁর লড়াইয়ের রসদ জোগানোর পিছনে কি তবে খেলোয়াড়ি মনোভাব? প্রশিক্ষক মান্তু মুর্মুর অভিজ্ঞতায়, “শারীরিক সমস্যা নিয়ে উনি আলোচনাই করেন না। নিজের খেলা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, ত্রুটি সংশোধনের উপায় নিয়ে ভাবনাচিন্তাতে তাঁর উৎসাহ বেশি।” একই মত তাঁর স্ত্রী অনুরাধা দেবীরও।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ কেদাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, “মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এঁদের বলে পার্সোনালিটি প্যাটার্ন। সমস্যা যতই বড় হোক তা নিয়ে না ভাবা, সুখ-দুঃখকে জীবনের অঙ্গ হিসেবে মেনে নেওয়া, সকলের সঙ্গে সুন্দর ভাবে মিশতে পারা, আত্মকেন্দ্রিক না-হওয়া এঁদের স্বভাবের বৈশিষ্ট্য। এর জন্য ব্যক্তিকে খেলোয়াড় হওয়ার প্রয়োজন নেই। হাতে গোনা মানুষ জন্মসূত্রে এমন হন। তবে দীর্ঘ দিন ধরে ইতিবাচক চিন্তার অভ্যাসে এই গুণ অর্জন সম্ভব। সেটা করতে পারলে জীবনের যে কোনও যন্ত্রণাই সহজ হয়ে যাবে।” পরিবারের সমর্থন আর উৎসাহ সঙ্গে নিয়ে এখন রমাপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের লক্ষ্য স্থির একটা সোনা জিততেই হবে! |
|
|
|
|
|