|
|
|
|
|
|
আল ইজ ওয়েল |
সফল মানে আমার কাছে ছক-ভাঙার সাহস। নিজের জীবনেও সেটা করার চেষ্টা করেছি,
খানিকটা সফলও হয়েছি। বলছেন চেতন ভগত। আলাপচারিতায় শোভন তরফদার |
তিনি যে পাঁচ জনের মধ্যে পঞ্চম, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। না হলে, আই আই টি এবং আই আই এম-এর ঝকঝকে টেক-অফ প্যাড এবং তারপরে ব্যাঙ্কের চাকরির সফল উড়ান থেকে কি না সরাসরি ‘হাউস হাজব্যান্ড’! অবশ্য, তার মধ্যে আরও কিছু কাজ হয়েছে। একের পর এক দুর্দান্ত সফল ‘বেস্টসেলার’, বলিউডে এ যাবৎ কালের ‘সফলতম’ ছবির কাহিনিকার, গত বছরে ‘টাইম’ ম্যাগাজিনের বিচারে বিশ্বের একশো জন সর্বাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় ঠাঁই এবং বাচ্চা আর গিন্নির রোজকার ‘লাঞ্চবক্স’ ঠিক করে দেওয়ার ফাঁকে
জেটসেটিং জীবন।
উঁহু, চেতন ভগত ঠিক অতুলনীয় নন। তিনি নিজেই নিজের তুলনা। নিজে তিন বোকার গল্প লিখেছেন, সেই ‘থ্রি ইডিয়টস’-এর পরে যদি কেউ তাঁকে চতুর্থ ‘মূর্খ’ বলতে চায়, চেতন হাসবেন। হাসিটি অমায়িক। স্বাভাবিকও বটে। নিজেই তো লিখেছেন বই, ‘থ্রি মিসটেকস অফ মাই লাইফ’। সেই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা, সবই অবশ্য ভুল নয়। চেতন জানেন সে কথা। কারণ, তিনি সেই বিরল গোত্রে পড়েন, যাঁরা ভুল করতে ভয় পান না, বরং ঝাঁপ দেন অনিশ্চিতের দিকে। আনন্দবাজার পত্রিকা ও সরস্বতী অনলাইন ডট কম ইন্ডিয়া-র (অন্যতম আয়োজক টেকনো ইন্ডিয়া গ্রুপ) উদ্যোগে আয়োজিত ‘এডুকোয়েস্ট’-এ তুমুল একটি সেশন-এর পরে মাত্র কয়েক মিনিট একান্তে মুখোমুখি, সুতরাং প্রশ্নসংখ্যাও সীমিত। প্রথমেই জিজ্ঞেস করা হল, র্যাঞ্চোকে চেনেন?
হ্যাঁ, চিনি (হাসি)।
নিজের সঙ্গে মেলাতে পারেন?
|
|
হ্যাঁ, পারি। আবার, একেবারে সবটা যে পারি, তা-ও নয়। চিনি, কারণ আমারও একটা কলেজ-জীবন ছিল, সুতরাং, র্যাঞ্চোকে দেখেছি। আবার, এটাও ঠিক যে র্যাঞ্চো অনেকটাই আদর্শ চরিত্র। পরিভাষায় বলতে পারেন, ‘নিয়ার-পারফেক্ট’! তার জীবনে কোনও ভুল-ভ্রান্তি নেই বললেই চলে। আমরা যে যার নিজের জীবনে ঠিক ততটা র্যাঞ্চো বোধহয় নই। জীবনে ওঠাপড়া আছে, যতই পরিকল্পনা করে এগোন, আপ গিরোগে জরুর...
ঠিক, এটা আপনি বারবারই বলেন। আপনার কাছে ‘সাফল্য’ শব্দটার মানে কী?
চেতন ফের হাসলেন, নিজেকে চ্যালেঞ্জ করা। ঠিক, সবার প্রতিভা সমান নয়। আবার প্রতিভা যা-ই থাক, সবাই যে সব সময় সেই প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ পাবে, তা-ও নয়। কিন্তু, পরিস্থিতি যা-ই হোক, প্রতিভা যা-ই থাক, যদি নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ-এর মুখে ঠেলে দিতে না পারেন, তা হলে, আমি বলব, সাফল্য আসবে না। কোনও দিন না। পড়ে যেতে যেতে, বা পড়ে যাওয়ার পরেও যদি উঠে দাঁড়াতে পারেন, সেটাই সাফল্য। সফল মানে আমার কাছে ছক-ভাঙার সাহস। নিজের জীবনেও সেটা করার চেষ্টা করেছি, খানিকটা সফলও হয়েছি...
