অবশেষে উদ্যোগ
কত অজানারে...
ছরের পর বছর অবহেলা, অযত্নে পড়ে থাকা মহাকরণের বহু পুরনো ভূমি সংস্কার দফতরের গ্রন্থাগারটি সংস্কারের কাজে হাত দিতে চায় মুখমন্ত্রীর সচিবালয়। এ ব্যাপারে তারা ভূমি সংস্কার দফতরের কাছে নির্দিষ্ট প্রস্তাবও চেয়েছে। ফলে, এত দিনে টনক নড়েছে রাজ্যের ভূমি সংস্কার দফতরের। ওই গ্রন্থাগার সংস্কারের বিষয়ে প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে বলে ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রের খবর।
কী আছে ওই গ্রন্থাগারে? ব্রিটেনের হাউস-অফ-কমন্স-এ ১৮১২ সালে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজ নিয়ে বিতর্ক। বিবেচনার জন্য কমন্স-এর সিলেক্ট কমিটিতে গেল সেই আলোচনা। তা নিয়ে ওই বছরেরই ২৮ জুলাই প্রকাশিত হল সিলেক্ট কমিটির পঞ্চম রিপোর্ট। ওই রিপোর্টেই এ দেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজকর্মের গতিবিধির সবিস্তার তথ্য রয়েছে। গবেষকেরা কোথাও যদি ওই রিপোর্টের সন্ধান না পান তা হলে তা পাওয়া যেতে পারে মহাকরণের চার নম্বর ব্লকের এক তলায় ভূমি সংস্কার দফতরের বিশাল এই গ্রন্থাগারে।
সেখানেই দেখা যায়, ১৯০৬ সালে সরকারি কর্মীদের বেতনের রেজিস্টার। নিবারণ বারি নামে এক কর্মী রেভিনিউ স্ট্যাম্পে সই করে তাঁর প্রাপ্য ৮ টাকা মাসিক বেতন নিয়েছেন। আরফাত আলি পেয়েছেন ১০ টাকা মাসিক বেতন। ওই রেজিস্টারেই দেখা যাচ্ছে, সে সময়ে সবচেয়ে বেশি বেতন তুলেছেন বাবু বিনোদবিহারী সরকার। তিনি পেয়েছেন ৮২৪ টাকা। এই গ্রন্থাগারেই সন্ধান মিলবে ওয়ারেন হেস্টিংস-এর সই করা নানা আদেশনামা। পাওয়া যাবে ১৮৭৪ সালে অবিভক্ত বাংলায় আফিম চাষের হিসেব-নিকেশের নানা তথ্য। জন স্কট নামে এক রাজকর্মচারী ছিলেন আফিম চাষ দফতরের দায়িত্বে। জাবদা খাতায় রয়েছে আফিম গাছের ছবি। রয়েছে চাষের জমির পরিমাণ এবং আয়-ব্যয়ের হিসেব।
ইংরেজরা তখন এই দেশ শাসনের দায়িত্বে। রাস্তাঘাট, আদালত, হাসপাতাল, বাড়িঘর তৈরির জন্য জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু হল। তৈরি হল ‘বোর্ড-অফ রেভিনিউ’। সে সময় ‘বোর্ড-অফ রেভিনিউ’-এর সদস্যরা এই গ্রন্থাগারে বসেই কাজ করতেন। সেই আমলের সব নির্দেশনামা রয়েছে এখানে। রয়েছে ঢাকা, রাজশাহী, প্রেসিডেন্সি ডিভিশন-সহ ঠাকুর পরিবার, রামমোহন রায়ের পরিবার, মুর্শিদাবাদের জগৎ শেঠের পরিবার থেকে শুরু করে অবিভক্ত বাংলার খ্যাতনামা পরিবারের বংশ তালিকা ও ইতিহাস। এই গ্রন্থাগারেই মিলবে স্যুয়েজ খালের ম্যাপ, জি টি রোড তৈরির তথ্যাবলী। ৬৮টি থাকে গ্রন্থগারে রয়েছে জমি সংক্রান্ত ৬০ হাজার দুষ্প্রাপ্য বই।
তবে, সেই গ্রন্থাগারের এখন বেহাল দশা। বিশাল হলঘরের এক তলা এবং দোতলায় ডাঁই করে ফেলে রাখা হয়েছে উল্লিখিত সব বই। ১৭৯০ সাল থেকে ক্যালকাটা গেজেট, সাঁওতাল বিদ্রোহ থেকে শুরু করে অপারেশন বর্গার পুরনো সব নথিপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। সামনের ঘরে কর্মীদের বসার জায়গা। গ্রন্থাগারিক ছাড়াও রয়েছেন দু’জন সরকারি কর্মী। তাঁদের বসার জায়গার পিছনেই বিশাল হলঘরের র্যাকগুলিতে অবহেলায়, অযত্নে পড়ে রয়েছে মূল্যবান সব নথি। গ্রন্থাগারের পাশেই শৌচাগার। দুর্গন্ধে টেকা দায়। তাই ১৮টি জানলা থাকলেও সব বন্ধ। প্রায় অন্ধকার ঘরে হাতড়ে বেড়াতে হয় নথিপত্র। পুরনো দিনের সেই সব দলিল-দস্তাবেজ কম্পিউটারে নথিভুক্ত করার কথা ছিল। কথা ছিল সব নথিপত্র স্ক্যান করানো হবে। কিন্তু, করা হয়নি কিছুই। নথিপত্রে কীটনাশক স্প্রে করার প্রস্তাব কাগজে-কলমেই রয়ে গিয়েছে। পূর্ত দফতরকে কোনও দিন কিছুই জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন রাজ্যের পূর্তসচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন। এক জন অস্থায়ী কর্মীকে গ্রন্থাগার ঝাড়পোছের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গত ১৩ মাস তিনি একটি টাকাও পাননি। বাধ্য হয়েই তিনি কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে জানান গ্রন্থাগারের কর্মীরাই। সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লা দীর্ঘ দিন ধরেই ছিলেন ভূমি সংস্কার দফতরের দায়িত্বে। তিনি নিজেই স্বীকার করেন, “সোনার খনি এই গ্রন্থাগারটির প্রতি কোনও নজরই দেওয়া হয়নি।” কেন? রেজ্জাকের মন্তব্য: “যে সব অফিসারের উপর দায়িত্ব দিয়েছিলাম, তাঁরা কিছুই করেননি। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার কিছু দিন আগে বিষয়টি আমার নজরে আসে। কিন্তু, তখন আর কিছুই করার ছিল না।” ভূমি সংস্কার দফতরের সচিব আর ডি মিনা যদিও বলেছেন, “গ্রন্থাগারটির সংস্কারের বিষয়ে আমরা মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ে সবিস্তার প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।”

ছবি: অশোক মজুমদার
Previous Story

Kolkata

Next Story

 



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.