চেতন ভগত কথা বলেন দ্রুত, এবং ভাবনারা নানা দুঃসাহসী ইঙ্গিত ছড়িয়ে যায় অবিরাম। সুতরাং, শেষ প্রশ্নটা উঠে এল এই কয়েক মিনিটের কথাবার্তা থেকেই।
এই যে আপনি সাফল্যের কয়েকটা শর্ত বললেন, পড়ে যেতে যেতেও উঠে আসা, ছক ভাঙার ক্ষমতা, সেই সব মাপকাঠির বিচারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘সফল’ বলবেন?
একশো বার! সফল তো বটেই, আমি বলব ওঁর একটা অদ্ভুত ‘আন্ডারস্টেটেড ক্যারিশমা’ আছে, যেটা একেবারে ওঁর নিজস্ব!
ক্যারিশমা, কিন্তু আন্ডারস্টেটেড!
চেতন অনুমান করলেন, তাঁর বক্তব্য ঈষৎ বিস্ময় জাগিয়েছে, তাই ভেঙে বললেন, আমি মনে করি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক ‘লার্জার-দ্যান-লাইফ’ নন, জয়ললিতা বা ধরা যাক নরেন্দ্র মোদী যে ধরনের ব্যক্তিত্ব, মমতা ঠিক সে রকম নন। কিন্তু, নন বলেই তাঁর সঙ্গে জনতার যোগাযোগটা তৈরি হয়ে যায়। তাঁকে জয়ললিতা হতে হয় না।
একটু ডিস্টার্ব করছি। আপনিই কিছু দিন আগে লিখেছিলেন, এখন আর মুখচোরা রাজনীতিবিদদের যুগ নেই। এখন রাজনীতিকরা নিজের কথা নিজেই বলবেন, গলা তুলে বলবেন, সে রকমই যুগ! যেমন, জয়ললিতা, যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
ঠিক, সে অর্থে তো মমতার সঙ্গে জয়ললিতার একটা তুলনা টানাই যায়, কিন্তু আপনি যদি ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির কথা ভাবেন, এঁদের কখনওই এক সারিতে রাখা যাবে না। মাটির কাছাকাছি যাঁরা, তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে নিজেকে সহজে মেলাতে পারেন। আপনাদের এ বারে বিধানসভা ভোটের ফলই তার প্রমাণ। ঠিক, জয়ললিতাও বিপুল ভোট পেয়ে ফের ক্ষমতায় এসেছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে মমতার ভাবমূর্তির আকাশ-পাতাল ফারাক। অবশ্য, আমি এটাও জানি যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সামনে চ্যালেঞ্জটাও
খুব কঠিন।
কেন? প্রত্যাশার চাপ?
সেটা তো আছেই, তা ছাড়া যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, সেটা পূরণ করে ফের নতুন করে এগোনো মুখের কথা নয়।
ক্ষতি?
চেতন হাসলেন, ক্ষতি নয়? কলকাতার কথাই ধরুন না। ভারতের অন্য শহরগুলো দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, কলকাতা তাল রাখতে পারছে না, পরিকাঠামোর দশা করুণ, কর্মসংস্কৃতির হাল কী, তা আপনারাই ভাল করে জানেন, আমি আর কী বলব...এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। কাজটা কঠিন, কিন্তু কঠিন বলেই সেটা উপভোগ করার জিনিসও বটে...
কথা আরও একটু এগতো হয়তো, হঠাৎই এক ভদ্রমহিলার প্রবেশ। সেই সহাস্য মাঝবয়সিনী বললেন, চেতন!
তাঁকে দেখামাত্র চেতন উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। দৃশ্যতই বিস্মিত, এবং তুমুল বিস্মিত। বললেন, আপ, ইঁহা?
জানা গেল, ভদ্রমহিলা চেতন ভগতের ‘টিউটর’ ছিলেন। তাঁকে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে কলকাতায় দেখে, কে জানে, হয়তো ভারতের পয়লা নম্বর বেস্ট সেলার লেখকের ছোটবেলাটাই হুড়মুড়িয়ে ফিরে এল। বললেন, আমার স্ত্রী-ও এখানেই আছে, ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার?
শিক্ষিকা খোঁজখবর নিচ্ছেন, তুমি কেমন আছ? স্ত্রী? বাচ্চা? বাড়ির আর সবাই ভাল আছেন তো? চেতন হাসছেন, বলছেন, ভাল, ভাল, সবাই ভাল...
কী জানি, শ্রুতিবিভ্রম কি না জানি না, উঠে আসতে আসতে মনে হল শুনলাম, আল ইজ ওয়েল, আল ইজ ওয়েল... |
|
|
|
|
|